• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

সাহিত্য

গণক ও আরেফিন

  • মোহাম্মদ অয়েজুল হক
  • প্রকাশিত ১০ নভেম্বর ২০১৮

ঢাকা শহরে এসে নতুন একটা জিনিস লক্ষ করে আরেফিন। মোড়ে মোড়ে ক্যানভাসার, গণক। প্রথমদিনের অভিজ্ঞতা সুখকর না হওয়ায় একটা খারাপ ধারণা জন্মেছে এ শহরের প্রতি। তখন ক্লাস টেনে। স্কুলে যেতে চোখে পড়ে মানুষের জটলা। একজন মানুষ কাপড় বিছিয়ে বেশকিছু গাছ-গাছড়া নিয়ে বসে আছে। একজন বক্তা অন্য সবাই শ্রোতা। আমি ব্যবসা করতে আসিনি। দুই যুগ ধরে এখানে তাবিজ দিই। এই যে গাছ-গাছড়া, শেকড়, পাথর। স্বপ্নে পাওয়া। বাবা বলে গেছেন কানে কানে। এ পাথরে কী উপকার? শেকড়ে কী হবে? এই যে কে আছেন আমার পাথর থেকে উপকার পাননি। কিছুটা ধমক ও চ্যালেঞ্জের সুর। সবাই নীরব, স্তব্ধ। একটু দম নিয়ে হাঁক দেন, আমার পাথরে উপকার পেয়েছেন একজন থাকলে একটু হাত উঁচু করবেন। জীবনে বহু টাকা অপচয় করেছেন। এ ডাক্তার সে ডাক্তার করে জীবন শেষ করে ফেলেছেন। গ্যাস্ট্রিক, আলসার, অর্শ, পাইলস, বাত ব্যথা, প্রেমে ব্যর্থতা...

একজন হাত উঁচু করেন। এই যে পেয়েছি। আসেন বাবা। লোকটা কাছে আসে। উপকার পেয়েছেন? লোকটা ঘাড় নাড়ে। জি।

- কী উপকার?

- আমার বাতের ব্যারাম ছিল। ডাক্তার দেখাতে দেখাতে ফতুর। উঠতে পারতাম না। সংসারে অশান্তি। আপনার দেখা পেয়ে শেকড় নিলাম। ব্যথা পাখি হয়ে উড়ে গেল।

- আমার যোগ্যতা নেই। পাথর, শেকড় বাবা।

আরেকজন হাত উঁচু করে। একইভাবে তিনিও জানান পায়খানা করতে গেলে তার কষ্টের কথা। রক্ত বের হতো। অনেক সময় পার হলেও ক্লিয়ার মলত্যাগ হতো না। শেকড় ব্যবহার করার পর এখন আর টয়লেট পর্যন্ত যেতে হয় না...

মতি মামার কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ আছে। বাথরুমে গেলে আর বেরোতে চান না। প্রথমদিকে মাঝেমধ্যে দরজায় খুটখুট শব্দ করে বলত, মামা বালিশ দিতে হবে নাকি! মতি মামা ভেতর থেকে চিৎকার দিতেন, কষ্টকর অবস্থা ভাগ্নে। মতি মামার চার বছরের ছোট ছেলেটা হাগুমুতু করে সারা বাড়ি দুর্গন্ধময় করে তুললেও মামি অসহায়, এতিমের মতো বাথরুমের দরজার দিকে চেয়ে থাকেন। দশ বছর এ মতি মামাই তাকে আগলে রেখেছেন আপন করে। মনে মনে ভাবে ব্যারাম কোথায় পালাবে! মতি মামাও বাথরুম পর্যন্ত যেতে পারবেন না।

আরো কয়েকজন হাত উঁচু করে। লোকটা থামিয়ে দেয়। আর দরকার নেই। মানুষের উপকার করতে পেরেছি বলেই যুগ যুগ ধরে মানুষের ভালোবাসায় আজো আছি। ...এরপর শুরু হয় জাদু। সামনে কিছু ছোট পাথর, দুইপাশে দুটি শেকড়। একটা সাদা কাগজ হাতে নিয়ে সবার কাছে প্রশ্ন ছোড়েন, আমার হাতে কী! মানুষের ঝাঁক উত্তর দেয়, কাগজ। পকেটের কাপড় বের করে দেখান। পকেটে কিছু নেই। হাত পকেটে ঢোকান, মুঠ পাকিয়ে বের করেন। গম্ভীর গলায় বলতে শুরু করেন, পাথর ও শেকড় মিনতি তোর কাছে, সব রোগ যেমন উড়ে যায় পাখির মতো তেমনি কাগজটাকে পাখি বানিয়ে দে। গুরু তুমি আসো। হাত খোলেন। একটা পাখি কিচকিচ করে ডেকে ওঠে। মুগ্ধতা নিয়ে আরেফিন তাকিয়ে থাকে। তার ভাবনায় দোলা দেয় এত ডাক্তার, হাসপাতাল আর ক্লিনিকের কী প্রয়োজন! ধ্যান ভাঙে লোকটার ডাকে, এদিক আয় বাবা। আরেফিন চমকে ওঠে। দেখি তোর হাতটা দেখি। আরেফিন হাতটা বাড়ায়। লোকটা হড়হড় করে বলতে থাকে, খুব অভিমানী, খুব সৎ। মানুষকে ভালোবাসিস কিন্তু মানুষগুলো তোকে কষ্ট দেয়। তোর ভাগ্যরেখা ভালো। বিদেশ গমন। প্রাচুর্য আর ধন ছুটে আসবে কিন্তু...

- কিন্তু কী!

- মাঝখানে বড় এক বাধা। ঝড়। মৃত্যু হতে পারে।

চমকে ওঠে আরেফিন। ওরে বাবা মৃত্যু! নিজের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, তাহলে?

- দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। নিজের ছেলের মতো মনে করে তোকে একটা আংটি দিয়ে দিলাম। সবসময় সাথে রাখবি। আরেফিনের হাতে আংটি পরিয়ে দেয় গণক। মাঝখানে একটা পাথর চিকচিক করে।

- এ পাথরই তোকে বাঁচাবে। দে একশ টাকা দে।

তিন মাসের স্কুলের বেতন বাবদ পকেটে তিনশ টাকা। আরেফিন বের করে। একশ টাকা দিয়ে বলে, আমার মামার খুব কোষ্টকাঠিন্য।

— তাই নাকি! কিছুক্ষণ কী ভেবে, কয়েকটা শেকড় বের করে আরেফিনের হাতে দেয়। ভিজিয়ে প্রতিদিন সকালে বাসি পেটে খেতে হবে। এক সপ্তাহ। একটা শেকড় মাজায় বাঁধতে হবে। কোথায় যাবে কোষ্ঠকাঠিন্য! পাখির মতো। দুইশ টাকা দে। মামা তো কত টাকা ব্যয় করেছেন। কিছু না ভেবেই পকেটের বাকি দুইশ টাকা গণকের হাতে তুলে দেয়। বিকালের দিকে বাসায় ফেরে। মামার অপেক্ষায় বসে থাকা। মামা যখন বেশ রাতে বাড়ি ফেরেন, আরেফিন ছুটে যায়।

- আরে মামা, তোমার আর বাথরুমে বসে কষ্ট সহ্য করতে হবে না।

- কেন কী হয়েছে? অবাক হন মাঝবয়সী ভদ্রলোক।

আরেফিন শেকড় দুটি মেলে ধরে। একটা পানিতে ভিজিয়ে এক সপ্তাহ খালি পেটে খাবে। আরেকটা মাজায় বেঁধে রাখবে। কোথায় যাবে কোষ্ঠকাঠিন্য!

মামার মুখে খুশির আভা স্পষ্ট হয়। বিপত্তি ঘটে দু’দিন পর। ঘুম ভাঙার পর থেকে মামা শুধু টয়লেটে যাচ্ছেন। আজ বেশিক্ষণ অবস্থান করতে পারছেন না। সামান্য পর ঘেমে নেয়ে দৌড়ে বের হন। আবার যান, আবার বের হন। ছয়, সাত, আটবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখে আরেফিন ছুটে গিয়ে প্রশ্ন করে, কী হয়েছে মামা?

- কী আর হবে! সব ওষুধ বন্ধ করে শেকড় খাওয়া, বাঁধা...

- উড়ে গেছে! পাখির মতো...

মামা ধমকের সুরে বলেন, রাখ তোর বাজে কথা, গত দু’দিন ধরে...

আরেফিন হাসে। মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, জানতামই তো। তুমি টয়লেটে বসে থাকতে পারবে না। অবশ্য ভাগ্য ভালো, যাওয়ার আগেই যে হয়ে যাচ্ছে না, মামির কষ্ট কমেছে। মামা আবার টয়লেটের দিকে দৌড় দেন। আবার বের হন। কিছুক্ষণ পর চিৎকার। মামি বুঝতে পেরে ফার্মেসি থেকে তিনটা ডুস এনে পুশ করায় সে যাত্রায় রক্ষা পান মামা। গণকের ওপর তীব্র ক্ষোভ, রাগ থেকে সালা গণকটাকে খুঁজে বেড়ায়। অনেকবার, অনেকদিন খুঁজেও আর গণককে পাওয়া যায় না।

অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। চাকরির ভাইভার জন্য স্কুলের কাগজপত্রগুলো নাড়াচাড়া করতেই চোখে পড়ে একটা ভিজিটিং কার্ড। জগদ্বিখ্যাত গণক ও কবিরাজ বাবা জহিরুল পান্না। নিচে ছোট করে দেওয়া মোবাইল নাম্বার। উফ্, এত বছর পর! নিজের ওপর রাগ হয় আরেফিনের। তার বিদেশ যাওয়া হয়নি। ধনদৌলত সেটাও ছুটে আসেনি। কোষ্ঠকাঠিন্যে মতি মামা ভালো হবে কি, প্রায় মরেই যাচ্ছিলেন। ফোন করে আরেফিন।

- হ্যালো।

- হ্যাঁ, কে বলছেন? গণকরাজ জহিরুল পান্না?

- না, তিনি তো অনেক বছর আগেই কোষ্ঠকাঠিন্যে মারা গেছেন।

আরেফিনের কেন যেন হাসি আসে। কিছুটা দুঃখও থাকে সে হাসিতে। ৎ

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads