• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
শ্রমিক নৈরাজ্যে সড়কে ভোগান্তি

শ্রমিক নৈরাজ্যে সড়কে ভোগান্তি

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

অ্যাম্বুলেন্সেই মারা গেল সাত দিনের শিশু

শ্রমিক নৈরাজ্যে সড়কে ভোগান্তি

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ অক্টোবর ২০১৮

সড়ক পরিবহন আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনসহ আট দফা দাবিতে শ্রমিকদের ডাকা দুই দিনের কর্মবিরতি কার্যত ধর্মঘটে রূপ নিয়েছে। শ্রমিকদের নৈরাজ্যকর কার্যকলাপে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সারা দেশের মানুষ। রোববার সকাল ৬টা থেকে পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টা পরিবহন শ্রমিকদের কাজে যোগ না দেওয়ার ঘোষণা থাকলেও প্রথম দিনই সড়কে অবস্থান নিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে বাধা দিয়েছে শ্রমিকরা। মৌলভীবাজারে দফায় দফায় বাধা দেয়ায় অ্যাম্বুলেন্সের ভেতর মারা গেছে সাত দিনের শিশু। ব্যক্তিগত বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গাড়ির চালকসহ যাত্রীদের মুখে পোড়া মবিল লাগিয়ে স্থাপন করেছে অরাজকতার চূড়ান্ত নজিরও। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন মালিক ও শ্রমিক ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের ইন্ধনেই ‘বেপরোয়া’ শ্রমিকরা দেশবাসীকে ‘জিম্মি’ করার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের আহ্বান উপেক্ষা করেই ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণাও দিয়েছেন শ্রমিক নেতারা।

টানা ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতির প্রথম দিনে রোববার দিনের শুরুতেই ভোগান্তিতে পড়েন জীবিকার তাগিদে রাস্তায় বের হওয়া মানুষ। রাজধানী ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে কিছু রিকশা চলাচল করলেও অফিসগামী যাত্রী আর স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের যানবাহনের আশায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় মোড়ে মোড়ে। অনেকে পায়ে হেঁটেই রওনা দেন গন্তব্যে। কেউ বেশি ভাড়ায় রিকশা অথবা সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যান গন্তব্যে। রাজধানীর মতো একই অবস্থা সারা দেশেই। দেশের কোথাও কোনো ধরনের গণপরিবহন চলাচল করতে দেয়নি শ্রমিকরা। কোনো কোনো জেলায় ব্যক্তিগত অটোরিকশা থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের গাড়িতেও হামলা করেছে উচ্ছৃঙ্খল শ্রমিকরা। ঠাকুরগাঁও ও নারায়ণগঞ্জে অ্যাম্বুলেন্স চালকসহ অটোরিকশার যাত্রীদের মুখে পোড়া মবিল লেপনের ‘জঘন্য’ উৎসবে মেতে ওঠে তারা।

তবে পুলিশের দাবি, তারা সামর্থ্য অনুসারে যাত্রীসাধারণকে সেবা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মঘটের কারণে সড়কে যেন কোনো অরাজকতা তৈরি না হয় সেটা পর্যবেক্ষণ করছেন তারা।

নজিরবিহীন নৈরাজ্য : রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, নারায়ণগঞ্জ, ঠাকুরগাঁওসহ দেশের বেশ কিছু এলাকায় চালকসহ যাত্রীদের মুখে পোড়া মবিল, কালো রঙ ও আলকাতরা মাখিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। যাত্রীদের বলপূর্বক নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে রিকশা-ভ্যান থেকেও। অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা থেকে রক্ষা পাচ্ছে না রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাসও। এদিকে শ্রমিকদের এই অরাজকতার খবর ও ছবি সংগ্রহ করতে গিয়ে হেনস্তার শিকার হয়েছেন অনেক সংবাদকর্মীও। রোববার সকালের দিকেই রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় এক আলোকচিত্রীর ক্যামেরা কেড়ে নেয় এবং মোটরসাইকেলের চাবি আটকে রাখে। প্রায় আধা ঘণ্টা আটকে রাখার পর আলোকচিত্রীর অনুরোধে তার বাইকের চাবি ও ক্যামেরা ফেরত দেয় শ্রমিকরা। তবে ওই সাংবাদিককে শ্রমিকরা বলে, ‘তোদের মতো সাংবাদিক দরকার নাই। তোরা সরকারের দালাল, তোরা আমাদের কথা লেখিস না, তোদের ছবি তোলার দরকার নাই।’

বাংলাদেশের খবরের বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিরা স্থানীয় যাত্রী-চালকদের বরাতে জানিয়েছেন দাবি আদায়ের নামে ‘বেপরোয়া’ শ্রমিকরা কোণঠাসা করে রেখেছে দেশবাসীকে। রাস্তায় রাস্তায় চালাচ্ছে অরাজকতা। তবে ধর্মঘট আহ্বানকারী বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেড়ারেশনের ভাষ্য, তারা আশঙ্কা করছে, আন্দোলনকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে এসব ঘটনা ঘটানো হতে পারে। এর পেছনে কোনো চক্রান্ত থাকতে পারে বলেও ধারণা তাদের।

অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই মারা গেল সাত দিনের শিশু : কর্মবিরতির নামে সড়কে শ্রমিকদের নজিরবিহীন নৈরাজ্যে দফায় দফায় আটকা পড়ে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরেই মারা গেল সাত দিন বয়সী এক শিশু। গতকাল রোববার মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার চান্দগ্রাম এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

মৃত শিশুটি বড়লেখা সদর ইউনিয়নের অজমির গ্রামের কুটন মিয়ার মেয়ে। শিশুর চাচা আকবর আলী জানান, সাত দিন আগে শিশুটির জন্ম হয়েছিল। এখনো তার নাম রাখা হয়নি। শনিবার রাত থেকে সে কোনো কিছু খাচ্ছিল না, শুধু কাঁদছিল। রোববার সকালে তাকে উপজেলা হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে দ্রুত সিলেট নেওয়ার জন্য বলেন। অ্যাম্বুলেন্সে করে সিলেটের উদ্দেশে রওনা দেওয়া হয়। তবে বড়লেখা উপজেলার দরগাবাজারে গেলে অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দেয়। দাসেরবাজার এলাকায় আবারো অ্যাম্বুলেন্সটি আটকে দেয় শ্রমিকরা। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে চান্দগ্রাম বাজারে গেলে আবারো গাড়িটি আটকায় শ্রমিকরা। এ সময় সেখানে চালককে মারধর করা হয়। সেখান থেকে ছাড়া পেয়ে শিশুটিকে বিয়ানীবাজার হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

আকবর আলী জানান, এ ঘটনায় তারা থানায় অভিযোগ করেছেন। কুলাউড়া সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু ইউসুফ বলেছেন, বিষয়টি অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং দুঃখজনক। এ ঘটনায় অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

 

পথে পথে ভোগান্তি : শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকা এই ধর্মঘটে রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ বিভাগীয় শহরেও বাসিন্দাদের পোহাতে হয়েছে চরম দুর্ভোগ। বিভাগীয় শহরগুলোর পাশাপাশি জেলা বা উপজেলা পর্যায়েও ভয়ংকর ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। দূরপাল্লার কোনো যানবাহন চলাচল না করায় অনেকেই গন্তব্যে যেতে পারেননি। আবার একান্ত প্রয়োজনে যারা পথে নেমেছেন, পেয়েছেন দুএকটি অটোরিকশা বা মোটরসাইকেল তাদের গুনতে হয়েছে কয়েকগুণ বাড়তি ভাড়া।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে মতিঝিলে পৌঁছাতে অন্য দিনের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি ভাড়া গুনতে হয়েছে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা নূর হোসেন মাসুমকে। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, অন্য দিন পাঁচ মিনিটের মধ্যে বাস পেয়ে যাই। আজ বাস পাইনি। এরপর সিএনজির জন্য প্রায় আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পরে স্বাভাবিকের দ্বিগুণ ভাড়ায় সেটিতে অফিসে পৌঁছেছি। এমনিতে বাসে ২০ টাকা ভাড়া দেই। কিন্তু আজ (গতকাল রোববার) ৩০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। গাবতলী থেকে পাটুরিয়া ঘাটে যেতে ৬০ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ টাকার ভাড়ার জায়গায় গতকাল গুনতে হয়েছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা।

শুধু ঢাকায়ই নয়, চট্টগ্রাম, খুলনা, কুমিল্লা, রাজশাহী, সিলেট, রংপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, গাজীপুর, মানিকগঞ্জ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, কুমিল্লা, ফেনী, চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, বগুড়া, নীলফামারী, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর, কুষ্টিয়া, ঝিনাইদহ, পাবনা, নাটোরসহ দেশের অনেক জেলার বাসিন্দাদের পোহাতে হয়েছে নানা দুর্ভোগ। গন্তব্যে যেতে গুনতে হয়েছে স্বাভাবিকের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি ভাড়া। অনেকে আবার পরিবহন সঙ্কটের কারণে যেতে পারেননি গন্তব্যে। তাই শ্রমিকদের অযৌক্তিক এই ধর্মঘটের নিন্দা জানিয়েছেন তারা।

ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার হুমকি : আইন সংশোধনের জন্য সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় শ্রমিকদের সঙ্গে না বসা পর্যন্ত সারা দেশে পরিবহন ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী। সংসদের চলতি অধিবেশনে আইন পরিবর্তন করে শ্রমিকদের দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব নয় জানিয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের আহ্বান জানানোর পর তার এমন প্রতিক্রিয়া এলো। রোববার সন্ধ্যার দিকে তিনি বলেন, আমরা কি আওয়ামী লীগবিদ্বেষী লোক? ২০১৩-১৪ সালে কি আমরা জীবন দিয়ে বিরোধী দলের অবরোধ ঠেকাইনি? কারো সঙ্গে আমাদের বিরোধ নেই। উনাদের (সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়) সঙ্গে বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি চলবে।

গত ২৯ জুলাই রাজধানীতে বাসচাপায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর সারা দেশে শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার দীর্ঘদিন ধরে ঝুলিয়ে রাখা সড়ক পরিবহন আইন পাস করে। কিন্তু ওই আইনের কয়েকটি ধারা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে সেগুলো বাতিল করার দাবি তুলেছে পরিবহন শ্রমিকরা।

তাদের দাবিগুলো হলো— সড়ক দুর্ঘটনার সব মামলা জামিনযোগ্য করা, দুর্ঘটনায় চালকের পাঁচ লাখ টাকা জরিমানার বিধান বাতিল, চালকের শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণির পরিবর্তে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত করা, ৩০২ ধারার মামলার তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখা, পুলিশি হয়রানি বন্ধ, ওয়েট স্কেলে জরিমানা কমানো ও শাস্তি বাতিল এবং গাড়ি নিবন্ধনের সময় শ্রমিক ফেডারেশন প্রতিনিধির প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক করা। এসব দাবিতে রোববার সকাল থেকে পরিবহন শ্রমিকদের ৪৮ ঘণ্টার কর্মবিরতিতে সারা দেশে দূরপাল্লার বাস ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত গাড়ি চলাচলেও বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads