• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
ফুসফুসে জমছে বিষাক্ত ধূলিকণা

শীতের মৌসুমে কুয়াশার চাদরে ঢাকার কথা থাকলেও সববিছুই ঢেকে যাচ্ছে ধুলার চাদরে

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

উন্নয়নকাজে বিকল্প নেই, দুর্ভোগে হাঁসফাঁস

ফুসফুসে জমছে বিষাক্ত ধূলিকণা

  • বিশেষ প্রতিনিধি
  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

যানবাহন ও জনসাধারণের স্বাভাবিক চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে একের পর এক উন্নয়নকাজ চলায় চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে রাজধানীবাসী। চলাচলের ‘বিকল্প’ ব্যবস্থা না করেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে চলছে উন্নয়নকাজ। যে কারণে তৈরি হচ্ছে যানজট, আর স্বাভাবিক চলাচলে বছরের পর বছর জুড়ে চলছে অন্তহীন বিড়ম্বনা। ধুলায় ধূসর রাজধানীর বাতাস গিলতে গিলতে হাঁসফাঁস করছে ঘরের বাইরে থাকা মানুষ।

গত ১০ বছর ধরেই একটানা চলছে এই উন্নয়ন-বিড়ম্বনা। সবার প্রশ্ন- এর শেষ কোথায়? সাধারণ মানুষ বলছে- ‘এত দুর্ভোগের বিনিময়ে উন্নয়ন! উন্নয়নের জন্য কি ‘বিকল্প’ ব্যবস্থা নেই?’ ঘরের বাইরে এলেই উন্নয়নকাজের ধুলা আর বর্জ্যের ধুলা বাতাসে একাকার হয়ে মানুষের ফুসফুসে গিয়ে জমছে।

সংস্কার ও মেরামতকাজে লাগাতার রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, ওয়াসার পানি ও স্যুয়ারেজ লাইন, তিতাসের গ্যাস লাইন, পিডিসি ও বিটিসিএলের নতুন ক্যাবল লাইন বসানো এবং মেরামতের কর্মযজ্ঞ আছে প্রায় বছরজুড়েই। স্যুয়ারেজ লাইনের ম্যানহোলের পাশে ছোট ছোট বর্জ্যের স্তূপ দীর্ঘদিন পড়ে থাকায় এক সময় পদপিষ্ট হয়ে ধূলি আকারে বাতাসে মিশে প্রবেশ করছে মানবদেহে, যা মারাত্মক ক্ষতিকর।

বাসাবো এলাকার বাসিন্দা মো. মাসুদ রানা জানান, ‘ব্যবসায়িক প্রয়োজনে প্রতিদিন ঘর থেকে বের হতে হয়। কিন্তু বাইরে গিয়ে স্বাভাবিক নিঃশ্বাস নিতে পারি না। মনে হয় দম আটকে আসছে। যাদের জন্য উন্নয়ন সে মানুষগুলোর প্রতি এত অবহেলা উন্নয়নকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে।’

এদিকে রাজধানীর মিরপুর-পল্লবী থেকে প্রেস ক্লাব-মতিঝিলমুখী গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিতে মেট্রোরেলের নির্মাণকাজ চলায় সড়কটি যান চলাচলে প্রায় অযোগ্য হয়ে পড়েছে। খিলগাঁও, কমলাপুর, আরামবাগ, মতিঝিল, ধানমন্ডিসহ কিছু এলাকায় কাজ শেষে খোঁড়া গর্তে মাটি উঁচ-নিচুু করে রাখায় ঝুঁকির মুখে পড়ছে যানবাহন চলাচল।

আরামবাগের বাসিন্দা ব্যবসায়ী আবু সেন মামুন জানান, ‘প্রতিবছর শুকনো মৌসুমের একেবারে শেষ দিকে শুরু হয় বেশিরভাগ সংরক্ষণ ও মেরামতের কাজ। এ সময় বয়ে যাওয়া দমকা বাতাসে খোঁড়া রাস্তার ধূলিতে ঢাকার আকাশ অন্ধকার হয়ে যায়। ধূলিঝড়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে ঢাকার মানুষ।’ আবার উন্নয়নকাজ শেষ হওয়ার আগেই এসে পড়ে বর্ষাকাল। তখন কাদা আর পানিতে রাস্তাঘাট সয়লাব হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় ঢাকার মানুষদের।’

অন্যদিকে বেশিরভাগ উন্নয়নকাজের বর্জ্য দীর্ঘদিন ফেলে রাখা হয় সড়কে। এসব নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্বে অবহেলা আর সমন্বয়হীনতা লক্ষ করা যায় এসব বর্জ্য পরিষ্কারের ক্ষেত্রে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ আজ রাজধানীমুখী। দেশের মফস্বল শহরে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা অপ্রতুল থাকায় তারা সন্তানের ভালো লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য রাজধানীমুখী হয়।

নিম্নবিত্তরা ঢাকায় আসেন জীবিকার তাগিদে। কারণ কর্মসংস্থানের সহজলভ্যতা। আবার ছিন্নমূল মানুষের ভিড়ও কম নয় এই শহরে। তাই ঢাকা আজ বিশ্বের অন্যতম জনবহুল শহর। নিত্যনতুন বাড়তি মানুষের চাহিদা মেটাতে এখানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে বৈধ-অবৈধ স্থাপনা আর বাজারঘাট। প্রতিদিন বাড়ছে যানবাহনের সংখ্যাও। জনসংখ্যার ভারে প্রায় বিপর্যস্ত ঢাকা। বিপুল পরিমাণ মানুষের বর্জ্য আর পরিবহনের ধোঁয়া আর তাপ-দূষণে ঢাকার প্রকৃতি আজ ভারাক্রান্ত। দুর্বিষহ হয়ে উঠছে নগরবাসীর জীবন। আগামী বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মের কাঠফাটা গরমেও দুঃসহ হয়ে উঠবে প্রাণ। আর নিত্যদিনের রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ভোগান্তি যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের প্রথম সহসভাপতি নগর বিশ্লেষক মো. আকতার মাহমুদ বাংলাদেশের খবরকে বলেন, নগরের কিংবা নগরের বাইরে যেকোনো উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার আগে তার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়। ঢাকার ক্ষেত্রেও তাই হয়। তবে আমরা যেটা দেখছি, এটি এখানে কার্যকর হয় না। এমনকি আমরা জানিও সেখানে কী বলা আছে। একটি উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নকালে কী ঝুঁকি তৈরি হতে পরে, চ্যালেঞ্জগুলো কী হতে পারে, তা বিবেচনায় নিয়ে বিকল্প ব্যবস্থাপনা রাখার কথা বলা হয়। কিন্তু সেটি ঢাকায় খুব বেশি করা হয় না।

এই নগর পরিকল্পনাবিদ বলেন, ঢাকায় এমনিতে যানজট অসহনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার ওপর বিভিন্ন সংস্থার আলাদাভাবে ও সমন্বয়হীনভাবে উন্নয়ন কার্যক্রম ভোগান্তিকে চরমে নিয়ে যায়। ব্যবস্থাপনা উন্নতি করলে এর থেকে কিছুটা রেহাই পাওয়া যেতে পারে। এদিকে সরকার ও নগর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষকেও নজর দিতে হবে।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, অপরিকল্পিত এবং দীর্ঘমেয়াদি রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির দুর্বিষহ যন্ত্রণা আর ভোগান্তি থেকে রাজধানীবাসীকে বাঁচাতে সেবা খাতের সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় করা বিশেষ জরুরি। এখানে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষের চাওয়া-পাওয়া খুব বেশি নয়। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে জনগণ ত্যাগ স্বীকার করতে সর্বদা প্রস্তুত। কিন্তু তা করতে গিয়ে নগরবাসীকে কেন চরম মূল্য দিতে হবে? কর্তৃপক্ষ আর কতদিন নজর এড়িয়ে থাকবে?

অপরদিকে বর্ষা মৌসুমে সড়ক খোঁড়াখুঁড়ির কাজ বন্ধ রাখার কথা থাকলেও গত দুই বছর ধরে তা মানা হচ্ছে না। এমনিতেই বর্ষা মৌসুমে উন্নয়নকাজ করতে নানা রকমের সমস্যা তৈরি হয়। বর্ষায় কাজ চলাকালেও জনদুর্ভোগ অনেকাংশে বেড়ে যায়।

পল্টনের ব্যবসায়ী কৃষিবিদ আমিনুর রহমান খান বলেন, ‘আমরা দেখেছি পরিকল্পনা ঠিক না থাকায় একই কাজ কয়েকবার করতে হয়েছে। এভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়রোধে জুন-জুলাইয়ের পরিবর্তে বাংলাদেশের অর্থবছরকে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর করলেই ভালো হয়। সরকারের সংশ্লিষ্টরা ব্যাপারটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করলে হয়তো রাষ্ট্রীয় অর্থের সাশ্রয় হবে। এছাড়া রাজধানীর সেবা সংস্থাগুলো উন্নয়নকাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা সৃষ্টির মাধ্যমে করলে উদ্ভূত সমস্যার উত্তরণ সম্ভব হবে।’

অপরদিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত মেয়র মোস্তফা জামাল এই প্রতিবেদককে বলেন, আমরা বিভিন্ন সময় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাগিদ দিয়ে থাকি। ঠিকাদারসহ সবাইকে তাগাদার ওপরে রাখা হচ্ছে যাতে দ্রুত উন্নয়নকাজগুলো শেষ করা হয়। তবে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পেতে কিছুটা ভোগান্তি আমাদের মেনে নিতে হবে। সেটি না মানলে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা যাবে না। যা কাজ হচ্ছে তা নগরের মানুষের জন্যই করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads