• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

শিল্প

পাটকল ইজারা দেবে সরকার

সোনালি আঁশে সুদিন ফেরার অপেক্ষা 

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ২৬ ডিসেম্বর ২০২০

একসময় সোনালি আঁশে সোনা ফলত। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশন (বিজেএমসি) প্রতিষ্ঠাকালে দেশে পাটকল ছিল ৭৬টি। কিন্তু ধারাবাহিক লোকসানের কারণে একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয় মিলগুলো। এভাবে কমতে কমতে সবশেষ চলতি বছরের জুন পর্যন্ত দেশে মাত্র ২৫টি পাটকল চালু ছিল। অব্যাহত লোকসানের ভার বইতে না পেরে জুলাইয়ের ১ তারিখে সবগুলো পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠার ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছরই লোকসানে ছিল বিজেএমসির অধীন পাটকলগুলো। ২৪ হাজার ৮৮৬ জন স্থায়ী শ্রমিককে গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের (স্বেচ্ছা অবসরে) মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটগুলোর সলিল সমাধি হয়। বিজেএমসির অধীনে গত জুন পর্যন্ত চালু থাকা ২৫টির মধ্যে ২২টি ছিল পাটকল ও ৩টি নন জুট কারখানা। ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ পর্যন্ত পাঁচ অর্থবছরে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পাটকলগুলোর ২ হাজার ৯৩৩ কোটি টাকার লোকসানের পাশাপাশি পূঞ্জীভূত লোকসান দাঁড়ায় ১০ হাজার কোটি টাকায়। রাষ্ট্রমালিকানাধীন পাটগুলোর অব্যাহত লোকসানের বিপরীতে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর পাট ও পাটজাতদ্রব্য থেকে রপ্তানি আয় বেড়েই চলেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ প্রতিবেদন বলছে, ২০২০-২১ অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে পাট ও পাটজাতদ্রব্য রপ্তানি করে ৩০ কোটি ৭৫ লাখ ডলার আয় করেছে দেশ। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৪০ শতাংশ বেশি। আর লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এসেছে প্রায় ১২ শতাংশের মতো। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে পরিবেশের বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসায় বিশ্বে পাটপণ্যের চাহিদা নতুন করে বাড়তে শুরু করেছে। গত অর্থবছরে ৮৮ কোটি ২৩ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে সঙ্কটে পড়া চামড়া খাতকে (৭৯ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) পেছনে ফেলে তৈরি পোশাকের পরের স্থান দখল করে নিয়েছে পাটখাত। আর ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল ১০২ কোটি ডলার। আর পাট ও পাটজাতদ্রব্য রপ্তানি করে ৮১ কোটি ৬২ লাখ ডলার আয় হয়েছিল। সে হিসেবে এক বছরে চামড়ার রপ্তানি যতটা কমেছে, তার তুলনায় পাটের রপ্তানি বেড়েছে। এমনকী করোনাভাইরাসের কারণে গত অর্থবছরে তৈরি পোশাকসহ বড় সব খাতের রপ্তানি আয়ে ধস নামলেও পাট ও পাটজাত পণ্যের রপ্তানি আয়ে বরাবরই দেখা গেছে উল্টো চিত্র। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে চামড়া ও চামড়াজাতপণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছে ২২ কোটি ৫১ লাখ ডলার। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে আয় কমেছে ১১ দশমিক ৪৯ শতাংশ। অন্যদিকে এই তিন মাসে পাট ও পাটজাতদ্রব্য রপ্তানি করে আয় প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৯ দশমিক ২৬ শতাংশ।

ফলে বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোর ঈর্ষান্বিত সাফল্যের কারণেই সরকার বন্ধ করে দেওয়া পাটগুলোকে তাদের হাতে ছেড়ে দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর ফলে পাট তার হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা। শুরুতে পরীক্ষামূলকভাবে ৫টি পাটকল বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ১৫-২০ বছরের জন্য ভাড়ায় ইজারা দেওয়া হবে। এজন্য ৯ সদস্যের একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করেছে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের (বিজেএমসি) চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুর রউফ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আমরা বর্তমানে কাগজপত্র তৈরি করছি। এগুলো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রতিটি মিলসংক্রান্ত যেসব মামলা-মোকদ্দমা রয়েছে সেগুলোর সুরাহা করার বিষয় রয়েছে। আর তথ্য-উপাত্ত তৈরি করে মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটিকে দেওয়া হবে। কমিটি পর্যালোচনার পর যদি সঠিক মনে করে তাহলে আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেব। এসব কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকমাস সময় লাগতে পারে। এরপর ব্যবসায়ীদের সংক্ষিপ্ত তালিকা তৈরি করে তাদের কাছে প্রস্তাব দেওয়া হবে।’

পাটকল ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) নেতারা। তারা বলেন, জুট মিলগুলো খুলে দেওয়া সবার জন্যই মঙ্গলজনক। এর মাধ্যমে প্রতিযোগিতার বাজার সৃষ্টি হবে। পাটের নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনের পাশাপাশি প্রত্যেকেই বিশ্ববাজারে নতুন ক্রেতা ধরতে চেষ্টা চালাবেন। যার সুফল পাবে এখাত সংশ্লিষ্ট সবাই। তবে এক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদের একার পক্ষে এত বিপুল অর্থ যোগান দেওয়া সম্ভব হবেনা বলে জানান তারা। তাই বিজেএমসিকে সেটি মাথায় রেখেই নীতিমালা তৈরির বিষয়ে মত দিয়েছেন, বিজেএমএর চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, ‘সব সিদ্ধান্তই ঠিক আছে, তবে একটি বিষয়ে খটকা আছে। এই মিলগুলো কীভাবে অর্থায়ন করা হবে সেটি খোলাসা করা প্রয়োজন। সরকার নন-ফান্ডেট কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ভিন্ন পন্থায় কীভাবে অর্থায়ন করা যায় সেটি নির্ধারণ করা।’

মাহবুবুর রহমান বলেন, মিলগুলো যাতে কোনো একক ব্যক্তির হাতে ছেড়ে দেওয়া না হয় সেটি সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। একইসঙ্গে, যাদের পাটকল পরিচালনার অভিজ্ঞতা রয়েছে শুধুমাত্র তাদের হাতেই পাটকলগুলো দেওয়া উচিৎ বলে মনে করেন তিনি। তবে বিজেএমসি শুধুমাত্র পাটকল মালিকদের হাতে পাটকলগুলো দেওয়ার পক্ষে নয়। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোঃ আব্দুর রউফ জানান, ‘এরকম বাধ্যবাধকতা নেই। আমাদের সবকিছু মিলিয়ে চিন্তা করতে হবে যে কোনটা ভালো হবে। যদি শুধুমাত্র উৎপাদনকারীদের দেওয়া হয় তাহলে সীমিত সাড়া মিলতে পারে। টেক্সটাইল ব্যবসায়ী এবং জুট রপ্তানিকারকদেরও সুযোগ দিতে হবে, যাতে বেশি সাড়া পাওয়া যায়। সরকার ও বিনিয়োগকারী উভয়ের স্বার্থ বিবেচনা করেই নীতিমালা তৈরি করা হবে।’ তবে শুধু উৎপাদনকারীদের হাতেও যদি ইজারা দেওয়ার বিষয়টি আসে সেটিও সম্ভব বলে মনে করেন তিনি। সেক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে তাদের রাখার পাশাপাশি অন্যদেরও সুযোগ দেওয়া হতে পারে বলে জানান তিনি। বিনিয়োগকারীদের অর্থায়নের বিষয়ে বিজেএমসির চেয়ারম্যান জানান, ‘এটি নিয়ে এখনই খুব বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। যিনি ইনভেস্ট করবেন এটি তারই চিন্তা যে তিনি কীভাবে ইনভেস্ট করবেন।’ কোনো ইনভেস্টর পাওয়া যাবেনা বলে বিজেএমএর ব্যবসায়ীদের বক্তব্যের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এটি তখনই বলা যাবে যখন নীতিমালা তৈরি করে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হবে।’

বন্ধ পাটকল চালু ও বিজেএমসির অন্যান্য সম্পত্তির যথাযথ ব্যবহারের নিশ্চিতের জন্য পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজীকে প্রধান করে নীতিনির্ধারণী কমিটি গঠন করা হয়। সেই কমিটি একাধিক বৈঠক করে একটি প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ে পাঠায়। সেখান থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর গত মঙ্গলবার পাট মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) মোহাম্মদ আবুল কালামকে আহ্বায়ক করে ৯ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। আন্তঃমন্ত্রণালয় ওয়ার্কিং কমিটি নামের এই কমিটি বন্ধ পাটকল ভাড়াভিত্তিক ইজারা পদ্ধতিতে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় পুনরায় চালু করার বিষয়ে কাজ করবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads