• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯

আইন-আদালত

দুর্নীতিবাজরা কীভাবে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ নভেম্বর ২০২১

দেশে এতগুলো সংস্থা থাকতে দুর্নীতিবাজরা কীভাবে দেশ ত্যাগ করে পালিয়ে যায়, এমন প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট। সম্প্রতি সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের (এসবিএসি) সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান এস এম আমজাদ হোসেন দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন এমন সংবাদের বিষয়টি আদালতের নজরে আনা হলে আদালত এ মন্তব্য করে।

গতকাল রোববার বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি এস এম মজিবুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে দুদককে নির্দেশ দেয়।

সকালে বিষয়টি আদালতের নজরে আনেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। পরে আদালত দুদকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে এ মন্তব্য করে।

আদালতের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘আসামি দেশ ত্যাগ করে চলে গেল আর আপনারা নীরব দর্শক হয়ে দেখতেছেন। যেখানে দুদক আছে, বিএফআইইউ আছে, ডিবি আছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আছে, তারপরও সে কীভাবে পালিয়ে যায়।’

বিচারক বলেন, মামলা হয়েছে, নিষেধাজ্ঞা আছে ও তদন্তও হচ্ছে, তারপরও কীভাবে সে দেশ ত্যাগ করল?

এ সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ইয়েস মাই লর্ড, দুদকের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও সে কীভাবে চলে গেল। মাই লর্ড আমরা সব সময় ট্রান্সপারেন্ড, আমরা কাজ করছি।’ বিচারক বলেন, বুঝলাম তো আপনারা কাজ করতেছেন, তাহলে গেল কী করে। কী পদক্ষেপ নিলেন। সে কীভাবে দেশ ছাড়ল।

দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘এটা নিয়ে আমার অফিসের সঙ্গে কথা বলতে হবে। কথা না বলে কিছু বলতে পারব না।’

নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বিচারক বলেন, তাহলে এটা আমাদেরকে জানান, তার বিদেশ যেতে নিষেধাজ্ঞা ছিল কি না? আর নিষেধাজ্ঞা থেকে থাকলে সে গেল কীভাবে? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কী কাজ করল? তাকে কেন ধরতে পারল না?

এ সময় আদালতের কনিষ্ঠ বিচারক বলেন, আসামিরা যদি এভাবে পালানোর সুযোগ পেয়ে যায় তাহলে আমরা তো আর বিচারে থাকতে পারব না।

সিনিয়র বিচারক বলেন, কী কী মামলা করেছেন, কীভাবে ফ্রিজ করলেন, কীভাবে নিষেধাজ্ঞা হলো, কখন কীভাবে পালিয়ে গেল এগুলোর বিস্তারিত ইতিহাস আমাদেরকে জানাবেন। আমরা আগামীকাল আদেশ দেব।

বিচারক আরো বলেন, ‘হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়েছে এমন অভিযোগ থাকার পরও সে কীভাবে পালিয়ে যায়? তাহলে দুদক কী কাজ করল। বিএফআইইউ কী কাজ করল। কীভাবে এ ধরনের ঘটনাগুলো ঘটতেছে, এ বিষয়ে আমরা রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেলকেও শুনব।’

‘অনেক কাজ করতেছেন, এটা তো মুখে বললেই হবে না। কিন্তু পালানো থামাতে পারছি না। এটা তো একটা সিরিয়াস ম্যাটার,’ যোগ করেন বিচারক।

‘আমরা যদি এখন এসবের বিষয়ে লক্ষ না রাখি তাহলে তো দেশের টাকা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এটা সিরিয়াস ফিন্যানশিয়াল ক্রাইম। এ বিষয়ে আমাদের সিরিয়াস স্ট্যান্ড নেওয়া উচিত। দেশের টাকা দেশের বাইরে যাবে কেন।’

কনিষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘দেশের টাকা নিয়ে বিদেশে আরামছে বসবাস করবে আর দেশের অর্থনীতির বারটা বাজবে।’

জনগণের ঘাম ও শ্রমের টাকা। প্রবাসীরা কত কষ্ট করে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে। সেই টাকা যদি এভাবে বিদেশে পাচার হয়ে যায়, এটা তো মারাত্মক বিষয়।

এ সময় দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘ইমিগ্রেশনটা কীভাবে পার হলো এটা রাষ্ট্রপক্ষকে জানাতে বলেন। এটা জানা বেশি দরকার। ইমিগ্রেশন বলতে পারবে সাউথ বাংলার চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন কয়টায় গেলেন। বিমানে গেলেন নাকি স্থলপথে গেলেন এটা জানা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন পিকে হালদারের বিচারের আদেশ বিভিন্ন সংস্থার কাছে পৌঁছাতে তিন ঘণ্টা লেগেছিল।’

তখন বিচারক বলেন, ‘এখনকার যুগে কি তিন ঘণ্টা সময় লাগে আদেশ পৌঁছাতে। এটা এক মিনিটের ব্যাপার। কোর্টের আদেশ কমিনিউকেটেড করা এক মিনিটের ব্যাপার। তিন ঘণ্টা লাগবে কেন? কি আর বলবো। আমরা হতাশ।’

‘এটাতো আপনাদের অবহেলা।’

তখন দুদকের আইনজীবী বলেন, ‘এখানে দুদকের কোন অবহেলা নেই। অবহেলা ছিল পুলিশের।’

আদালত বলে, ‘ওকে আমরা দেখব। আমরা হতাশ হয়ে যাই। আমরা চাই আমাদের অর্থনীতি ভালো থাকুক। দেশের মানুষ উপকৃত হোক, দেশের উন্নয়ন হোক, মানুষ যাতে ডাল ভাত আনন্দের সঙ্গে খেতে পারে। এভাবে টাকা যদি বাইরে চলে যায় তাহলে দেশের মানুষ কীভাবে সুন্দর জীবন যাপন করবে। এগুলো আমাদের দেখতে হবে। এটা দেখা দুদকের প্রধান দায়িত্ব্। ওকে, কাল আদেশ দেব।’

এর আগে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাউথ বাংলা ব্যাংকের বিদায়ী চেয়ারম্যানের বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার প্রতিবেদন আদালতে উপস্থাপন করেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান এসএম আমজাদ হোসেন দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। স্থলসীমান্ত দিয়ে বুধবার ভারত হয়ে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন। তার সঙ্গে স্ত্রী সুফিয়া আমজাদ এবং মেয়ে তাজরির আমজাদও রয়েছেন।

আমজাদ হোসেনের দুর্নীতির কারণে সম্প্রতি তার সব ব্যাংক হিসাব জব্দ (অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ) করেন আদালত। এ ছাড়া সাউথ বাংলা ব্যাংকের চেয়ারম্যানের পদ থেকে তিনি সরে যেতে বাধ্য হন। বিদেশ যাওয়ার ক্ষেত্রে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্ট ব্যবহার করেছেন। এ ব্যাপারে জানতে আমজাদ হোসেনের বাংলাদেশি মোবাইল ফোন নম্বরে যোগাযোগ করা হলে তা বন্ধ পাওয়া যায়। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের মোবাইল ফোন নম্বরে ফোন দিলে পরিচয় দেয়ার পর তিনি ফোন সংযোগ কেটে দেন।

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গুলশান আনোয়ার প্রধান যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। তিনি বলেন, আমজাদের পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি তিনি জানেন না।

ফাইন্যানসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- চার দেশে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচার করেছেন আমজাদ হোসেন। আমেরিকা, রাশিয়া, সিঙ্গাপুর ও ভারতে একাধিক বাড়ি, গাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তিনি। পাচার করা বিপুল অঙ্কের অর্থে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে প্রাসাদ গড়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে নামে-বেনামে দেশ-বিদেশে বিভিন্ন কোম্পানি খুলে তিনি টাকা সরিয়েছেন। সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংকের খুলনা সদর ও কাটাখালী শাখা ব্যবহার করে আমদানি-রপ্তানি ও ঋণের আড়ালে নানা দুর্নীতি, অনিয়ম, জালিয়াতির মাধ্যমে আমানতকারীদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন আমজাদ হোসেন।

আমজাদ হোসেনের বিরুদ্ধে দুদকে নতুন করে আরও ৮২৯ কোটি টাকা জালিয়াতির তথ্য মিলেছে। এর কিছু দিন আগে আরও ৪৩০ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ ছিল। এর অনুসন্ধানও শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে তার জালিয়াতি করা অর্থের পরিমাণ দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।

এর মধ্যে ৯ কর্মচারীর নামে তার ২৫ কোটি টাকা ঋণ তুলে আত্মসাতের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচারের সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পর আমজাদ ও তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৯৩৫টি ব্যাংক হিসাব জব্দের (ফ্রিজ) আদেশ দেয় আদালত।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads