• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯
চর্যাগীতির সন্ধানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

সংগৃহীত ছবি

সাহিত্য

চর্যাগীতির সন্ধানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী

  • কামাল আহমেদ
  • প্রকাশিত ১২ ডিসেম্বর ২০২০

আজ থেকে শতাধিক কাল আগেও আমরা আমাদের ভাষাগত পরিচয়ের উৎস নিয়ে অন্ধকারে ছিলাম। একমাত্র হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর কল্যাণেই গৌরবের সঙ্গে বিশ্বকে আমাদের ভাষাগত প্রাচীনত্বের অবস্থান জানাতে পেরেছি, শাস্ত্রীর চর্যাপদ আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এই বাংলাদেশে শতবছরে জন্ম নেয়া হাতেগোনা কয়েকজন ক্ষণজন্মার একজন, সব্যসাচী গুণের অধিকারী মানুষদের অন্যতম। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একাধারে একজন ভারত তত্ত্ববিদ, সংস্কৃত শাস্ত্রবিদ, গবেষক, শিক্ষাবিদ, ঐতিহাসিক, বহুভাষাবিদ, পুঁথি-সংগ্রাহক, বিশ্লেষক, সম্পাদক, অনুবাদক, ঔপন্যাসিক, শিলালেখ ও তাম্রলিপির পাঠোদ্ধারকারী। একসঙ্গে একটি চরিত্রে এতগুলো গুণের সমাবেশ বিরল।

বাংলা ভাষা আমাদের একটি গর্বের স্থান। কোথায় নেই বাংলা? বিশ্বের আনাচেকানাচে, জাতিসংঘে, ইউনেস্কোতে, সিয়েরালিয়নে, লন্ডনের মতো স্থানে বাংলা ভাষা উচ্চ মর্যাদায় নিজের অবস্থান মজবুত করে নিয়েছে। যে ভাষাকে নিয়ে বিশ্বে মাথা উঁচু করে বলি— ‘আমরা গর্বিত বাঙালি’, সে ভাষার শেকড়ের সন্ধান দিয়েছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী। তিনি বাংলা সাহিত্যের সব থেকে প্রাচীন সাহিত্য নিদর্শন চর্যাপদ ১৯০৭ সালে নেপালের রাজগ্রন্থশালা থেকে উদ্ধার করেন দুষ্প্রাপ্য কিছু পুঁথিসহ। ফলে প্রিয় বাংলা ভাষার হাজার বছরের গতিপথ, বিবর্তন ও রূপরেখা প্রণয়নে পরবর্তী ভাষা-গবেষকদের জন্য নতুন দ্বার-উন্মোচিত হয়।

বাংলা সাহিত্য রচনায় সংখ্যাগত পরিসংখ্যানে হয়তো অনেকেই শাস্ত্রীকে অনেক পেছনে রেখে এগিয়ে আছেন বা গেছেন। কিন্তু একটিমাত্র প্রবন্ধ ১২৮৫ বঙ্গাব্দে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী খ্যাতির উচ্চতায় পৌঁছে যান, প্রবন্ধটির নাম ‘তৈল’। এটি সম্ভবত এখনো বাংলায় সর্বাধিক পঠিত প্রবন্ধ। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৮৫৩ সালের ৬ ডিসেম্বর ব্রিটিশ বাংলা প্রদেশের খুলনা জেলার কুমিরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাদের আদিনিবাস ছিল উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার নৈহাটিতে। মাত্র আট বছর বয়সে পিতৃহারা হন। সে কারণেই পরবর্তী সময়ে তিনি চলে আসেন কলকাতায়। অদম্য ইচ্ছাশক্তি, একাগ্রতা তাকে জীবনের প্রথম পরীক্ষাটিতেই সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। কলকাতার সংস্কৃত কলেজিয়েট স্কুল ও প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়াশোনা করেন। কলকাতা সংস্কৃত কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রাস ১৮৭১ সালে এবং ১৮৭৩ সালে এফএ পরীক্ষায় ১৯তম স্থান অধিকার করে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৮৭৬ সালে অষ্টম স্থান অধিকার করে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন। বিএ পরীক্ষায় সংস্কৃতে প্রথম হওয়ায় প্রতি মাসে ৫০ টাকা করে ‘সংস্কৃত কলেজে স্নাতক বৃত্তি’, ২৫ টাকা করে ‘লাহা বৃত্তি’ এবং ‘রাধাকান্ত দেব মেডেল’ লাভ করেন। আর ১৮৭৭-এ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে সংস্কৃতে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৮৭৮ সালে হেয়ার স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছিলেন। এই স্কুলে পাঁচ বছর শিক্ষকতা করার পর ১৮৮৩ সালে সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনা শুরু করেন। এই সময়ই সরকার তাকে সহকারী অনুবাদক নিযুক্ত করে। ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৪ সাল পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যাপনার পাশাপাশি তিনি বেঙ্গল লাইব্রেরিতে গ্রন্থাগারিকের দায়িত্বও পালন করেছিলেন। এর পরের বছর ১৮৯৫ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজের সংস্কৃত বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পান। সেখানে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করার পর ১৯০০ সালে পুনরায় সংস্কৃত কলেজে যোগদান করেন অধ্যক্ষ হিসেবে। ১৯০৮ সালে সংস্কৃত কলেজ থেকে অবসর নিয়ে তিনি সরকারের তথ্যকেন্দ্রে যোগ দেন। ১৯২১ থেকে ১৯২৪ পর্যন্ত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধান। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ১৯০৭ সালে নেপালের রাজদরবারের গ্রন্থশালা থেকে উদ্ধার করেন ‘চর্যাচর্যা বিনিশ্চয়’ ও বহু দুর্লভ পুঁথি। ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ উদ্ধারকৃত পুঁথিগুলো একত্রে ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধ গান ও দোঁহা’ নামে প্রকাশ করেন। এই গ্রন্থটি ‘চর্যাপদ’ বা ‘চর্যাগীতি’ নামে বহুল পরিচিত। পরবর্তী সময়ে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায় চর্যাপদের ভাষা বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন যে, এর ভাষা বাংলা। যে কারণে সবকিছু ছাপিয়ে চর্যাপদের আবিষ্কারক হিসেবে বাংলা সাহিত্যে একটি স্থান দখল করে নিয়েছেন হরপ্রসাদ শাস্ত্রী।

ভারতবর্ষের দুটি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ গবেষণা-প্রতিষ্ঠান এশিয়াটিক সোসাইটি এবং বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতিও হয়েছিলেন। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থাকা অবস্থায় ‘প্রাচীন বাংলা গ্রন্থাবলি’ নামে দ্বিমাসিক পত্রিকার ১১টি সংখ্যা সম্পাদনা করেছিলেন। গবেষণা এবং পুঁথি-আবিষ্কার ও সম্পাদনা ছাড়াও তিনি উপন্যাস লিখেছেন। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত দুটি উপন্যাসের খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়। প্রথমটির নাম হলো ‘কাঞ্চনমালা’ যেটি প্রকাশিত হয় ১৯১৬ সালে। আর দ্বিতীয়টির নাম ‘বেদের মেয়ে’, প্রকাশকাল ১৯২০। এ ছাড়া বাল্মীকির জয়, মেঘদূত ব্যাখ্যা, সচিত্র রামায়ণ, প্রাচীন বাংলার গৌরব, বৌদ্ধধর্মে কয়েকজন প্রাচীন মনীষীর জীবন ও কর্মের ইতিবৃত্ত রচনা করেছেন তিনি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্যের নাট্যরূপ দিয়েছেন। বেশকিছু পুস্তিকা রচনা করেছেন ইংরেজি ভাষায়। এগুলোর মধ্যে সব থেকে উল্লেখযোগ্য হলো— Vernacular Literature of Bengal Before the Introduction of English Education, Discovery of Living Buddhism in Bengal, Magadhan Literature, Sanskrit Culture in Modern India.

হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর প্রথম প্রকাশিত একটি গবেষণাপত্রের নাম ‘ভারত মহিলা’। এই প্রবন্ধের জন্য তিনি ‘হোলকার পুরস্কার’ লাভ করেছিলেন। ১৮৯৬-এ ‘মহামহোপাধ্যায়’ এবং ১৯১১-তে সিআইই উপাধি লাভ করেন তিনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডি-লিট উপাধিতে ভূষিত হন ১৯২৭ সালে। এই মনীষীর মৃত্যু হয় ১৭ নভেম্বর ১৯৩১ সালে।

হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাল্যকালে কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পুরনো নাম শরৎনাথ ভট্টাচার্য পরিবর্তন করে শিবের অন্য নাম ‘হর’ অনুসারে হরপ্রসাদ ধারণ করেছিলেন। সকল চিকিৎসায় ব্যর্থ হয়ে শিবের পূজা দিয়ে নতুন জীবন পাওয়া এই মানুষটি বাংলা ভাষার হাজার বছরের গতিপ্রকৃতির মানচিত্র আঁকতেই হয়তো বেঁচে গিয়েছিলেন। আবিষ্কারের নেশায় মত্ত বিজ্ঞানী আর্কিমিডিস গোসলখানায় গোসলরত অবস্থায় রাজা প্রদত্ত সোনার ভেজাল প্রমাণের যে সমাধান খুঁজে পেয়ে ‘ইউরেকা’ বলে চিৎকার করে উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিলেন যে আনন্দে, সে আনন্দ প্রতিটি বাংলাভাষীর একমাত্র হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর চর্যাপদ আবিষ্কারের জন্য।

প্রাচীন বাংলাসাহিত্য, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বহু নতুন তথ্য আবিষ্কারের জন্য তার অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাভাষার গতিপ্রকৃতির উৎসমুখের সন্ধানে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর এই কাজের প্রভাব ও গুরুত্ব সুদূরপ্রসারী ও ফলদায়ক। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads