• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
ডানা মেলছে নানা প্রশ্ন

বিমান ছিনতাইয়ের চেষ্টা

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

ডানা মেলছে নানা প্রশ্ন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯

বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাকে ঘিরে সাধারণের মাঝে তৈরি হয়েছে বিভ্রান্তি। চলছে সমালোচনাও। দেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্ক্ষিত এই বিমান ছিনতাইচেষ্টা আশঙ্কা তৈরি করেছে যাত্রীদের মনে। প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে ছিনতাইকারী মাহাদি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বিমানবন্দরে প্রবেশ করল। তার সঙ্গে থাকা পিস্তলটি আসল না নকল তা নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দেওয়ায় আরো জোরালো হয়েছে বিভ্রান্তি। বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে সমালোচনা করছেন বিশিষ্টজনরা। সূত্রগুলো বলছে, এ ঘটনায় সরকার একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি করেছে। কমিটির আহ্বায়ক করা হয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. মোকাব্বির হোসেনকে। পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটিতে রয়েছেন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জনেন্দ্র নাথ সরকার, বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের পরিচালক উইং কমান্ডার চৌধুরী মো. জিয়াউল কবীর, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক এয়ার কমোডর (অব.) মাহবুব জাহান খান ও বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সিনিয়র সিকিউরিটি পরামর্শক গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অব.) মো. আলমগীর।

মন্ত্রণালয়ের আদেশে বলা হয়, কমিটি আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে তাদের তদন্ত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেবে। কমিটিকে আগামীতে এ ধরনের ঘটনা ঠেকাতে সুপারিশ দিতে বলা হয়েছে।

জানা গেছে, তদন্ত কমিটি এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে। গতকাল সোমবার এই কমিটি বিমানবন্দরে সিসিটিভি ফুটেজ পরীক্ষা করে দেখেছে। এ সময় বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এম মাহবুব আলী ও সচিব মহিবুল হকও ছিলেন। সাংবাদিকদের প্রতিমন্ত্রী বলেন, এখানে এমন কোনো লিকেজ ছিল না বা নেই যে একজন যাত্রী এভাবে বিমানে যেতে পারেন।

তাহলে অস্ত্রটা ভেতরে গেল কীভাবে- এ প্রশ্নের জবাবে বিমান সচিব মহিবুল হক বলেন, সেটা অস্ত্র কি না আমরা ওয়াকিবহাল নই। খেলনা পিস্তল কি না... যেকোনো কিছু হতে পারে। তদন্ত প্রতিবেদন পেলে এটা নিয়ে বিস্তারিত বলতে পারব।

তিনি বলেন, আমরা সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজে দেখেছি অন্য ১০ জন যাত্রীর মতো তাকেও তল্লাশি করা হয়েছিল। তার কাঁধে একটা ব্যাগ ছিল। সে স্ক্যানিং মেশিনের ভেতর দিয়ে গিয়েছে। কিন্তু সেখানেও কিছু দেখা যায়নি। প্রতিমন্ত্রী ঘটনার রাতে খেলনা পিস্তল বলে জানালেও গতকাল তার ওই বক্তব্য আর জোর দিয়ে বলেননি।

পিস্তল আসল না নকল- ঘটনার পর থেকে প্রশ্ন জেগেছে তা নিয়ে। এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এসেছে গণমাধ্যমে। প্রায় তিন ঘণ্টার টানটান উত্তেজনার পর চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বাংলাদেশ বিমানের ময়ূরপঙ্খী উড়োজাহাজ ছিনতাইচেষ্টার অবসান হয়। কমান্ডো অভিযানে নিহত হয় কথিত বিমান ছিনতাইকারী পলাশ আহমেদ ওরফে মাহাদি। তার সঙ্গে আর কোনো বিস্ফোরক ছিল না। রোববার মধ্যরাতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ মাহবুবার রহমান এ কথা জানান। তবে গতকাল সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে বলা হয়েছে, এ ব্যাপারে নিশ্চিত না হয়ে বলা যাবে না। কিন্তু বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান বলেন, ছিনতাইকারীর কাছে পিস্তল ছিল। শরীরে বোমা জড়ানো ছিল। একই তথ্য দেন কমান্ডো অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া মেজর জেনারেল মতিউর রহমান। অন্যদিকে র্যাব গতকাল জানিয়েছে, তাদের বোমা ডিস্পোজাল ইউনিট কাজ করে। তার শরীরে বিস্ফোরকসদৃশ যা পাওয়া গেছে তাতে কোনো বিস্ফোরক ছিল না। এটা ফেক একটা জিনিস ছিল। যেখানে ভুয়া তার-সার্কিট দিয়ে ভেস্টের মতো তৈরি করা হয়েছিল।

চার প্রশ্নে তদন্ত : সরকারের গঠিত পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গতকাল সরেজমিন ছুটে যায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। সেখানে তারা সংশ্লিষ্ট ফ্লাইট ঘিরে বিমানবন্দরের ভিডিও ফুটেজ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে। এ ছাড়া শিগগিরই কমিটি ফ্লাইটটির পাইলট মো. শফি ও সহকারী পাইলট মো. জাহাঙ্গীরসহ ক্রুদের সবার সঙ্গে কথা বলবে। কমিটির একটি সূত্র জানায়, চারটি প্রশ্ন সামনে নিয়ে তারা কাজ করবে। প্রথমত, ঘটনার প্রকৃত কারণ উদঘাটন করতে হবে। দ্বিতীয়ত, বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার কোনো ত্রুটি ছিল কি না। তৃতীয়ত, নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে অনাকাঙ্ক্ষিত দ্রব্যাদি বহন করা সম্ভব হলো কীভাবে। চতুর্থত, এই ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে করণীয় ঠিক করা।

বিমানবন্দর পরিদর্শন : গতকাল সকালেই শাহজালাল বিমানবন্দরে ছুটে যান মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট সব কর্মকর্তা। বিমান প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীর নেতৃত্বে তারা বিমানবন্দরের সার্বিক নিরাপত্তা কার্যক্রম পরিদর্শন করেন। এরপর বিমান প্রতিমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি এ সময় বলেন, বিমানবন্দরে যে তল্লাশি ব্যবস্থা, তাতে অস্ত্র নিয়ে উড়োজাহাজে যাওয়া সম্ভব নয়। তল্লাশি ব্যবস্থায় অস্ত্র নিয়ে গেলে তা দৃশ্যমান হয়। সবকিছু খতিয়ে দেখা হয়েছে। অস্ত্র নিয়ে যাওয়ার মতো কিছু পাওয়া যায়নি। এরপর প্রতিমন্ত্রী বিমানবন্দরের তল্লাশি কার্যক্রম কীভাবে কাজ করে, তা সাংবাদিকদের দেখান।

র্যাবের তালিকায় অপরাধী : ঢাকা থেকে দুবাইগামী উড়োজাহাজ ছিনতাইয়ের চেষ্টাকারী পলাশ আহমেদকে ২০১২ সালে এক নারীকে অপহরণের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল। সে সময় তার বয়স ছিল মাত্র ১৮ বছর। গতকাল দুপুরে র্যাব সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক মুফতি মাহমুদ খান। তিনি বলেন, ২০১২ সালের মার্চ মাসে পলাশ আহমেদ ও তার এক সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়। তার অপরাধ ছিল, সে একজন নারীকে অপহরণ করে আট লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। র্যাবের ক্রিমিনাল ডাটাবেজ অনুযায়ী তার জন্মসাল ১৯৯৪। অর্থাৎ ২০১২ সালে গ্রেফতারের সময় তার বয়স ছিল ১৮ বছর। সে সময় গ্রেফতারের পর নিজেকে বিবাহিত বলে দাবি করে পলাশ। শিক্ষাগত যোগ্যতা এসএসসি সমমানের।

নারায়ণগঞ্জের পলাশ ছিনতাইকারী মাহাদি : ছিনতাইয়ের চেষ্টাকালে কমান্ডো অভিযানে নিহত মাহাদির প্রকৃত নাম মো. পলাশ আহমেদ। তাকে শনাক্ত করেছেন তার বাবা। পলাশের বাড়ি নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার পিরোজপুর ইউনিয়নের দুধঘাটা গ্রামে। গতকাল তার বাড়িতে গিয়ে বাবা পিয়ার জাহান সরদারের সঙ্গে কথা বলেন স্থানীয় সাংবাদিকরা। এ সময় তিনি তার ছেলে পলাশের পরিচয়ের বিষয়ে নিশ্চিত করেন। পরিবারের সঙ্গে প্রায় সম্পর্কহীন পলাশের কর্মকাণ্ড নিয়েও কথা বলেন পিয়ার জাহান। তিনি জানান, তার ছেলে  ‘বেয়াড়া’ স্বভাবের ছিল। দুবাই যাওয়ার কথা বলে গত শুক্রবার বাড়ি ছাড়ে পলাশ। গ্রামে পলাশের বাবার একটি মুদি দোকান আছে। তিনি দীর্ঘদিন প্রবাসে ছিলেন। তার স্ত্রী রেণু বেগম। পিয়ার জাহান-রেণু বেগম দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে পলাশ দ্বিতীয়। একটিই ছেলে তাদের। বাকি তিনজন মেয়ে। পিয়ার জাহান বলেন, গতকাল রাতেই তিনি ছেলের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে যান। গভীর রাতে পুলিশ ছবি নিয়ে আসে। তখন তিনি আরো নিশ্চিত হন।

পরিবার থেকে বিছিন্ন ছিল পলাশ : পিয়ার জাহান জানান, স্থানীয় তাহেরপুর সিনিয়র মাদরাসা থেকে ২০১১ সালে পলাশ দাখিল পাস করে। পরে সোনারগাঁ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হয়। প্রথম বর্ষের পর পড়াশোনা বন্ধ করে দেয়। এরপর বাড়ি ছেড়ে ঢাকায় চলে যায়। ঢাকায় কী করত, কোথায় থাকত, সে সম্পর্কে তারা কিছু জানতেনও না। বাড়িতে প্রায় আসতই না। ঢাকায় গান ও অভিনয় করত বলে স্থানীয় লোকজনের কাছে শুনেছেন তিনি। পিয়ার জাহান জানান, গত কোরবানি ঈদের এক মাস আগে এবং এরপর এক সপ্তাহ আগে দুই দফায় পলাশ বাড়ি আসে। পলাশের বাবা জানান, সবশেষ চলতি মাসেই একটানা ১৫ দিন বাড়িতে ছিল পলাশ। এর আগে এতটা সময় সে বাড়ি থাকেনি। দুবাই যাবে বলে মা-বাবাকে জানিয়েছিল। তার এ কথায় কোনো আপত্তি করেননি তারা।

বিয়ে করেছিল চিত্রনায়িকা সিমলাকে : পলাশ আহমেদ ওরফে মাহাদি চিত্রনায়িকা সিমলাকে বিয়ে করেছিল বলে জানান পলাশের বাবা পিয়ার জাহান। তিনি বলেন, সিমলা নামের একটি মেয়েকে পলাশ আমাদের বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। তার প্রেমিকা হিসেবে আমাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মেয়েটি চিত্রনায়িকা হিসেবে জানায় পলাশ। ঠিক তার দুই মাস পর আবারো আসে। তখন জানায় তারা বিয়ে করেছে। গত ১৫-২০ দিন আগে আবার মেয়েটিকে নিয়ে এসেছিল পলাশ। বিষয়টি সম্পর্কে নায়িকা সিমলার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তাকে পাওয়া যায়নি। তিনি দেশের বাইরে আছেন বলে সূত্র জানিয়েছে। তবে সূত্রে জানা গেছে, সিমলাকে বিয়ে করার আগে আরো একটি বিয়ে করেছিল পলাশ।

লাশ মর্গে পড়ে আছে : সবশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পলাশের মরদেহ মর্গে পড়ে আছে। সেখানে এখন পর্যন্ত কোনো স্বজন যোগাযোগ করেননি। এরই মধ্যে লাশের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন শেষ করেছে পুলিশ। সেখানে বলা হয়েছে, তার শরীরে গুলির চিহ্ন পাওয়া গেছে। এদিকে পলাশের বাবা জানিয়েছেন, তারা দেশদ্রোহী এই অবাধ্য সন্তানের লাশ নেবেন না।

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads