• শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪২৯

বিবিধ

তিন গুণীর ঈদভাবনা

  • প্রকাশিত ৩০ এপ্রিল ২০২২

সিরাজুল ইসলাম চৌধূরী :  ঈদের ভাবনাটাই আলাদা। এর সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্যটাই প্রধান। এটা হচ্ছে একটা সামাজিক মিলনের জায়গা। এখানে এই যে নামাজ থেকে শুরু করে বাড়িতে আত্মীয়স্বজন আসা, আত্মীয়স্বজনের বাসায় যাওয়া, এগুলো হচ্ছে একটা সামাজিক ব্যাপার। ঈদের জামাতেও অনেক মানুষ একসাথে হয়। তার পরে আত্মীয়ের বাড়ি যায় এবং নিজের বাড়িতে অন্য আত্মীয়রা আসে।

এই যে মেলামেশাটা, এর ফলে একটা সৌজন্যবোধের সুযোগ তৈরি হয় ঈদে। এমনিতে তো যোগাযোগগুলো খুব কম, কিন্তু ঈদে এই যোগাযোগটা আরো বেশি ঘটে। এটাই হচ্ছে ঈদের প্রধান ব্যাপার। এছাড়া ঈদ হচ্ছে শিশু এবং কিশোর-কিশোরীদের জন্য। তারাই এটা সবচেয়ে বেশি উপভোগ করে। তারা জামাকাপড় উপহার পায়, এটার মধ্যে একটা আনন্দের ব্যাপার আছে। এর জন্য তারা অপেক্ষা করতে থাকে। আর প্রবীণদের মধ্যে এটা সৌজন্য এবং সম্প্রীতি বৃদ্ধি করার ক্ষেত্রে একটা বড় ভূমিকা রাখে। আজকাল সরাসরি যোগাযোগটা কমে যাচ্ছে মানুষের সাথে মানুষের। এ উপলক্ষে সেই যোগাযোগটা হয়। আরো একটা ব্যাপার এই যে, যারা শহরে থাকে, যাদের ঘরবাড়ি গ্রামে তারা ওইখানে চলে যায়; এবং সেই চলে যাওয়াটা একটা মিলনের ব্যাপার হয় তাদের জন্য। তারা আত্মীয়স্বজনের মাঝে একসাথে মিলতে পারে। তো এই মেলাটা তো একটা বড় সুযোগ, ঈদ এই সুযোগটা করে দেয়।

সেলিনা হোসেন : মুসলিম সম্প্রদায়ের বড় উৎসব হচ্ছে ঈদ। যদিও ধর্মীয় উৎসব, তবু তাকে কেন্দ্র করে আমাদের সাহিত্যও একটা জায়গা করে নিয়েছে। এই উৎসবের সঙ্গে সাহিত্যের সম্পর্ক থাকতে পারে এমন চিন্তা যারা করেছিলেন, তারা আমার নমস্য। ঈদ মানে ঈদগাহে যাওয়া, নতুন কাপড় কেনা, সেমাই-ফিরনি, পোলাও-কোর্মা রান্না— এই সঙ্গে একটি ঈদসংখ্যা প্রকাশ এবং বিপণন করে বাঙালির সাংস্কৃতিক রুচির সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া নিঃসন্দেহে অভিনব।

ষাটের দশকের শুরুর দিকের কথা। আব্বার চাকরি সূত্রে থাকতাম রাজশাহী শহরে। মফস্বল শহরে বসে প্রথম যে ঈদসংখ্যাটি হাতে পাই, সেটি ছিল নূরজাহান বেগম সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকা। ষাটের দশকের মধ্যভাগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। কলেজে পড়ার সময় থেকে কবিতা লিখে খাতা ভরতে শুরু করেছি। ওই খাতা যথারীতি লুকিয়ে রেখেছি দীর্ঘকাল। এর পাশাপাশি পরিবারের সবাইকে লুকিয়ে ঢাকায় ‘বেগম’ পত্রিকা, দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকী কিংবা মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ সম্পাদিত ‘পূবালী’ সাহিত্য পত্রিকায় লেখা পাঠিয়েছি। ছাপা হয়েছে। ছাপার অক্ষরে নিজের লেখা দেখে বিস্ময়ে তাকিয়ে থেকেছি।

ওই সময় আমার প্রধান আকর্ষণ ছিল ঈদসংখ্যা ‘বেগম’। বেশ বড় আকারে ‘বেগম’ প্রকাশিত হতো। এর সঙ্গে লেখকদের ছবি ছাপা হতো কয়েক পৃষ্ঠাভরে। লেখাপড়ার পাশাপাশি লেখকদের ছবি দেখাও ছিল আনন্দের ব্যাপার। আর নিজের ছবি? দেখে তো শেষ করতে পারতাম না। তরুণ বয়সে নিজের একটি ছবি ছাপা হয়েছে ভাবতে এখনো রোমাঞ্চিত হই। মনে হয়, লেখালেখির জীবনে সেটি ছিল একটি উল্লেখযোগ্য সময়। ‘বেগম’-এর ঈদসংখ্যা কেন্দ্র করে এই স্মৃতি এখনো আমার গভীর আনন্দের জায়গা।

শুরু করেছিলাম ষাটের দশক দিয়ে। সময় পার হয়ে গেছে পঞ্চাশ বছরেরও বেশি। বদলেছে ঈদসংখ্যার চরিত্র, আকার, প্রকাশনা সৌষ্ঠব এবং সাহিত্যের অনুষঙ্গ। বাণিজ্য ঢুকেছে প্রবলভাবে। এর পাশাপাশি পাঠকসংখ্যা বেড়েছে। ষাটের দশকে বাণিজ্য ছিল না। তবে জনসংখ্যা কম ছিল বলে পাঠকের সংখ্যাও কম ছিল। এখন বাজারে ঈদসংখ্যা নিয়ে প্রতিযোগিতার জোয়ার। তারপরও বলব, বাণিজ্যের বাইরে এই সংখ্যাগুলোর কিছু ইতিবাচক দিক আছে। এক ফুঁয়ে আমি পণ্যের দরে বিকিয়ে দিতে চাই না। এই সংখ্যাগুলোয় নতুনরা উঠে আসবে। ঈদ সংখ্যাগুলোয় বিষয়ে বৈচিত্র্য দেখা যায়। সাহিত্যের গবেষণা, ইতিহাস, বিজ্ঞান, পরিবেশ, মুক্তিযুদ্ধের নানা দিকসহ অনেক কিছু তুলে আনার চেষ্টা করা হয় ঈদসংখ্যায়। এমনকি লেখকদের আত্মজীবনী লেখার আগ্রহ বেড়েছে এসব সংখ্যায়।

সাংস্কৃতিক রুচি তৈরিতে এই সংখ্যাগুলো উৎসবের একটি বেশ বড় দিক বলা যায়। মধ্যবিত্তের নানা সওদার সঙ্গে একটি ঈদসংখ্যা এই সময়ের বাংলাদেশের নতুন সংযোজন আর বলা যাবে না। এর একটি চরিত্র দাঁড়িয়ে গেছে। ঈদসংখ্যা কেন্দ্র করে ইফতার পার্টির আয়োজন লেখক-পাঠকের বাড়তি আয়োজন। সামাজিক সম্প্রীতির একটি জায়গা নিঃসন্দেহে। 

আবুল মোমেন : মনে পড়ে ছেলেবেলার ঈদ। ঈদের দিন মা কোন ভোরে জেগে যেত তা আমরা বুঝতাম না। পাড়ার সবার আগে তাঁর দু’রকম সেমাই— আমাদের ভাষায় পোলাও সেমাই আর দুধ সেমাই— রান্না হয়ে যেত। অন্তত কাজিবাড়িতে দু’রকম সেমাই-ই পৌঁছে যেত সবার আগে। ওঁদের প্রতিদান আসত আরও বেলা করে। এর মধ্যে একটা অলিখিত প্রতিযোগিতা ছিল এবং মা প্রতিবারই বিজয়ীর তৃপ্তি পেত। আমরা সকালের আলো বাড়ার পরে রান্নাঘরের টুংটাং শব্দে জেগে উঠতাম। অন্যান্য দিন এসব শব্দকে উৎপাত মনে হলেও আজ ঈদের সকালে এর মাধুর্যটা ধরা পড়ে। ধ্বনির মধ্যেও যেন মাতৃত্ব মিশে থাকে। ভাবি কতভাবেই না মানুষ মাকে পায়।

গোসল সেরে সেমাই মুখে দিয়ে নতুন জামা পরে বাবার সাথে ঈদের জামাতে যাওয়া পরের কাজ। আমাদের গন্তব্য পাড়ার মসজিদ। বাবা ভিতরে খাসমহলে চলে যাবেন, আমরা দু’ভাই বাইরে ঈদ উপলক্ষে বিছানো চাটাইয়ে পাড়ার অন্যান্য পোলাপানের সাথে থাকব। নামাজ শেষে বাবাকে দেখতাম অনেকের সাথে কোলাকুলি করছেন। ছোটরা সেকালে তেমন কোলাকুলি করত না। ছোটদের তখন দুটি নিশানা— কোথায় সালাম করে ঈদি পাওয়া যাবে আর মুখরোচক কী খাওয়া মিলবে। তবে মানতে হবে সেকালে আদরযত্ন ছিল। আদরে ও যত্নেই, তার প্রকাশ টাকা-পয়সায় ছিল না। মা দিত মাথাপিছু চার আনা, বাবা কিছু না মৃদু হাসি ছাড়া, ইউসুফমামা সাধারণত দু’আনা দিত, যেবার ভাবত চার আনা করে দেবে সেবার কিন্তু ইংরেজি ট্রান্সলেশন ধরত আগে। সে পরীক্ষায় উতরে তারপর চার আনা পেতে হতো। দূরের অভিযান হতো অবশ্য দুপুরের খাওয়ার পরে। তার আগে জামাত থেকে বাড়ি ফিরে দেখতাম মমিআপা এবং মা গোসল সেরে নতুন কাপড় পরে তৈরি। পাঁচ ভাইয়ের একমাত্র বোন, মামাদের প্রথম ভাগ্নি, তাই আদর বেশি। ওর জামা সেলাই হতো বিশেষ দোকানে। মা পড়ত বাবার পছন্দের লালপেড়ে সাদা শাড়ি। কিংবা স্নিগ্ধ কোনো রঙের শাড়ি। গোসল সেরে কোঁকড়া চুল পিঠে ছড়িয়ে মা অপেক্ষা করত আমাদের আর অতিথিদের জন্যে। বাবার হিন্দু বন্ধু-গুণগ্রাহীরা ফুল নিয়ে আসতেন, সেমাই খেতেন। আর অবশেষে বিকেলে দূরের বাড়িগুলোয় অভিযানে নামতাম আমি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads