• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
খুনীদের সর্বোচ্চ সাজা চায় পরিবার

সংগৃহীত ছবি

আইন-আদালত

সিনহা হত্যা মামলার রায় আজ

খুনীদের সর্বোচ্চ সাজা চায় পরিবার

  • মাহাবুবুর রহমান, কক্সবাজার
  • প্রকাশিত ৩১ জানুয়ারি ২০২২

সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান হত্যা মামলায় প্রধান দুই অভিযুক্ত বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী ও টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ দাশের সর্বোচ্চ ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা চায় পরিবার। এছাড়াও অন্য আসামিদের তাদের অপরাধের ভিত্তিতে সাজা হবে বলে প্রত্যাশা করেছেন সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস। গতকাল রোববার কক্সবাজারের স্থানীয় সাংবাদিকদের দেওয়া এক বক্তব্যে তিনি বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে একই সাথে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডও বন্ধ হবে বলেও আমি আশা করি।  অপরাধী যেই হোক না কেন, অপরাধ করলে কেউ আইন-এর হাত থেকে ও সাজা পাবার হাত থেকে রেহাই পাবে না-এই রায়ের মাধ্যমে সেটি ও প্রতিষ্ঠিত হবে বলেই আমাদের প্রত্যাশা।

বহুল আলোচিত এ মামলাটির রায় ঘোষণা করা হবে আজ সোমবার। কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাঈল এ রায় ঘোষণা করবেন।

রাষ্ট্রপক্ষের কৌসুঁলি ফরিদুল আলম বলেন, আমরা অভিযোগ প্রমাণ করতে পেরেছি। ষড়যন্ত্রমূলকভাবে, পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়েছে বিধায় আমরা আদালতে আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছি। পুলিশি আবরণে, আইনি আবরণে এরকম নিষ্ঠুর ঘটনা যাতে আর না ঘটে, যেন আইনের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধা থাকে।

আসামি পক্ষে মহিউদ্দিন খান বলেছেন, আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণে বাদীপক্ষ ব্যর্থ হয়েছে। আমরা চাই এই মামলায় ন্যায়বিচার নিশ্চিত হোক।

২০২০ সালের ৩১ জুলাই ঈদুল আজহার আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর এপিবিএন চেকপোস্টে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীর গুলিতে নিহত হন অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

হত্যাকাণ্ডের চারদিন পর ২০২০ সালের ৫ আগস্ট সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে টেকনাফ থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের আদালতে।

মামলায় প্রধান আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত  কর্মকর্তা পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। ওসি (বরখাস্ত) প্রদীপ কুমার দাশকে করা হয় দুই নম্বর আসামি। মামলার তিন নম্বর আসামি করা হয় বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রে কর্মরত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিতকে। আদালত মামলাটির তদন্তভার দেন কক্সবাজারের র‍্যাব-১৫কে। ৭ আগস্ট মামলার আসামি সাত পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। পরে তদন্তে নেমে হত্যার ঘটনায় স্থানীয় তিন বাসিন্দা, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) তিন সদস্য ও ওসি প্রদীপের দেহরক্ষীসহ আরো মোট সাতজনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। এরপর গত ২৪ জুন মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের আদালতে আত্মসমর্পণের মাধ্যমে আলোচিত এই মামলার ১৫ আসামির সবাই আইনের আওতায় আসে।

এ মামলায় চার মাসের বেশি সময় তদন্ত শেষে গত বছরের ১৩ ডিসেম্বর ৮৩ জন সাক্ষীসহ অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা র‍্যাব-১৫ এর জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ খায়রুল ইসলাম। ১৫ জনকে আসামি করে দায়ের করা অভিযোগপত্রে সিনহা হত্যাকাণ্ডকে একটি ‘পরিকল্পিত ঘটনা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

মামলায় বর্তমানে কারাগারে থাকা ১৫ আসামি হলেন-বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের তৎকালীন পরিদর্শক লিয়াকত আলী, টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দদুলাল রক্ষিত, বরখাস্ত সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, বরখাস্ত কনস্টেবল ছাফানুল করিম, বরখাস্ত কনস্টেবল কামাল হোসাইন আজাদ, আব্দুল্লাহ আল মামুন, কনস্টেবল রুবেল শর্মা ও কনস্টেবল সাগর দেব, বরখাস্ত এপিবিএনের উপ-পরিদর্শক (এসআই) শাহজাহান আলী, বরখাস্ত কনস্টেবল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ, ও  মো. রাজীব হোসেন, টেকনাফ থানায় পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুরের মারিশবুনিয়া গ্রামের নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আইয়াজ ও মো. নেজামুদ্দিন।

সাক্ষী হাফেজ মো. আমিন কী বলছেন? :  মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফের শামলাপুর চেকপোস্ট। যার নিকটেই অবস্থিত বায়তুননুর জামে মসজিদ। ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে মসজিদের ছাদে অবস্থান করছিলেন মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. আমিন।

সিনহার বোনের দায়ের করা হত্যা মামলায় র্যাবের দাখিল করা অভিযোগ পত্রের অন্যতম সাক্ষী তিনি। আদালতে সাক্ষ্যও প্রদান করেছেন। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খানকে গুলি করার শুরু থেকে তিনি ঘটনা প্রত্যক্ষ করছেন। ঘটনার পর ওসি প্রদীপের ঘটনাস্থলে আসা, পা দিয়ে গুলিবিদ্ধ সিনহার গলায় চাপ দেওয়া, পিকআপ করে মৃতদেহ হাসপাতালে প্রেরণসহ সব কথাই বলেছেন হাফেজ আমিন।

তিনি বলেছেন, ১ আগস্ট ছিল কোরবানির ঈদ। ঈদের জামাত, পশু কুরবানির বিষয়ে কেন্দ্রীয় মসজিদের মাইকিং-এর ঘোষণা শুনতে তিনিসহ কয়েকজন শিক্ষার্থী মসজিদের ছাদে অবস্থান করছিলেন। ওই সময় এপিবিএন এ চেকপোস্টে উচ্চস্বরে কথা শুনলে ওইদিকে দৃষ্টি দেন।

ওই সময় দেখা যায়, সিলভার রঙের একটি কার গাড়ির সামনে শামলাপুর ফাঁড়ির ইন্সপেক্টর লিয়াকত পিস্তল তাক করে দাঁড়িয়ে আছেন। পাশে ব্যারিকেড দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এসআই নন্দ দুলাল। পূর্বে একজন এবং পশ্চিমে ২ জন এপিবিএন সদস্য দাঁড়ানো ছিলেন।

হাফেজ আমিন জানান, তখন লিয়াকত চিৎকার করে গাড়ি থেকে বের হওয়ার নির্দেশ দিলে গাড়ির পশ্চিম পাশ থেকে ২ হাত ওপরে তুলে লম্বা চুল থাকা এক যুবক বের হন। লিয়াকতের নির্দেশ পেয়ে এপিবিএন এর ২ সদস্য ওই যুবককে ২ হাত ধরে রাখে। লিয়াকত আবারো চিৎকার দিয়ে গাড়িতে থাকা ব্যক্তিকে বের হওয়ার জন্য বলেন।  এরপর গাড়ির ড্রাইভিং সিটে থাকা ব্যক্তি হাত ওপরে তুলে গাড়ি থেকে বের হন এবং লিয়াকতের দিকে সামনে একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ান। মুহূর্তেই কোনো কথা না বলে লিয়াকত পর পর ২টা গুলি করেন। গুলিবিদ্ধ হয়ে ওই ব্যক্তি সামনের দিকে হেলে মাটিতে পড়ে গেলেও লিয়াকত সামনে এসে আবারো ২ রাউন্ড গুলি করেন বলে জানান তিনি।

তিনি জানান, গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটে পড়া ব্যক্তিকে লিয়াকতের নিদের্শ মতে, নন্দ দুলাল হ্যান্ডকাপ পরিয়ে দেন এবং লম্বা চুলের ব্যক্তিকে হ্যান্ডকাপ পড়ানোর জন্য বলা হলে এপিবিএন এর ২ সদস্য তাদের কাছে হ্যান্ডকাপ না থাকার কথা লিয়াকতকে জানান। এতে লিয়াকত ক্ষুব্দ হয়ে এপিবিএন সদস্যদের গালিগালাজ করেন। এসময় পূর্ব পাশে থাকা এপিবিএন-এর অপর সদস্য শামলাপুর লামার বাজার দিকে গিয়ে রশি নিয়ে আসেন এবং চুল লম্বা ব্যক্তির হাত পেছনে দিয়ে বেঁধে বসিয়ে রাখেন।

এরপর মুঠোফোনে লিয়াকত ব্যস্ত হয়ে উঠেন বলে জানিয়ে হাফেজ আমিন জানান, প্রথম ফোনে কাউকে ঘটনাস্থলে আসার জন্য বলেন। এরপর অপর একজনকে জানান একজন শেষ অপরজন আটক রয়েছে বলে অবহিত করেন। তার অল্প সময়ের মধ্যে সিভিল পোশাকে ৪ জন ব্যক্তি সিএনজিযোগে ঘটনাস্থলে আসেন।

এসময় টেকনাফ থেকে আসা মিনি পিকআপ শামলাপুর বাজারে যাওয়ার সময় আটকে এপিবিএন-এর চেকপোস্টে এনে রাখা হয়। এরপর গাড়ি তল্লাশি চালান সিভিল পোশাকে আসা ৪ জনের ২ জন। তল্লাশি শেষে তারা একটি পিস্তল, কিছু কাগজপত্র এবং ক্যামেরা পাওয়ার কথা লিয়াকতকে জানান। এরপরেই টেকনাফ থেকে ২টি গাড়িযোগে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নেতৃত্বে পুলিশ।

ওসি প্রদীপ যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছেন তখনো গুলিবিদ্ধ ব্যক্তি জীবিত ছিলেন বলে জানান আমিন।

আমিন জানান, প্রদীপ ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রথমে লিয়াকতের সাথে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলেন। তারপর তোকে অনেক দিনের টার্গেট ছিল, আজ শেষ করতে পেরেছি বলতে বলতে এগিয়ে যান গুলিবিদ্ধ ব্যক্তির দিকে। গিয়ে প্রদীপ পা দিয়ে ওই ব্যক্তিকে চাপ দেন।

এসময় ওই ব্যক্তি কিছু একটা বললে প্রদীপ বলেন ‘তোকে গুলি করেছি কি পানি দেওয়ার জন্য? মেরে ফেলার জন্য মারা হয়েছে।’ এরপর ওই ব্যক্তির বাম পাশে জোরে জোরে ২ টা লাথি মারেন এবং পা দিয়ে গলায় আবারো চাপ দিয়ে রাখেন প্রদীপ। এরপরই ফোনে কারো সাথে কথা বলেন প্রদীপ। কথা শেষ করে বলেন, সাগর-রুবেল গাড়ি তল্লাশি করো। ২ জন এগিয়ে এসে গাড়ির পাশে এসে একজন জানান, স্যার গাঁজা, ইয়াবা পাওয়া গেছে। এরপর ৪ জন এসে মাটিতে লুটে থাকা ব্যক্তিকে হাত-পা ধরে মিনি পিকআপে খুব জোরে ছুড়ে দেন। পিকআপটি কক্সবাজারের দিকে চলে যান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads