• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯

বিবিধ

গণতন্ত্রে ভিন্নমত

  • আফরোজা পারভীন
  • প্রকাশিত ১০ অক্টোবর ২০২১

গণতন্ত্রে ভিন্নমত থাকবে, থাকা বাঞ্ছনীয়-কথাটা আমরা প্রায়ই উচ্চারণ করে থাকি। জোরেশোরে উচ্চারিত হয় যখন কোনো সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় সমস্যার মুখোমুখি হই আমরা। চলে কথার পিঠে কথা। আর এটাই ভিন্নমত।

গণতন্ত্র হলো সেই বস্তু যেখানে চিন্তার স্ব্বাধীনতা, কথা বলার স্বাধীনতা, কাজের স্বাধীনতা আর উপাসনার স্বাধীনতা থাকবে। এটাই গণতন্ত্রের মতাদর্শ। সাম্য গণতন্ত্রের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাই ব্যক্তির মূল্য আর মর্যাদাদানই গণতন্ত্রের প্রথম কথা। গণতন্ত্র শব্দটির অর্থ  জনগণের ক্ষমতা। অর্থাৎ সরকার বা শাসনব্যবস্থা যখন জনগণের অভিমতের ভিত্তিতে পরিচালিত হয় তখন তাকে গণতন্ত্র বা গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্র্রাহাম লিংকন তার গেটিসবার্গ অ্যাড্রেসে বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্র জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার, জনগণের জন্য সরকার।’

তাই যদি হয় তাহলে কেন এত মতদ্বৈধ। এই তো দিন কয়েক আগে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্রের চুল কেটে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে একজন শিক্ষকের বিরুদ্ধে। ছাত্রদের অধিকার আছে লম্বা চুল রাখার, মাথা ন্যাড়া করার, ঝুঁটি বাঁধার বা যেমন ইচ্ছা তেমনভাবে চুলের ফ্যাশন করার। এটা তাদের মত। শিক্ষকের মত ভিন্ন। সেটা তার পছন্দ নয়। তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু তিনি কারো স্বাধীনমতে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। বিষয়টি যদি শিক্ষায়তনের শৃঙ্খলার পরিপন্থি হয় তিনি নোটিশ করতে পারেন; কিন্তু নিজ হাতে ব্যবস্থা তুলে নিতে পারেন না। সেজন্য প্রশাসন আছে। এই যে ছেলেরা ভাবছেন তারা চুল রাখতে পারেন আর শিক্ষক ভাবছেন পারেন না এটাই ভিন্নমত। এই ভিন্নমত থাকার স্বাধীনতা গণতন্ত্রে আছে । এটা গণতান্ত্রিক অধিকার।

বছর দুয়েক আগে বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছিল তারই সহপাঠীরা। আবরারের অপরাধ সে তার মত প্রকাশ করেছিল। সে মত তার সহপাঠীদের কারো কারো পছন্দ হয়নি। আর তার পরিণতিতে জীবন দিতে হলো আবরারকে। প্রশ্ন হচ্ছে কেন? নিজের মত বলার অধিকার তো তার আছে। গণতন্ত্র তাকে সে অধিকার দিয়েছে। তাহলে কেন তাকে মরতে হলো?

আমাদের শিক্ষার্থীরা একটি সড়ক দুর্ঘটনার প্রতিবাদে ‘সড়ক আন্দোলন’-এ নেমেছিল। তারা প্রচলিত সড়ক নিয়ন্ত্রণকে ক্রটিপূর্ণ মনে করেছিল। সড়কের দায়িত্ব তারা নিজ হাতে নিয়ে নিয়েছিল। তাতে যথেষ্ট সুফলও হয়েছিল। দেশবাসী অবাক হয়ে সপ্রশংস দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখেছিল ছোট ছোট ছেলে-মেয়ে কী সুশৃঙ্খলভাবে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছে। তারপর শুরু হলো তাদের মতের প্রতি অনাস্থা। পরিণতি আপনাদের জানা।

সমস্যা হচ্ছে আমরা ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নই। অশ্রদ্ধা দেখাতে গিয়ে আমরা আমাদের অধিকারের আওতায় সীমাবদ্ধ থাকছি না। যা বলা যায় তাও বলছি, যা বলা যায় না তাও বলছি। যা করা যায় তাও করছি, যা করা যায় না তাও করছি। তাই একজন মাননীয় সংসদ সদস্য মহান সংসদে দাঁড়িয়ে প্রস্তাব করতে পারছেন, ‘চাকরীজীবী ছেলে-মেয়েরা পরস্পরকে বিয়ে করতে পারবে না এই আইন প্রণয়ন করা হোক।’ আর আইনমন্ত্রী মহোদয়ও বলতে পারছেন, ‘এটা সংবিধান পরিপন্থি। এই প্রস্তাব নিয়ে আমি দু’কদমও এগোতে পারব না।’

এই যে আমাদের মাননীয় সংসদ সদস্য প্রস্তাবটি রাখলেন তিনি কথাটা কি ভেবে রাখলেন কে জানে। আমাদের অনেক কথা অনেক সময় প্রস্তাবনার ভুলে স্বেচ্ছাচারের পর্যায়ে চলে যায়। এর পরিণতিতে আমরা ধৈর্য হারাচ্ছি। পরস্পরের দোষ ধরা, খুঁত ধরা এখন আর আমাদের ব্যক্তি-চরিত্র নয়, জাতীয়-চরিত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে।  সরকারের সমালোচনা করতে গিয়ে বিরোধীরা তাদের ভালো দিকগুলো বেমালুম চেপে যাচ্ছে। খারাপের তালিকা দীর্ঘতর হচ্ছে। আবার বিরোধীদের সমালোচনা করতে গিয়ে সরকার তাদের কিছুই ভালো দেখছে না, মারমুখী ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে। পরস্পরের এই যুদ্ধাংদেহী অবস্থানের কারণে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন হচ্ছে না। জনগণ হয়ে পড়ছে অসহায়, দিশেহারা। পারস্পরিক সহযোগিতা সহমর্মিতার অভাবে কারো কোনো অর্জনই প্রশংসা পাচ্ছে না। এটা গণতন্ত্রের চরিত্র নয়।

আমাদের মনে রাখা দরকার, কোনো মানুষ যে শুধু ভালো কাজই করে এমন নয়, খারাপ কাজও করে। কারণ ভুল-ক্রটি নিয়েই মানুষ। তেমনই যে কোনো সরকারের যেমন ভালো কাজ আছে তেমন খারাপ কাজও আছে। কেন সরকার শুধুই ভালো কাজ করেছে অথবা শুধুই খারাপ এমন হওয়া সম্ভব নয়। কাজেই উল্লেখ করার সময় নিন্দা যেমন করা হয় তেমন প্রশংসাও করা দরকার। আর সেটা করা হয় না বলে আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে দেশে বিদেশে কথা হয়। বিদেশিরাও কথা বলে। মনে আছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটি অনুষ্ঠানে প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট বলেছিলেন, ‘ভিন্নমত প্রকাশ এবং বিরোধিদের অধিকার চর্চার পর্যাপ্ত ও নিরাপদ সুযোগ এবং রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমেই গণতন্ত্র পুরোপুরি বিকশিত হতে পারে।’ অন্যদিকে সেসময় বাংলাদেশে নিযুক্ত জার্মানির রাষ্ট্রদূত টমাস প্রিজন বলেছিলেন, ‘গণতন্ত্রে ভিন্নমত সহ্য করাই গুরুত্বপূর্ণ।’

অর্থাৎ দেশে রাজনৈতিক সংলাপ হচ্ছে না। তাই  গণতন্ত্র পুরোপুরি বিকশিত হচ্ছে না। সরকার ভিন্নমত সহ্য করছে না। এসব কথা তারা প্রকারান্তরে বলে দিলেন। বিদেশিরা আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলতে পারেন কি পারেন না, সেটা পরের বিষয়। কিন্তু ভাবার বিষয় এটাই যে, এ ধরনের কথা হচ্ছে। যেটা হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়। আমাদের দেশে যদি গণতন্ত্রের অবাধ চর্চা হতো, এ ধরনের কথা বলার কেউ সুযোগই পেতো না। কি দেশি কি বিদেশি।

আমরা পরাধীন ছিলাম। দেশ গণতন্ত্রের চর্চা ছিল না। মত প্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। অন্যের মত আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হতো। প্রতিবাদ করলেই চলত দমন-পীড়ন। দেশে অবাধ গণতন্ত্র চর্চা হবে, সবাই হবে দেশের রাজা, দেশের প্রজা, এ দেশটা হবে সবার এই ভাবনা থেকেই তো মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল। এত রক্তক্ষয় হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীনতার পাঁচ দশক পর এখনো আমাদের গণতন্ত্রের কথা বলতে হচ্ছে, ভিন্নমত যে জরুরি এ বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করতে হচ্ছে এটাই বেদনার বিষয়। 

দেশে অনেক ভালো ভালো আর উন্নয়নমূলক কাজ হয়েছে। পাশাপাশি দুর্নীতি অসততা ঘুষ অদক্ষতায় দেশ সয়লাব। রাজনীতি এখন এক ধরনের দুর্বৃত্তায়ন। ষাটের দশকে মেধাবী ছাত্ররা রাজনীতি করত। তারা বিরোধী রাজনীতি করলেও পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক ছিল। ভিন্নমতের প্রতি ছিল শ্রদ্ধাবোধ। তাই দুই দলের দুজন ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে তখন নিবিড় বন্ধুত্ব হওয়া ছিল খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এখন আর সেদিন নেই। অন্য দল করা মানেই জাতশক্র। এই মনোভাব বিধ্বংসী। এই মনোভাব থাকলে কখনোই গণতন্ত্রের চর্চা হয় না।

উত্তরাধিকারের রাজনীতি, ভোট গ্রহণ ও প্রদানে স্বচ্ছতা, ক্ষমতার বলয়ে থাকা মানুষের দর্পিত আচরণ, বিচারহীনতা জনগণকে ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা করে ফেলছে। একের পর এক সিদ্ধান্ত জনগণের উপর চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জনগণ  সেসব সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে। নেই কোনো গণশুনানির ব্যবস্থা। জনগণ কী চায়, যা তাদের ওপর চাপানো হচ্ছে তা আদৌ চায় কিনা এসব কথা বলার সুযোগ নেই। তাই গণতন্ত্রের প্রশ্নে আজ সারা বিশ্ব দ্বিধাবিভক্ত। অনেকে মনে করেন, গণতন্ত্র একটা মুুখরোচক গালভরা শব্দমাত্র। প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে গণতন্ত্র বা জনগণের শাসন বলে কিছু নেই। আসলে জনগণের নামে গুটিকয়েক ব্যক্তিই রাষ্ট্রের শাসনকার্য পরিচালনা করেন। যদি ভোট হয় তাহলে জনগণের অধিকার শুধু ভোট দেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। ভোটের পর শাসনকার্য পরিচালনায় জনগণের কোন ভূমিকা আছে বলে তারা মনে করেন না। বিশেষজ্ঞদের মতে গণতন্ত্র এমন একটি সরকার যেখানে প্রত্যেকের অংশগ্রহণ রয়েছে। কিন্তু এই অংশগ্রহণ কথাটাও এখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে।

আর এসব প্রশ্নের সঙ্গত কারণও রয়েছে। যদি জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা গঠিত সরকার আর জনগণের জন্যই সরকার হয়ে থাকে তাহলে সে জনগণের অবস্থান আজ কোথায়? কেন তারা বাকরুদ্ধ? কেন মন খুলে কথা বলতে পারে না? সোচ্চারে দাবি উত্থাপন করতে পারে না? দাবি দাওয়া পেশ করলে, ভিন্নমত প্রকাশ করলে কেন তাদের জেল-জুলুম, হামলা-মামলায় পড়তে হয়। কেন যখন তখন গলার ওপর নেমে আসে দায়ের কোপ। কেন ভোগে সারাক্ষণ নিরাপত্তাহীনতায়? ন্যায্য কথা বললে, কেন বলা হয় দেশদ্রোহী? কবি সাহিত্যিক লেখকরা কেন মন খুলে লিখতে ভয় পান। সে শুধু এই সরকারে নয়, সব সময় সব সরকারে। কেন ভাবেন, থাক ন্যায্য কথাটা লেখার দরকার নেই, কি দরকার সেধে বিপদ ঘাড়ে নেওয়া। এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই। হয়তো অনেকেই বলবেন, ভিন্নমত তো আছেই। দেশে এতগুলো টিভি চ্যানেল, এত এত পত্রিকা, কত টক শো হচ্ছে, সেমিনার সিম্পোজিয়াম হচ্ছে, যে যার ইচ্ছামতো কথা বলছে। ভিন্নমত না থাকলে এত কথা বলার সুযোগ কি থাকত? এখানে সবিনয়ে আমার বক্তব্য হচ্ছে, অনেক পত্রিকা আর টিভি চ্যানেল যেমন আছে, পছন্দ না হলে বন্ধও করে দেওয়া হচ্ছে। আগেও হয়েছে। আর কেউ বেশি কথা বললে সেটা সহ্য করার মধ্যে কোনো সহনশীলতার ব্যাপার নেই। সহনশীলতা হচ্ছে সেটাই যেটা নিজের বিপক্ষে কথা বলার পরও মানুষ মেনে নেয়। কথাগুলো সত্যি হলে নিজেকে শুধরে নেয়, ভুল স্বীকার করে। এটাই গণতন্ত্র চর্চা। এ সংস্কৃতি এ দেশে আগেও ছিল না, এখনো নেই। তাই মন মতো কথা না হলেই ব্যাংক ডাকাতির মামলা, গাড়ি পোড়ানোর মামলা, এমনকি সিঁধেল চুরির মামলা হয়। তখনি চারদিকে শুরু হয় হত্যা, রাহাজানি, খুন জখম, ধর্ষণ। আর অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, সরকারি দল দোষারোপ করছে বিরোধীদের আর বিরোধীরা সরকারকে। বাস্, দুই দলের দায় মুক্তি ঘটছে। মরছে আর ভুগছে সাধারণ মানুষ। যারা নাকি জনগণ, যাদের জন্য গণতন্ত্র, যাদের জন্য সরকার!  

আজ থেকে হাজার হাজার বছ আগে প্রাচীন গ্রিস এবং রোমে গণতন্ত্রের উৎপত্তি ও বিকাশ ঘটেছিল।  ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নগর রাষ্ট্রগুলো ছিল  ক্ষুদ্রায়তন এবং স্বল্প জনসংখ্যার। সে কারণে সভা-সমিতির মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সরাসরি জনগণের মতামত নেওয়া সম্ভব ছিল। এটাই  ছিল প্রত্যক্ষ বা বিশুদ্ধ গণতন্ত্র। কিন্তু সময়ের  পরিক্রমায় পৃথিবীর রাজ্যসমূহের আয়তন এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। ঘটেছে প্রাচীন যুগের নগর রাষ্ট্রের বিলুপ্তি। বর্তমানে রাষ্ট্রগুলোর বিশাল আয়তন ও বিপুল জনসংখ্যার কারণে সকল জনগণের মতামতের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সম্ভব নয়। কাজেই জনগণের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের হয়ে, জনগণের কল্যাণে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনা করেন। এই জনপ্রতিনিধিরাই জনগণের মুখপত্র এবং তাদের অভিমতকে জন অভিমত বলে মনে করা হয়। তারা নির্বাচিত হয়ে জনগণের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে আশা করা হয়। এটাকে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বলা হয়। এ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাই আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার ভিত্তি।

বাংলাদেশেও এই ধরনের সরকার ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। জনগণ ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচন করেছেন। অবশ্য সেই ভোট কতটা নিরপেক্ষ হয়েছে, সকল দলের অংশগ্রহণে হয়েছে কিনা সেটা নিয়েও হাজারটা প্রশ্ন আছে। জনপ্রতিনিধিরা সংসদে আইন পাস করেন, দেশ চালান। কিন্তু তাতে জনমত কতটা প্রতিফলিত হয় জানি না। কজন সংসদ সদস্য তাদের এলাকা নিয়ে ভাবেন? সংসদে নিজেদের এলাকার উন্নয়নের কথা তুলে ধরেন? এলাকার রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠার চেয়ে তারা অনেক বেশি ব্যস্ত থাকেন নিজেদের বেতন বৃদ্ধি, বিদেশ ভ্রমণ, বিদেশ থেকে করমুক্ত গাড়ি আমদানি আর রাজউকের প্লট নিয়ে। আর উন্নয়নের জন্য যে অর্থ বরাদ্দ হয় তার বেশিরভাগই যায় তার চামচাদের পকেটে। টেন্ডারে কাজ পান তারাই। ফলে একই রাস্তা প্রতি বছর বানানো হয়, একই ড্রেন প্রতি বছর কাটা হয়। জনগণের ভোগান্তির শেষ থাকে না। জনগণ বিদ্যুৎ পায় না, গ্যাস পায় না, পানি পায় না, জলাবদ্ধতা কমে না। এ কথাগুলো যে তারা বলবে সে সুযোগও নেই। না বলতেই নিজ চোখে তারা প্রতিদিন দেখে খুনের ওপর খুন, কাজেই বাক স্বাধীনতাকে পরাধীন করে রাখাকেই তারা বেঁচে থাকার পথ মনে করে।

ফরাসি দার্শনিক রুশো প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে গণতন্ত্র বলতে নারাজ ছিলেন। তিনি মনে করতেন, জনপ্রতিনিধিরা  জনস্বার্থে কাজ না। তারা কাজ করে নিজের স্বার্থে। তার এই মত যে কতটা অভ্রান্ত ছিল দেশের দিকে তাকালেই সেটা বোঝা যায়। তিনি প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পক্ষে ছিলেন যাতে জনগণের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে। আর প্লেটো গণতান্ত্রিক শসন ব্যবস্থাকে সবচেয়ে অযোগ্য শাসনব্যবস্থা মনে করতেন। তার মতে,  যেহেতু গণতন্ত্র বেশিরভাগ জনগোষ্ঠীর দ্বারা পরিচালিত শাসন ব্যবস্থা, সেহেতু গণতন্ত্র কখনোই উন্নতমানের শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিগণিত হতে পারে না। কারণ প্রত্যেক রাষ্ট্রেই বিজ্ঞানী, সুপণ্ডিত এবং যোগ্য লোকের তুলনায় অযোগ্য অশিক্ষিত এবং অজ্ঞ লোকের সংখ্যাই বেশি। সুতরাং বেশিরভাগ লোকের শাসন মানেই অযোগ্যের শাসন। তার মতে গণতন্ত্র সংখ্যায় বিশ্বাসী, গুণে নয়।

প্লেটোর এ কথাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আজকাল শাসন ক্ষমতা অযোগ্যেরই হাতে। জনগণ ভোট দিয়ে বা ভোট না দিয়ে যাদের নির্বাচন করেন তারা বেশিরভাগই ব্যাক বেঞ্চার। ছাত্র জীবনে তৃতীয় ক্যাটাগরির ছাত্র ছিলেন। প্রথম ক্যটাগরির ছাত্ররা তাদের অধস্তন হিসেবে চাকরি করেন আর তারা রাজনীতি করে জনপ্রতিনিধি বনে যান। তাদের মতমতের ভিত্তিইে সরকার পরিচালিত হয়। আর তাদের স্বল্পশিক্ষা আর কূপমণ্ডূকতার কারণে ভিন্নমত প্রকাশ অমার্জনীয় অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। বিরোধী রাজনীতি করা অপরাধ বলে গণ্য হয়। আর এসব কাজ যখন তারা করেন তখন ভুলে যান, একসময় ভিন্নমত পোষণ করলে আর বিরোধী দল হলে তাদেরও এই অবস্থা হবে। 

এ এক অভিন্ন চিত্র, অতীতে যা হয়েছে এখনো তাই হচ্ছে। তারপও বলি, এতসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও, সারা বিশ্বে গণতন্ত্র এখনো সবচেয়ে জনপ্রিয় জননন্দিত শাসনব্যবস্থা। কারণ এখানে ভোটের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ রয়েছে। আর এ সুযোগ আছে বলেই জনগণের কাছে জবাবদিহিতা আছে। আর জবাবদিহিতা আছে বলেই রাষ্ট্রের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। এখানেই এ শাসন ব্যবস্থার মৌলিকত্ব, বিশেষত্ব ও গুরুত্ব। ভোটের মাধ্যমে জনগণ মত প্রকাশে বা সঠিক রায় প্রদানে ভুল করলেও সেটা গণতন্ত্র এবং জনগণের শাসন। এই গণতান্ত্রিক যুগে, আমরা অতীতের রাজতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র বা সামরিকতন্ত্রের কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারি না।

তবে সব শেষ কথা একটাই, গণতন্ত্রে ভিন্নমত, ভিন্ন বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া জরুরি। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি প্রাধান্য দেওয়া জরুরি। তবে সে মতামত যদি হয় সত্য ন্যায় স্বাধীনতার বিপক্ষে, মৌলবাদ আর প্রতিক্রিয়াশীলতার পক্ষে সেটা কিন্তু  মেনে নেওয়া মোটেই জরুরি নয়। কারণ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় কথা, সত্য সুন্দর আর ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা। স্বাধীনভাবে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকা।

 

লেখক : কথাশিল্পী ও গবেষক

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads