• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
জাহালমের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি

জাহালম

ছবি : সংরক্ষিত

জাতীয়

জাহালমের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি

  • আজাদ হোসেন সুমন
  • প্রকাশিত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

জাহালম পরিচয়ে ব্যাংকের টাকা আত্মসাৎকারী সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্রের সদস্য আবু সালেক পালিয়ে গেছে। তার বর্তমান অবস্থান জানে না কেউ। পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা তার দেওয়া তিনটি ঠিকানাতেই হানা দিয়েছে। কিন্তু কোথাও সে নেই। তবে তার পরিবারের সদস্যদের বরাত দিয়ে একটি গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছে, সালেক এক বছর ধরে নিরুদ্দেশ রয়েছে। কোথায় আছে কেউ বলতে পারছে না। এক বছর আগে জালিয়াতির বিষয়টি সামনে এলে আবু সালেক আত্মগোপনে চলে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, সে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছে। এদিকে ঘটনা তদন্তে দুদকের একটি তদন্ত কমিটি কাজ করলেও এ ব্যাপারে বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। গত দুই দিন ধরে জাহালমের বিষয়টি বিভিন্ন মহলে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে।

অনেকেই বলছেন- ব্যাংক, দুদক, পুলিশ, আদালত এই চার প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত, বিচক্ষণ সরকারি কর্মকর্তাদের তদন্তের পর পরও আসামি হয়ে নিরপরাধ জাহালমকে তিন বছর জেলে থাকতে হলো? তাহলে ঘটনা কিছুটা রহস্যময় মনে হচ্ছে না তো? জাহালমের এই দুর্ভোগের জন্য যারা দায়ী তারা সালেকের কাছ থেকে সুবিধা পেয়ে এই কাজ করেনি তো? সংশ্লিষ্টদের মতে, সরষেতে ভূত থাকার কারণে এমনটি ঘটেছে। প্রতারক সালেককে সহায়তাদানকারী ব্যাংক ও দুদক কর্মকর্তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনার দাবি তাদের।

সম্প্রতি বিনা বিচারে ২৫ বছর কারাভোগের পর বেকসুর খালাস পেয়ে কুমিল্লার বাঞ্ছারামপুরের বাহারনগর গ্রামের মো. বাবুলের মতো বলতে হয়নি, ‘কেউ কি আমার যৌবন ফিরিয়ে দিতে পারবে?’ এছাড়া ১৩ বছর জেল খাটার পর নির্দোষ প্রমাণিত হওয়া ফাঁসির দণ্ডাদেশ থেকে খালাসের আদেশ কারাগারে পৌঁছানোর আগেই মারা যান সাতক্ষীরার ওবায়দুর রহমান ওরফে অবেদ আলী। তখন সাতক্ষীরার অবেদ আলীর ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচিত হয়েছিল। অবেদ আলীর মৃত্যু ছিল পুরো জাতির জন্য লজ্জা ও কলঙ্কের। জাহালমের ভাই তিন বছর দ্বারে দ্বারে না ঘুরলে, মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকৃষ্ট না হলে কে জানত অসহায় জাহালমকে কী করুণ পরিণতির মুখোমুখি হতে হতো।

জেল থেকে বেরিয়ে জাহালম কান্নাভেজা গলায় সাংবাদিকদের বলেছেন, বিনা দোষে কারাগারে তার কষ্টে দিন কেটেছে। রাতের বেলা বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের কথা মনে করে কেঁদেছেন। জাহালম আরো বলেন, ‘আমার সব সময় মাথায় একটাই চিন্তা আসত, আমি বোধহয় জীবনে আর কোনো দিন জেল থেকে বের হতে পারব না।’

জাহালমের মা মনোয়ারা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ছেলের জন্য কাঁদতে কাঁদতে আমি এখন কাঁদতেও ভুলে গেছি। ছেলে অন্যায় করে জেলে গেলে মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতাম। কিন্তু কী জন্য, কাদের ভুলে আমার ব্যাটাকে এভাবে তিন বছর জেল খাটতে হলো। এর কি কোনো সুরাহা হবে? বড় ভাই শাহানূর মিয়া বলেছেন, মামলা চালাতে গিয়ে ফকির হয়ে গেছি। নির্দোষ ছোট ভাইয়ের মুক্তির জন্য তিন বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরেছি, কিন্তু আমরা গরিব মানুষ, আমাদের কথা শোনার কেউ নেই।

সূত্র জানায়, গত ছয়-সাত মাস আগে দুদক চেয়ারম্যান জানতে পারেন নির্দোষ জাহালমের জেল খাটার কথা। তিনি তখন দুঃখ প্রকাশ করেন। এ ব্যাপারে মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, এটা একটা বড় ধরনের অপরাধ। একজন নিরীহ দিনমজুরের কাছে তিন বছর নয়, যেন ৩০ বছর। ওই তিন বছরে তার মা অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেছেন। স্ত্রী-সন্তান খেয়ে-না খেয়ে দিনাতিপাত করেছে। এজন্য শুধু প্রতারক আবু সালেক নয়, এর সঙ্গে আরো অনেক রাঘববোয়াল জড়িত। তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা উচিত। পাশাপাশি দরিদ্র-নিরপরাধ জাহালমকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। আর এটা করতে গেলে এ ব্যাপারে শিগগিরই একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা উচিত। কারণ, পুলিশের বিরুদ্ধে পুলিশ ও দুদক কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুদক কর্মকর্তা দিয়ে তদন্ত করালে সেখানে ফাঁকফোকর থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে এবং সেই ফোকর গলে প্রকৃত অপরাধীরা বেরিয়ে যেতে পারে।

প্রসঙ্গত, সংঘবদ্ধ জালিয়াত চক্রের সদস্য আবু সালেক পরিকল্পিতভাবে নিজের নাম-ঠিকানার পরিবর্তে জাহালমের নাম ও ঠিকানা ব্যবহার করে। সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। এরপর সালেককে তলব করে দুদক চিঠি দিলে সেই চিঠি পৌঁছায় জাহালমের টাঙ্গাইলের বাড়ির ঠিকানায়। নরসিংদীর ঘোড়াশালের বাংলাদেশ জুট মিলের শ্রমিক জাহালম তখন দুদকে গিয়ে বলেন, আমি একজন সাধারণ জুট মিল শ্রমিক। আমার নামে সোনালী ব্যাংকে কোনো অ্যাকাউন্ট নেই। এমনকি ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট হোল্ডার হিসেবে যে ছবি রয়েছে সেটিও আমার নয়। কিন্তু সেদিন জাহালমের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি। সেদিন দুদকে উপস্থিত বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তারা জাহালমকেই ‘আবু সালেক’ হিসেবে শনাক্ত করেন। পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে  ঘোড়াশাল থেকে জাহালমকে গ্রেফতার করে দুদক। উপায়ন্তর না দেখে জাহালমের বড় ভাই শাহানূর মিয়া গত বছর জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে যান। তার আবেদনে কাশিমপুর কারাগারে গিয়ে জাহালমের সঙ্গে কথা বলেন কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। পরে মানবাধিকার কমিশনের তদন্তে বেরিয়ে আসে আবু সালেক আর জাহালম একই ব্যক্তি নন। সম্প্রতি বিচারপতি এফআরএম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কেএম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ জাহালমকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দিয়ে মুক্তির আদেশ দিলে জাহালম কারাগার থেকে মুক্তি পান।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads