• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
আশা জাগাচ্ছে বুড়িগঙ্গা

আজ থেকে ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীর দুই প্রান্তে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনার বিরুদ্ধে চিরুনি অভিযান

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

আজ থেকে চিরুনি অভিযান

আশা জাগাচ্ছে বুড়িগঙ্গা

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

নিষ্প্রাণ বুড়িগঙ্গার প্রাণ ফেরাতে চলছে নদীর দুই তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। প্রভাবশালী দখলদারদের কবল থেকে বুড়িগঙ্গাকে সাজাতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগও। দখলমুক্ত করেই এসব জায়গায় নির্মাণ করা হবে ওয়াকওয়ে ও বাগান। বাবুবাজার ব্রিজ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত হাতিরঝিল প্রকল্পের আদলে এলাকাটি গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে সরকারের। এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বুড়িগঙ্গায় শুরু হয় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান। ফলে নগরবাসীর মনে নতুন আশা জাগাচ্ছে বুড়িগঙ্গা। 

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাজধানী ঢাকার চারপাশের নদীগুলোকে অবৈধ দখলদারদের থেকে উদ্ধারের জন্য বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়। নদী উদ্ধারে একাধিক অভিযানও শুরু করা হয়। প্রথমদিকে বেশকিছু সাফল্যও দেখা গিয়েছিল। কিন্তু কিছুদূর যেতে না যেতেই তা আবার বন্ধ হয়ে যায়। তবে এবার নতুন উদ্যোগে ও কৌশলে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করে। বিআইডব্লিউটিএ সূত্র জানায়, গত ২৯ থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে কামরাঙ্গীরচর এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়েছে। এ অভিযানে তিন দিনে ছোট-বড় মিলিয়ে ৪৪৪টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার থেকে আবার বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করতে চিরুনি অভিযান শুরু করবে বিআইডব্লিউটিএ। সকাল ১০টায় দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কামরাঙ্গীরচর এলাকায় শুরু হবে দ্বিতীয় দফার চিরুনি অভিযান। ১১ দিনের এই  উচ্ছেদ অভিযান উচ্চ আদালতের নির্দেশে আরো তিন দিন বাড়িয়ে ১৩ দিন করা হয়েছে। আগামী তিন দিন পর্যন্ত দ্বিতীয় দফায় অভিযান চলবে। এরপর ১২, ১৩ ও ১৪ ফেব্রুয়ারি তিন দিন চলবে তৃতীয় দফা অভিযান। আগামী ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারি চলবে চতুর্থ দফা অভিযান। পরবর্তী সময়ে আরো সময় বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে। একই সঙ্গে জলাশয় দখলকারী ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণকারীদের তালিকা প্রকাশ, স্যাটেলাইটের মাধ্যমে দেশের সব নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয়ের ডিজিটাল ডেটাবেজ তৈরি এবং সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিল্প-কারখানায় নিয়মিত সচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে। ৮ দিনব্যাপী এই কার্যক্রম শুরু করবে বিআইডব্লিউটিএ।

বুড়িগঙ্গার দুই তীরের অবৈধ স্থপনা উচ্ছেদ অভিযানের নেতৃত্বে রয়েছেন বিআইডব্লিউটিএ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোস্তাফিজুর রহমান ও সদরঘাট নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন।

চিরুনি অভিযানে ৬০০ অবৈধ ভবন ভেঙে ফেলার টার্গেট নিয়ে অভিযান শুরু হবে জানিয়ে আরিফ উদ্দিন বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা আমরা পালন করছি এবং সামনে করব। কোনো বাধাই আমরা মানব না। উচ্ছেদের জায়গা আর পুনরায় দখল হবে না। সঙ্গে সঙ্গে উদ্ধারের জায়গায় বাগান, ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হবে। পরিবেশ হবে সুন্দর। রক্ষা পাবে বুড়িগঙ্গা। বুড়িগঙ্গার দুই পাড় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করার পর শুরু হবে তুরাগ নদের দুই পাড়ের অবৈধ উচ্ছেদ অভিযান।

তিনি বলেন, প্রথম দফা শুরু হয় ২৯ জানুয়ারি থেকে ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। তিন দিনে ৫, ৩ ও ২ তলা পাকা ইমারত-৩০টি, আধাপাকা ভবন-২৫টি, স’মিল-৬০টি, টিনশেড, টংঘর-১৫টিসহ মোট-১৩০টি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। ভেঙে ফেলা হয়েছে বুড়িগঙ্গা পাড়ের শত শত ভবন। প্রথম দফায় তিন দিনের অভিযানে ৪৪৫ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। দ্বিতীয় দফায় চিরুনি অভিযান শুরু হবে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। চলবে ১৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ অভিযান প্রথম পর্যায়ে ৫ থেকে ৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিন দিন চলবে কামরাঙ্গীরচর হতে বাদামতলী এলাকায়।

বুড়িগঙ্গার দুই পাড় উচ্ছেদ অভিযান আগেও হয়েছে। কিন্তু কয়েক দিনের মধ্যেই অবৈধ দখলে চলে যায়। এ বিষয়ে বিআইডব্লিউটিএ’র চেয়ারম্যান কমোডর এম মোজাম্মেল হক জানান, উচ্ছেদের জায়গায় পুনর্দখল করার আর সুযোগ নেই। নদীর পার উচ্ছেদের জায়গায় সরকারিভাবে তৈরি করা হবে ওয়াকওয়ে ও বাগান। সুন্দর হবে অপরূপ পরিবেশ। তিনি বলেন, নদীর জায়গায় কোনো ধরনের দখল বা স্থাপনা নির্মাণ বেআইনি কাজ। হাইকোর্টের আদেশ বাস্তবায়নে অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা বিআইডব্লিউটিএর নিয়মিত কাজের অংশ বলে তিনি জানান।

পানি বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, দেশ বাঁচাতে হলে নদী বাঁচাতে হবে। এ ব্যাপারে হাইকোর্ট একটা পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। কিন্তু আদালতের দিকনির্দেশনা বাস্তবায়নের দায়িত্ব সরকারের। স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে ভূমি মন্ত্রণালয় নদী খাল জলাশয় রক্ষা করবে। তদারকি করবেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। এ ব্যাপারে তারা আন্তরিক না হলে নদী রক্ষা করা যাবে না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, নদী বাঁচাতে হলে সবার আগে নদীগুলোর অভিভাবক দরকার বলে মনে করেন তিনি। তিনি সবাইকে নদীরক্ষার জন্য আন্তরিক হয়ে কাজ করার আহ্বান জানান।

অনেক আগেই বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে নতুন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার। বিআইডব্লিউটিএ’র সহযোগিতায় বাবুবাজার ব্রিজ থেকে সদরঘাট পর্যন্ত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে হাতিরঝিল প্রকল্পের আদলে এলাকাটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা সিটি করপোরেশনের। এতে নির্মাণ করা হবে বিনোদন কেন্দ্র, ওয়াকওয়ে, ড্রাইভওয়ে। বিশ্বব্যাংক ও ডিএসসিসির যৌথ অর্থায়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে এ প্রকল্পে। মূল অবস্থান ঠিক রেখে সিঙ্গাপুরের কালং ও সিঙ্গাপুর নদী এবং বাংলাদেশের হাতিরঝিলের আদলেই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি সূত্র।

ডিএসসিসির নগরপরিকল্পনা দফতর সূত্র জানায়, মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গার প্রাণ ফিরে আনতেই এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে নদীর স্বাভাবিক গতিপ্রবাহ ফিরে আনা হবে। নান্দনিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হবে পুরো নদীজুড়ে। অবকাশ যাপনের জন্য নদীর তীরে বিলাসবহুল রিসোর্ট, হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে, পার্ক, বসার স্থান, নদীঘাট, পর্যটকদের জন্য প্রমোদতরী, ভাসমান বিনোদন কেন্দ্র ও রেস্তোরাঁ থাকবে। পর্যটকরা যাতে নদীর প্রাকৃতিক রূপ উপভোগ করতে পারেন সেজন্য নদীর দুই পাশের প্রশস্ত সড়কে উন্নত বাস সার্ভিসও থাকবে হাতিরঝিলের মতো।

বুড়িগঙ্গায় উচ্ছেদ অভিযানে নতুন আশার সঞ্চার করেছে নগরবাসীর মনে। তারা মনে করছেন, বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনোদন কেন্দ্র, ওয়াকওয়ে, ড্রাইভওয়ে বাস্তবায়ন হলে ঢাকার চেহারাই বদলে যাবে।

উল্লেখ্য, এক সময়ের প্রমত্তা বুড়িগঙ্গা দখল দূষণে পুরোপুরি নিষ্প্রাণ হয়ে পড়েছে অনেক আগেই। রাজধানীর সদরঘাট থেকে শুরু করে গাবতলী পর্যন্ত বুড়িগঙ্গার দুই তীর প্রভাবশালী দখলদারদের কবলে। পরিকল্পিতভাবে ময়লা আবর্জনা ফেলে এই নদী এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে হয়েছে অনেক আন্দোলন-সংগ্রামও। কিন্তু কোনো কিছুতেই দখলদারদের কবল থেকে মুক্তি মেলেনি বুড়িগঙ্গার। বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। নদীরক্ষায় উচ্চ আদালতও ইতোমধ্যে বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছেন। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে বিআইডব্লিউটিএ বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অব্যাহত রেখেছে। এ ছাড়া হাইকোর্ট নদীরক্ষা কমিশন যাতে নদ-নদী, খাল-বিল ও জলাশয় রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, সেজন্য আইন সংশোধন করে ‘কঠিন শাস্তির’ ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে সরকারকে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads