• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

বিবিধ

করোনায় ২০২০ সালে স্থবির বিশ্ব

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২৭ ডিসেম্বর ২০২০

চারদিকে সুনসান নীরবতা, নেই কোনো কোলাহল, বেশিরভাগ মানুষ ঘরবন্দি, জরুরি প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে বেরুনো মানুষের চোখে-মুখে আতঙ্ক; বন্ধ গাড়িঘোড়া, ট্রেন-বিমান নিশ্চল, হাসপাতালে উপচেপড়া রোগীর ভিড়, মর্গে সারি সারি মৃতদেহ- ২০২০ সালে এমনই চিত্র ছিল বিশ্বের।

করোনা মহামারীতে বিশ্বের মানুষকে নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। প্রাণঘাতী, ছোঁয়াচে ভাইরাসের দাপটে ত্রস্ত পৃথিবীতে অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে বিভিন্ন দেশের সরকার ও কর্তৃপক্ষকে। হতে হয়েছে কঠোর, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ এবং অবরুদ্ধ করে দিতে হয়েছে একের পর এক এলাকা। বেশিদিন এভাবে চালানো না যাওয়ায় বদলাতে হয়েছে কৌশলও। তবে কোনো কিছুতেই থামানো যায়নি মৃত্যুর মিছিল।

বছরের শেষদিকে বিভিন্ন কোম্পানির প্রতিষেধক আসার খবর খানিকটা স্বস্তি দিলেও বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছে। তা ঠেকাতে ফের বিধিনিষেধ জারি করা হচ্ছে। করোনার আরো আক্রমণাত্মক নতুন ধরনের প্রাদুর্ভাব বিশ্বজুড়ে ফের আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। মহামারীর এ বিশ্বে মাস্কে ঢাকা মুখই এখন পরিচিত দৃশ্য। হাত ধোয়া, সামাজিক/শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ভিড় এড়িয়ে চলার মতো নানা বিধি মেনে চলার পাশাপাশি লকডাউন, কারফিউ, কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং, হার্ড ইমিউনিটি, প্রণোদনা, আয়-বৈষম্য-এ শব্দগুলো এখন অতি চেনা।

হাসপাতালে আইসিইউ স্বল্পতায় ইউরোপে বেছে নিতে হয়েছিল কাকে বাঁচানো যাবে, আর কাকে নয়-সব মিলিয়ে ২০২০ সালকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে বছর বলছেন সাংবাদিক নিক ব্রায়ান্ট। কারো কারো মতে, ২০২০ হলো-আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর তটস্থ একটি বছর হিসাবে। বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া এবং পরে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগনসহ বিভিন্ন রাজ্যে ভয়াবহ দাবানল, বিশ্বজুড়ে একের পর এক শক্তিশালী ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, পরিবেশ বিপর্যয় জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদকে নতুন করে হাজির করেছে। সেসময় বিশ্ব নেতাদের তৎপরতা তেমন আশা না জাগালেও বছরের শেষে এসে চীনের কার্বন নিরপেক্ষ দেশ হওয়ার প্রতিশ্রুতি ও যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার রদবদল আগামী বছরগুলোতে এক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি করেছে।

এবছরই ব্রিটিশ রাজপরিবার ছেড়েছেন প্রিন্স হ্যারি ও তার স্ত্রী মেগান মর্কেল। দায়িত্বের পাশাপাশি রাজকীয় উপাধিও ত্যাগ করেছেন তারা। চীনের মহাকাশযানের চাঁদ থেকে মাটি ও পাথর নিয়ে আসা এবং স্পেসএক্সের যানে দুই নভোচারীর কক্ষপথে যাওয়ার ঘটনাও চলতি বছর আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মহামারীর মধ্যেও পৃথিবীতে যুদ্ধ-সংঘাতের কমতি ছিল না, ছিল জঙ্গি হামলাও। ইয়েমেনের গৃহযুদ্ধ, লাদাখে ভারত-চীন সংঘাত, নাগোরনো-কারবাখকে ঘিরে আর্মেনিয়া-আজারবাইজান যুদ্ধ বিশ্বজুড়ে সামনের দিনগুলোকে আরো অস্থির করে তুলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র মুসলিম দেশগুলোর প্রকাশ্যে একজোট হওয়ার পদক্ষেপ ওই অঞ্চলে  আগামীতে বড় ধরনের যুদ্ধের পটও প্রস্তুত করেছে বলে বিশেষজ্ঞদের মত। 

মহামারীতে অচেনা বিশ্ব : গত বছরের শেষদিকে চীনের উহানে যে রহস্যজনক ভাইরাসের আবির্ভাব ঘটেছিল, তা যে মাত্র কয়েক মাসেই পৃথিবীর সব কোণে ছড়িয়ে পড়বে আর পুরো দুনিয়াকে ওলট-পালট করে দেবে তা হয়তো কেউ কল্পনাও করে নি। প্রাণঘাতী এই করোনা মহামারী হয়ে পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষের শরীরে পৌঁছে গেছে। প্রাণ কেড়েছে লাখ লাখ মানুষের। সংক্রমণ মোকাবিলায় প্রথম দিকে চীনের অনুসরণে কঠোর লকডাউনের পথে হাঁটলেও অনেক দেশ পরে অর্থনীতি বাঁচাতে সেখান থেকে সরে এসে নানামাত্রিক বিধিনিষেধের মাধ্যমে আক্রান্ত কমিয়ে আনার পদক্ষেপ নেয়। সঙ্গে চলে চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কার, প্রতিষেধক বা টিকা তৈরির তোড়জোড়। আতঙ্কের পাশাপাশি নতুন এ ভাইরাসের চরিত্র ও গতিপ্রকৃতি অজানা থাকায় প্রথম দিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নানামাত্রিক নির্দেশনা দেশে দেশে বিভ্রান্তিরও জন্ম দিয়েছিল। সবাইকে মাস্ক পরার নির্দেশনা দিতে অনেক দেরি করায় আন্তর্জাতিক এ সংস্থার বিরুদ্ধে সমালোচনাও কম হয়নি।

সংস্থাটির বিরুদ্ধে চীনের তাঁবেদারি করার অভিযোগ করে সম্পর্ক ছিন্ন করে যুক্তরাষ্ট্র। কেবল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে বাঁকা চোখে দেখাই নয়, করোনা বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে পড়ার পেছনেও যুক্তরাষ্ট্র ও তার অনেক মিত্রই চীনকে দায়ী করে। বেইজিং তা অস্বীকার করে পাল্টা দায় চাপালে শুরু হয় কথার লড়াই।

করোনার কারণে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক, ইউরো, কোপা আমেরিকাসহ একের পর এক আয়োজন পিছিয়ে দিতে হয়; জরুরি সভা বা সম্মেলনগুলো চলে যায় অনলাইনে। এমন পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে অন্যান্য ব্যবসা ও অর্থনৈতিক কার্যক্রম ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ফুলেফেঁপে উঠে অনলাইনভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য। মহামারী আর নানান বিধিনিষেধের কারণে বেড়েছে ছাঁটাই, চাকরিচ্যুতি। আয় বৈষম্য বাড়ায় কোটি কোটি লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গেছে; উল্টোদিকে সুযোগ কাজে লাগিয়ে অনেকে বাড়িয়ে নিয়েছেন সম্পদের পরিমাণ। কোভিড-১৯ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার দগদগে ঘা উন্মোচন করেছে; সুরক্ষা উপকরণ সংক্রান্ত নানান দুর্নীতিও অনেক দেশের রাজনীতিতে বড়সড় ধাক্কা দিয়েছে।

বছরের শেষদিকে এসে বেশ কয়েকটি দেশে টিকার প্রয়োগ আশা জাগালেও ধনীদের টিকার মজুতে দরিদ্র দেশগুলোর বঞ্চিত হওয়ার শঙ্কা তৈরি করেছে। এখন পর্যন্ত পাওয়া কোনো টিকাই দীর্ঘমেয়াদি সুরক্ষা দিতে সক্ষম প্রমাণিত না হওয়ায় মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, ভিড় এড়িয়ে চলার মতো নির্দেশনা অব্যাহত আছে।

ট্রাম্পের হার : করোনা নিয়ে আতঙ্ক সত্ত্বেও চলতি বছর যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনের দিকেও বিশ্বজুড়ে অনেকেই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। মহামারীর মধ্যে এ নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পরাজিত হলেও এখন পর্যন্ত তিনি হার স্বীকার করে নেননি। যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে অভিশংসনের মুখে পড়েও সিনেটের জোরে ক্ষমতায় বহাল থাকা এ রিপাবলিকানের পরিণতি যে এমন হবে বছরের শুরুতেও তা মনে হয়নি। কিন্তু কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্যর্থতা, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পুলিশ নির্যাতন ও বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন, শ্বেতাঙ্গদের আস্ফাালন, মহামারীর কারণে অর্থনীতির বেহাল দশা-এসবই চার বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা এ রাজনীতিবিদের দম্ভ চূর্ণ করে দিয়েছে। ৭৪ বছর বয়সী এ প্রেসিডেন্ট অবশ্য দায় চাপাচ্ছেন ভোট কারচুপির ওপর। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলছেন, তিনি ট্রাম্প আমলের উল্টোপাল্টা নীতি বদলে যুক্তরাষ্ট্রকে আবারো বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে নিয়ে যাবেন। নারী, কৃষ্ণাঙ্গ, আদিবাসী ও ল্যাটিনোদের প্রাধান্য দিয়ে গঠিত তার প্রশাসনও যুক্তরাষ্ট্রের বহুত্ববাদ ও উদারনৈতিকতার পুরোনো রূপে ফেরারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

বেড়েছে চীনের প্রভাব :  তাইওয়ান উপকূলের কাছে চীনের যুদ্ধজাহাজ ও বোমারু বিমানের ধারাবাহিক উপস্থিতি আগের বছরগুলোর মতো ২০২০-এও দেখা গেছে; দক্ষিণ চীন সাগরে দেশটির প্রভাবও এ মুহূর্তে একচেটিয়া। বেইজিংকে ঠেকাতে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপান-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র-অস্ট্রেলিয়া মিলে কোয়াড গঠন করলেও ট্রাম্পের পরাজয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র এ জোটকে এগিয়ে নেবে কিনা তা নিয়ে ধোঁয়াশা দেখা দিয়েছে। হংকংয়ে গত বছরের সরকারবিরোধী আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায় বানানো নতুন নিরাপত্তা আইনে গণতন্ত্রপন্থি নেতাকর্মীদের একের পর এক জেলে ভরে শহরটিকে ফের বশে আনার কাজ অনেকটাই গুছিয়ে নিয়েছে চীন। উইঘুরে তাদের নিপীড়ন নিয়ে মানবাধিকার সংগঠন চলতি বছরও ছিল বেশ সরব, এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কবলেও পড়তে হয়েছে তাদের।

তাইওয়ানে এ বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জেতা পশ্চিমাপন্থি সাই-ইং ওয়েনকে বেইজিংয়ের হুমকি-ধামকি উপেক্ষা করেই যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র কয়েকটি দেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরো জোরদারে একের পর এক পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে। চীনের সঙ্গে নিজেদের আনুষ্ঠানিক নামে বিভ্রান্তি তৈরি হওয়ায় স্বশাসিত এ দ্বীপটি চলতি বছর তাদের পাসপোর্টের নকশা বদলে ফেলারও ঘোষণা দেয়।

চীনের ৫জি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর সন্দেহ ও আপত্তি প্রযুক্তি জগতে তাদের অবস্থানকে খানিক নড়বড়ে করে দিলেও সারা দুনিয়ায় তাদের বৃহৎ বাজারকে খুব একটা চাপে ফেলতে পারেনি। কমাতে পারেনি তাদের ক্রমবর্ধমান প্রভাব। উল্টো যুক্তরাষ্ট্র যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা থেকে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে, চীন সেখানে নিজেকে বিশ্ব নেতার আসনে বসানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছে। বাণিজ্যে শুল্কযুদ্ধ নিয়ে বছরের শুরুতে ওয়াশিংটন-বেইজিং একটি প্রাথমিক চুক্তিতে উপনীত হলেও পরের দিকে দুইপক্ষের সম্পর্কের কেবল অবনতিই দেখা গেছে। যুক্তরাষ্ট্রের নানান নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় চীনকে চোখে চোখ রেখে জবাব দিতেও দেখা গেছে।

মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাত : বছরের শুরুতে ড্রোন হামলা চালিয়ে ইরানি কমান্ডার কাসেম সোলেমানিকে হত্যা করে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন যুদ্ধের দামামাই বাজিয়ে দিয়েছিল। ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদের ঘাঁটিতে তেহরানের পাল্টা হামলা আর কঠোর প্রতিশোধ নেওয়ার হুংকার টানটান উত্তেজনা সৃষ্টি করেছিল; যদিও ইরানি কর্মকর্তারা ক্ষেপণাস্ত্র ভেবে যাত্রীবাহী একটি বিমান ভূপাতিত করার পর তা থিতিয়ে আসে।

তেহরানকে ঠেকাতে এবছর হোয়াইট হাউস বেশ কয়েকটি আরব দেশকে তেল আবিবের সঙ্গে মিলিয়ে দিতে পেরেছে। এতে যে সৌদি আরবেরও প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে তেল আবিবগামী বিমানের জন্য পথ করে দিয়ে রিয়াদ তারই ইঙ্গিত দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে এমন মেরুকরণ ফিলিস্তিনিদের স্বাধীন রাষ্ট্রের লালিত স্বপ্নকেও অনেক দূরে সরিয়ে দিল বলেই বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

এ বছরও ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুতিরা সৌদি আরবকে লক্ষ করে একের পর এক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়েছে। ইরাক, লেবাননে বেড়েছে তেহরানের প্রভাব। সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণ বাশার আল আসাদের হাতে থাকলেও দেশটিতে ইরানের বিভিন্ন স্থাপনা লক্ষ করে ইসরায়েলি হামলা ছিল অব্যাহত। লেবানন এবং আশপাশের অঞ্চলে হিজবুল্লাহর দাপটও তেল আবিবের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা তালিবানের পাশাপাশি ইরানের জন্য শাপেবর হতে পারে বলেও অনেকে মনে করছেন। সৌদি জোটের সঙ্গে কাতারের দূরত্ব কমে আসার ইঙ্গিত মিলেছে। এরপরও মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না। ইসরায়েল-রিয়াদ মিত্রতা বিবেচনায় নিলে ওই অঞ্চলে যে সামনের দিনগুলোতে অস্ত্রের ঝনঝনানি আরো বাড়বে, বছরের শেষভাগে ইরানি পরমাণু বিজ্ঞানী খুনের ঘটনা তারই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

দুর্যোগে নাকাল বিশ্ব : ঘোর মহামারীর মধ্যেও অঘটন, দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বরাবরের মতোই এবছরও নাকাল হয়েছে বিশ্ব। আগস্টে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের ভিডিও পুরো দুনিয়াকে আতঙ্কিত করেছে। ওই ঘটনায় দুই শতাধিক লোকের মৃত্যু হয়। মজুত রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণের এ ঘটনা যেন স্মরণ করিয়ে দিয়েছিল পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞে মানুষ আর পৃথিবীর কী পরিণতি হতে পারে। মহামারীর বিশ্বে আরো অনেক দুর্ঘটনার সাক্ষী হয়েছে বিশ্ববাসী; ছিল জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাড়তে থাকা ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বন্যাসহ নানান দুর্যোগ আর এসবের কারণে মানুষের প্রাণহানি ও বাস্তুচ্যুতি।

বেহাল বিশ্ব অর্থনীতি : মহামারী আতঙ্কে গোটা বিশ্ব স্তব্ধ হয়ে পড়ায় বছরের শুরুতেই বিশ্ব অর্থনীতি পড়ে তুমুল চাপে। বিভিন্ন দেশ লকডাউন, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ সব বন্ধ করে দিলেও পরে মহামারীর মধ্যেই ধীরে ধীরে জরুরি সব কার্যক্রম চালু করতে বাধ্য হয়। এপ্রিলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল জানায়, মহামারীর কারণে বিশ্ব অর্থনীতি ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়ে পড়তে পারে। ১৯৩০-র মহামন্দার পর এমনটা আর হয়নি। মহামারীতে অর্থনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত খাতের মধ্যে অন্যতম ছিল বিমান যোগাযোগ ও পর্যটন। মে’তে লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় এয়ার ক্যারিয়ার ল্যাটাম এয়ারলাইনস নিজেদের দেউলিয়া ঘোষণার আবেদন করে। অসংখ্য কোম্পানিতে বিপুল সংখ্যক ছাঁটাই ও চাকরিচ্যুতি দেখা দেয়।

পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিভিন্ন দেশ নানান প্রণোদনা প্যাকেজের ঘোষণা দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে প্রণোদনা প্যাকেজ ছাড়িয়ে যায় ট্রিলিয়ন ডলার। জুলাইয়ে ইউরোপের নেতারাও মহামারীতে ক্ষতিগ্রস্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ৭৫০ বিলিয়ন ইউরোর তহবিল সৃষ্টিতে একমত হন। পানামা ফাইল, প্যারাডাইস পেপার্সের ধারাবাহিকতায় এ বছর মেলে ফিনসেন ফাইলসের খোঁজ। টাকার উৎস নিয়ে প্রশ্ন থাকার পরও বিশ্বের বড় বড় ব্যাংকগুলো গত দুই দশকে বিপুল অংকের সন্দেহজনক তহবিল লেনদেন করেছে বলে বেরিয়ে আসে নতুন এ কেলেঙ্কারিতে। এতে অর্থের পরিমাণও কম নয়, প্রায় দুই ট্রিলিয়ন ডলার। মহামারীর মধ্যেও বিশ্ব তেল উৎপাদক দেশগুলোর মধ্যে দাম নিয়ে লড়াই দেখেছে। তেলের দর নিয়ে রাশিয়া-সৌদি আরব লড়াই ও কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে মার্চে শেয়ারবাজারে বড় ধরনের ধস দেখা দেয়। ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ ২ হাজার পয়েন্টের বেশি নেমে যায়। ওই মাসের শেষদিকে অপরিশোধিত ব্রেন্ট তেলের দাম ২০০২ সালের নভেম্বরের পর সবচেয়ে কম ব্যারেলপ্রতি ২৩ ডলারে নেমে আসে।  বাজার ঠিক রাখতে তেল উৎপাদক দেশগুলোর জোট ওপেক ও অন্যরা মে থেকে তেলের উৎপাদন দিনপ্রতি ৯৭ লাখ ব্যারেল কমিয়ে আনার ব্যাপারে একমত হয়। তেল উৎপাদক দেশগুলোর এ ঠোকাঠুকিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকেও বেশ তৎপর দেখা গেছে। তার চাপে পড়েই সৌদি আরব তেল উৎপাদন কমাতে-বাড়াতে রাজি হয় বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।

সন্ত্রাসী হামলা : করোনা মহামারীও সন্ত্রাসী হামলা থামাতে পারেনি। বিশ্বের দেশে দেশে সন্ত্রাসী হামলা অব্যাহত ছিল। আফ্রিকায় বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো; তাদের নির্বিচারে হামলায় ঝরেছে হাজারের বেশি প্রাণও। বছরের শুরুতেই বোকো হারামের হামলায় নাইজারে মৃত্যু হয় ৮৯ সেনার। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস পাকিস্তানের কোয়েটায় আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়ে কেড়ে নেয় আরো ১৫ প্রাণ।

জার্মানিতে কট্টর ডানপন্থি এক ব্যক্তি দুটি শিশা বারে বন্দুক হামলা চালিয়ে বিদেশিসহ ৯ জনকে হত্যা করে ফেব্রুয়ারিতে; নিজের অ্যাপার্টমেন্টে মাকে হত্যার পর বন্দুকধারী পরে নিজেও আত্মহত্যা করে। এপ্রিলে চাদের একটি কারাগারে সন্দেহজনক ৪৪ বোকো হারাম সদস্যের মৃতদেহ পাওয়া যায়। ধারণা করা হচ্ছে, তাদেরকে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল। ওই মাসেই যুক্তরাষ্ট্র শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী গোষ্ঠী রাশিয়ান ইমপেরিয়াল মুভমেন্টকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করে ও তাদের নেতাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়। এটাই কট্টর শ্বেতাঙ্গ কোনো গোষ্ঠীকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা।

কানাডার নোভা স্কশায় পুলিশের পোশাক পরা এক বন্দুকধারীর হামলায় এক নারী পুলিশসহ ২২ জন নিহত হয়; পুলিশের গুলিতে পরে হামলাকারীরও মৃত্যু হয়। দলে যোগ দিতে রাজি না হওয়ায় মোজাম্বিকে জঙ্গিরা ৫২ জনকে হত্যা করে।  আফগানিস্তানের কাবুলে শিয়া অধ্যুষিত একটি এলাকায় মাতৃসদনে বন্দুকধারীর হামলায় দুটি সদ্যেজাত শিশুসহ ২৪ জন নিহত হয়; একইদিন কুজ কুনারে একটি শেষকৃত্যে আত্মঘাতী বোমা হামলায় প্রাণ যায় ৩২ জনের। অক্টোবরে কাবুলের একটি শিক্ষা কেন্দ্রে আত্মঘাতী হামলায় নিহত হয় অন্তত ২৪ জন।

বুরকিনা ফাঁসোর দিজিবোর কয়েকটি গণকবরে ১৮০টি মৃতদেহ মেলে জুলাইয়ে। জিহাদিদের সঙ্গে লড়াইরত সরকারি বাহিনীর সদস্যরাই এদের হত্যা করেছে বলে অনুমান করা হচ্ছে। নভেম্বরে ইথিওপিয়ায় এক হামলায় আমহারা জনগোষ্ঠীর নারী, শিশু ও বয়োবৃদ্ধসহ ৫৪ জনের মৃত্যু হয়। ভিয়েনার বেশ কয়েকটি এলাকায় বন্দুক হামলায় ৪ বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়। চলতি বছর ইউরোপে বেশ কয়েকটি ছুরি হামলায়ও কয়েকজন নিহত হয়েছে। কানাডার কেবেকে মধ্যযুগীয় পোশাক পরিহিত একজনের ছুরিকাঘাতে প্রাণ যায় ২ জনের।

ফুটবলের জাদুকরের মৃত্যু : কোটি ভক্তকে কাঁদিয়ে চলতি বছর পৃথিবী ছেড়েছেন ফুটবলের জাদুকর ডিয়েগো ম্যারাডোনা। চার বছর আগে বন্ধু বিপ্লবী ফিদেল ক্যাস্ত্রো যেদিন চলে গিয়েছিলেন, কাকতালীয়ভাবে একইদিন- ২৫ নভেম্বর মারা যান আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬তে ফুটবল বিশ্বকাপ এনে দেওয়া এ কিংবদন্তি। তার মৃত্যু শোকে স্তব্ধ করে দেয় সারা দুনিয়াকে। সারা জীবন যার সঙ্গে ছিল তার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, সেই পেলে পর্যন্ত তার শোক বার্তায় বলেন, একদিন দুজনে ‘স্বর্গে একসঙ্গে ফুটবল খেলব’।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads