• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

সংস্কৃতির চর্চা

  • যতীন সরকার
  • প্রকাশিত ০৭ অক্টোবর ২০১৮

ব্যাকরণশাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, ‘যে কোনো ধাতু বা ক্রিয়ামূলের আগে উপসর্গ বসালে ধাতুর মূল অর্থটি অন্যত্র নীত হয়।’ অর্থাৎ উপসর্গযোগে শব্দের অর্থ বদলে যায়, এমনকি বিপরীতার্থকও হয়ে যায়। যেমন—‘জয়’ শব্দটির আগে ‘পরা’ উপসর্গ লাগালে হয় ‘পরাজয়’। উপসর্গ সম্পর্কে নানা কথা ভাবতে ভাবতেই সংস্কৃতি আর অপসংস্কৃতির কথা আমার মাথায় এসে গেল।

সংস্কৃত ভাষার ‘অপ’ উপসর্গটি হলো সকল অপকর্মের কর্তা— সকল কিছুর অর্থকেই উল্টে দেয়, অনেক কিছুকে অর্থহীনও করে ফেলে। ‘সংস্কৃতি’র পূর্বেও ‘অপ’ উপসর্গ যোগ করলে তা আর কোনোমতেই সংস্কৃতি থাকে না, হয়ে যায় সংস্কৃতিঘাতক। তাই বলতেই হবে যে, ‘সংস্কৃতিহীনতা’ই ‘অপসংস্কৃতি’ শব্দটির আসল অর্থ।

কিন্তু কোনটি সংস্কৃতি আর কোনটি অপসংস্কৃতি, সবসময় তা সহজে নির্ণয় করা যায় না। এককালে বা এক দেশে যা সংস্কৃতি, অন্যকালে বা অন্য দেশে তা-ই হয়ে যায় অপসংস্কৃতি। আবার একই কালে ও দেশেও পরস্পরবিরোধী স্বার্থের শ্রেণিসমূহের মধ্যে সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির এ রকম বিভাজন দেখা দেয়। আর্থ-সামাজিক বিভেদ থেকেই ঘটে এই বিভাজন। তাই, অপসংস্কৃতির প্রকৃত অর্থ জানতে হলেও অর্থনীতির দ্বারস্থ না হয়ে উপায় থাকে না।

সংস্কৃতি কথাটির মূলে আছে সংস্কার। আবার, সংস্কার শব্দটিও একাধিক অর্থের দ্যোতক। তবে প্রথমেই বলতে হয় : কোনো কিছুর পূর্বতন অবস্থার বদল ঘটিয়ে নতুন করে তোলার নামই সংস্কার। এই সংস্কার থেকেই সংস্কৃতি। প্রকৃতিকে সংস্কার করে যা করা হয় তা-ই সংস্কৃতি। মানুষই প্রতিনিয়ত প্রকৃতিকে সংস্কারের মধ্য দিয়ে নবায়িত করে তোলে; পশু তেমনটি পারে না। তাই মানুষেরই সংস্কৃতি আছে, পশুর নেই। বহিঃপ্রকৃতিকে সংস্কার করে মানুষ যা করে, তা-ই বস্তুগত সংস্কৃতি; আর মানুষের অন্তঃপ্রকৃতির সংস্কারের মধ্য দিয়েই গড়ে ওঠে ভাবগত সংস্কৃতি। এর সঙ্গেই যুক্ত রয়েছে লোকসংস্কৃতি।

পৃথিবীর সব মানুষের এই যে লোকসংস্কৃতি, সেই দেশের উপযোগী সংস্কৃতি এটা। আমাদের দেশের লোকসংস্কৃতি তো অবশ্যই সমৃদ্ধিশালী এবং অসামান্য সমৃদ্ধিশালী। লোকসংস্কৃতি হচ্ছে একটা জাতির প্রকৃত সংস্কৃতি। সব সংস্কৃতির উৎস মূলই হচ্ছে লোকসাধারণ বা মানুষ। কাজেই তাই যদি হয়, তাহলে লোকসংস্কৃতির বাইরে অন্য সংস্কৃতির কথা বলা তো অর্থহীন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। সব সংস্কৃতির উৎসমূল যেহেতু লোকসংস্কৃতি, সেহেতু লোকসংস্কৃতি চর্চার গুরুত্বের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

কিন্তু ইদানীং লোকসংস্কৃতি বা ফোকলোরের আলোচনায় পাশ্চাত্য প্রভাব অত্যন্ত বেশি, প্রভাবটা যে একেবারে খারাপ সে কথা আমি বলি না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে পাশ্চাত্যের ধনতান্ত্রিক দুনিয়া, পাশ্চাত্যের সব সংস্কৃতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে একটা পক্ষপাতিত্ব বা খণ্ডত্ব বিদ্যমান। কাজেই আমি মনে করি, প্রকৃত প্রস্তাবে সংস্কৃতিবিষয়ক যেকোনো বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে যে দৃষ্টিভঙ্গিটা অবলম্বন করা উচিত সেটাকে অবশ্যই হতে হবে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এখন সেই দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে ঠিক কী রকম আলোচনা করা উচিত এবং সঙ্গত বলে আমার ধারণা, সেই রকম আলোচনা আমাদের দেশে খুব কমই হচ্ছে বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে ওই আমেরিকান ফোকলোরবিদদের চিন্তা-চর্চার প্রচলন অনেক বেশি এবং সেই ধারা ধরেই আমাদের ফোকলোরবিদ যারা আছেন তারা আলোচনা করতে চান।

তথাগত আলোচনা বা বিশ্লেষণের বাইরে যদি দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ভিত্তিতে লোকসংস্কৃতি তথা ফোকলোর আলোচনা করতে হয়, তাহলে আমি বলব, ব্রিটিশ দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বিশ্লেষক Christopher Caudwell-‰i Illusion and Reality বইটিকে আমাদের দেশের ফোকলোর আলোচনার উৎস হিসেবে বিবেচনা করা দরকার। কিন্তু আমার তো মনে হয় এই বইটিতে ক্রিস্টোফার কডওয়েল কবিতার উৎপত্তি সম্পর্কে যে সমৃদ্ধ আলোচনা করেছেন তার মধ্যেই আমরা ফোকলোর আলোচনার প্রকৃত দিশা পেয়ে যেতে পারি এবং তাকে অনুসরণ করেই পরবর্তীকালে জর্জ টমসন যে আলোচনা করেছেন সেগুলো আমাদের ফোকলোর আলোচনার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে বলে আমার ধারণা। কাজেই আমাদের যারা ফোকলোরবিদ আছেন তাদের এই দিকে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বলেও মনে করি। বাঙালির মধ্যে যারা ফোকলোরবিদ হিসাবে খ্যাত তাদের বাইরে প্রকৃত ফোকলোরবিদ হিসেবে আমি বলব দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কথা। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘লোকায়ত দর্শন’ বইটির প্রথমেই জর্জ টমসনের সঙ্গে তিনি যে আলোচনা করেছেন সে কথাগুলো বিবৃত করেছেন এবং জর্জ টমসনের কাছ থেকে অনুপ্রেরণা পেয়েই বলা যেতে পারে, লোকায়ত দর্শনকে নতুন দৃষ্টিতে তিনি দেখতে পেয়েছেন। কাজেই এই ‘লোকায়ত দর্শন’ গ্রন্থটিতে অভিব্যক্ত এবং তারপর আরো অন্যান্য বইয়ের মধ্যে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় যে আলোচনাগুলো করেছেন সেগুলো আমাদের ফোকলোর আলোচনার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান বলে আমি মনে করি। আমাদের দেশে যদি যথার্থ অর্থেই ফোকলোরের বিশ্লেষণ করতে হয়, তাহলে ক্রিস্টোফার কডওয়েল, জর্জ টমসন এবং দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের আলোচনাকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া উচিত।

এবার বস্তুগত সংস্কৃতির কথাই বলি। বস্তুজগতে তথা প্রকৃতিতে জন্মায় গাছ, সেই গাছের প্রাচুর্যে একসময় পৃথিবী ছিল ঘন বনসমাকীর্ণ। মানুষ সেই বন কেটে বসত গড়েছে, গাছ কেটে তক্তা বানিয়েছে ও তক্তা দিয়ে বানিয়েছে ঘর তৈরির নানা সরঞ্জাম ও আসবাবপত্র। তক্তা বানানো, ঘর বানানো, আসবাবপত্র বানানো মানে প্রকৃতিজাত গাছের সংস্কার করা। প্রকৃতির এ রকম আরো আরো সংস্কারের ভেতর দিয়েই গড়ে উঠেছে তার বস্তুগত সংস্কৃতি। তবে এ প্রসঙ্গেই মনে রাখা উচিত : শুধু গাছ নয়, প্রকৃতির আরো অনেক কিছুর সংস্কার করেই গঠিত ও বিবর্তিত হয়েছে এ যাবৎকালের মানুষের সংস্কৃতি। কিন্তু সংস্কৃতির উৎস ও উপাদান যে প্রকৃতি, সেই প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় সংস্কৃতির স্বার্থেই। প্রকৃতিকে সংহার করলে সংস্কৃতিসংহারেরই আয়োজন করা হয়। সংহার আর সংস্কার এক নয়। বর্তমান পৃথিবীতে প্রকৃতির এই সংহার-প্রক্রিয়া অত্যন্ত ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। এই প্রকৃতি সংহার তথা পরিবেশ বিপর্যয় ঘটানোর ফলে যা হচ্ছে তা-ও আসলে সংস্কৃতিসংহার বা অপসংস্কৃতি। এ রকম সংহারকার্য ঘটাচ্ছে যারা, তাদের সঠিকভাবেই চিনে না নিয়ে ও তাদের প্রতি ক্ষমাহীন না হয়ে, পৃথিবী থেকে অপসংস্কৃতির উৎসাদন ঘটানো যাবে না।

এখানে এসে যায় ভাবগত সংস্কৃতির কথা। প্রকৃতিকে সংস্কার করে মানুষ তৈরি করে যে বস্তুগত সংস্কৃতি, সেই বস্তুগত সংস্কৃতির ক্রমোন্নতিই মানুষের জীবনযাত্রাকে উন্নত থেকে উন্নততর করে তুলতে থাকে। সেই উন্নত জীবনযাত্রা মানুষের ভাবের জগতে যে উন্নতি ঘটায় তা থেকেই তার ভাবগত সংস্কৃতির উদ্ভব, বিকাশ ও ক্রমোন্নতি ঘটে চলে। ভাবের ক্ষেত্রে সংস্কার ঘটিয়েই তৈরি হয় মানুষের ভাবগত সংস্কৃতি।

ভাবগত সংস্কৃতির প্রসঙ্গেই ‘সংস্কার’ কথাটির অন্যতর অর্থের দিকে দৃষ্টি দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। ভাবের জগতে মানুষ যে সংস্কার ঘটায়, তাতে মানুষের ভেতরে বিশেষ কতকগুলো ধারণা শিকড় গেড়ে বসে। এ রকম ধারণাসমূহেরই আরেক নাম ‘সংস্কার’। এই সংস্কারও মানুষের সংস্কৃতি গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেসব সংস্কার মানুষের চৈতন্যে শুভ ফলদায়ক, সেসব সংস্কারকেই বলে মানবিক মূল্যবোধ। এ রকম মূল্যবোধের ধারক ও রক্ষক মানুষেরা সমাজে সংস্কৃতিমান রূপে নন্দিত হয়। আর মূল্যবোধহীন মানুষ হয় নিন্দিত, তেমন মানুষদের কেউই সংস্কৃতিমান রূপে গণ্য হয় না। কিন্তু সব সংস্কারই মূল্যবোধের পর্যায়ভুক্ত নয়। অনেক মানুষের ভেতরেই এমন অনেক সংস্কারের অবস্থান থাকে— যেগুলো তাদের চিন্তাকে কুয়াশাচ্ছন্ন করে রাখে, যেগুলোর অপ-প্রভাবে তাদের বুদ্ধি আবদ্ধ হয়ে থাকে।

আমরা জাতি হিসেবে সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এই জাতির হাজার বছরের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। জাতির উত্তরাধিকার হিসেবে এই সংস্কৃতির মূল ধারা রক্ষা করা আমাদের সবার দায়িত্ব। কারণ স্বাধীনতাসহ জাতির যা কিছু অর্জন তার পেছনে এই সংস্কৃতির মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। আর স্বাধীনতা রক্ষা করতেও জাতির মূলধারার সংস্কৃতির প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। তবে বিশ্ব সংস্কৃতির যা কিছু ভালো তাও গ্রহণ করতে হবে। তবেই বিশ্ব সংস্কৃতির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলেয়ে জাতি এগিয়ে যাবে। ৎপ্রাবন্ধিকপ্রাবন্ধিক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads