• বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জৈষ্ঠ ১৪২৯
প্রমাণ সাপেক্ষেই প্রতিবেদন

চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

ওয়াহেদ ম্যানশন থেকেই আগুন

প্রমাণ সাপেক্ষেই প্রতিবেদন

  • রেজাউল করিম হীরা
  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০১৯

পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার কেমিক্যালের গোডাউন থেকে। ওই ভবনের দোতলায় পারফিউমের ক্যান লিক হয়ে বিস্ফোরক মিশ্রণ তৈরি হয়। এরপর জিপার লক মেশিনে কাজের সময় তাপ ও বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ লেগে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে। এ ছাড়া ওই ভবনে বিপুল পরিমাণে অতি দাহ্য পদার্থ থাকায় চারপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। প্রমাণ সাপেক্ষেই এমন প্রতিবেদন হস্তান্তর করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কাছে।

বিস্ফোরক অধিদফতরের তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গত বুধবার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ে এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। সাত পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে সাত দফা সুপারিশও করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় কেমিক্যাল গোডাউন থেকেই আগুনের সূত্রপাতের বিষয়টি। এর আগে প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া আইইবির (ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশ) তদন্ত প্রতিবেদনেও ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার কেমিক্যালের গোডাউন থেকেই এই অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একই সঙ্গে আইইবির পক্ষ থেকে ৮ দফা সুপারিশ করা হয়।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এ ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছে ৭১ জন। এর মধ্যে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু ঘটে ৬৭ জনের। দগ্ধ ৯ জনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে চারজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তিনজন চিকিৎসা শেষে বাসায় ফিরেছেন। দুজন এখনো চিকিৎসাধীন। এই ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দফতর থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। বিস্ফোরক অধিদফতরের পক্ষ থেকে ৮ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনের ১২ দিনের মাথায় এই প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) পক্ষ থেকেও ছয় সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।

বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রধান পরিদর্শক মোহাম্মদ শামসুল আলম গণমাধ্যমের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব মোহাম্মদ আবদুল হালিমের কাছে এ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়েছে। তদন্তে একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ, আলামত পরীক্ষা এবং অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আগুনের শুরু যে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে হয়নি, সেটাও প্রমাণ হয়েছে।

বিস্ফোরক অধিদফতরের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় রাখা পারফিউমের ক্যান লিক হয়ে বিস্ফোরক মিশ্রণ তৈরি হয়। এরপর জিপার লক মেশিনে কাজের সময় তাপ ও বৈদ্যুতিক স্ফুলিঙ্গ লেগে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে, যা থেকে চারপাশে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। পারফিউম, বডি স্প্রে বা এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানে অন্যান্য পদার্থ ছাড়াও সুগন্ধি বিউটেন, আইসো বিউটেন, আইসো প্রোপাইল অ্যালকোহল, রেকটিফাইড স্পিরিট বিভিন্ন অনুপাতে মেশানো থাকে। বাতাসে এগুলোর অনুপাত ন্যূনতম ১.৯ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে হলেই বিস্ফোরণ মিশ্রণ তৈরির পরিবেশ সৃষ্টি হয়।

আগুন ছড়িয়ে পড়ার কারণ হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলায় প্লাস্টিকের দানার গুদামে অসংখ্য প্লাস্টিকের দানা (পলিইথিলিন) রাখা হতো। তার বিপরীত দিকের ভবনের নিচতলায় রাসায়নিক দ্রব্যসহ প্লাস্টিকের দানার গুদাম ছিল। আগুনে দানা প্রথমে গলে যায়, এরপর অন্যান্য রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে এলে প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। পলিইথিলিনের দহন তাপ বেশি হওয়ায় আগুনের তীব্রতা ও শিখা ছড়িয়ে পড়ার গতি ভয়াবহ ছিল। আগুনে পলিইথিলিন দানা গলে কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড ইত্যাদি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হয়। এর ফলে চুড়িহাট্টা মোড়সহ ওয়াহেদ ম্যানশনের নিচতলার প্যাসেজ ও আশপাশের ভবনের নিচে বিষক্রিয়ায় বহু লোকের মৃত্যু হয়। এছাড়া অক্সিজেন স্বল্পতা এবং শ্বাসনালী পুড়ে যাওয়াসহ প্রচণ্ড আগুনের তাপে দগ্ধ হয়ে অনেকে মারা যান।

বিস্ফোরক অধিদফতরের সাত দফা সুপারিশ মালায় বলা হয়েছে, পুরান ঢাকা এলাকায় দাহ্য ও অতি দাহ্য পদার্থের ছোট ছোট মজুত, কারখানা দ্রুত নিরাপদ কোনো স্থানে সরাতে হবে। অনুমোদনহীন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহারকারী কারখানাগুলোতে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়াতে হবে এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। এছাড়া সব ধরনের রাসায়নিক দ্রব্যের মজুত ও কারখানায় রাসায়নিক দ্রব্যের নাম ও তালিকা সংরক্ষণ প্যাকেজে সতর্কীকরণ চিহ্ন, ম্যাটেরিয়াল সেফটি ডাটাশিট সংরক্ষণের ব্যবস্থা রাখার কথাও বলা হয়।

প্রধানমন্ত্রীর কাছে জমা দেওয়া আইইবির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় বিপুল পরিমাণ অতিদাহ্য পদার্থ মজুত থাকায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। রসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন ভয়াবহ রূপ নেয় ও দ্রুত আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। মসজিদের পাশের সিসিটিভির ফুটেজে দেখা গেছে, বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে এয়ার ফ্রেশনারের ক্যান এসে পড়ছে রাস্তার ওপর। তাতে আপাতদৃষ্টিতে আগুন ওয়াহেদ ম্যানশনের দ্বিতীয় তলা থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এছাড়া বিপুল পরিমাণে অতি দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন লাগার পর বিস্ফোরণে দেয়াল ভেঙে পড়েছে এবং অভ্যন্তরীণ দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। তবে ভেতরের দিকে অক্সিজেনের সরবরাহ কম থাকায় আগুন সেদিকে বাড়তে পারেনি। এজন্য ওয়াহেদ ম্যানশন সংলগ্ন ওয়াহেদ মঞ্জিলের কোনো ক্ষতি হয়নি। তার বদলে আগুন রাস্তার দিকে ছড়িয়ে পড়ে।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত হয়েছে ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার কেমিক্যাল গোডাউন থেকেই। পরে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। কোনো সিলিন্ডার বিস্ফোরিত হয়নি এবং বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকেও আগুনের সূত্রপাত হয়নি। ওই ভবনের দোতলার কেমিক্যাল গোডাউনে কোনো লিকেজ থেকে আগুনের শুরু হয়েছে বলে মনে করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের কাছে তার দফতরে তদন্ত কমিটির প্রধান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি) প্রদীপ রঞ্জন চক্রবর্তী তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তবে তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত কোনো কিছু বলতে অস্বীকৃতি জানান প্রদীপ রঞ্জন।

জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন হাতে পেয়েছি। তবে এখনো বিস্তারিত পড়ে দেখিনি। আগামীকাল (আজ) শুক্রবার গণমাধ্যমের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলবেন তিনি।

আগুনের সূত্রপাত সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলার কেমিক্যাল গোডাউন থেকেই আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, যা পরে ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এ ঘটনায় কারা দায়ী জানতে চাইলে তিনি বলেন, যে গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে, তারাই তো এ ঘটনায় দায়ী হওয়ার কথা।

আইইবির তদন্ত কমিটি সরেজমিন পরিদর্শনে গিয়ে জানতে পেরেছে, ওয়াহেদ ম্যানশনের দোতলায় খালি ক্যানে পারফিউম, এয়ার ফ্রেশনার রিফিল করা হতো। এগুলো উদ্বায়ী ও দাহ্য পদার্থ। পারফিউমের অন্যতম উপাদান ইথানলের ফ্ল্যাশ পয়েন্ট ১৬.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এয়ার ফ্রেশনারের ক্যানে প্রোপিল্যান্ট হিসেবে এলপিজি ব্যবহার হয়। বাতাসে এয়ার ফ্রেশনারের ঘনত্ব আনুমানিক শতকরা একভাগ হলেই তা দাহ্যতার নিম্নসীমা অতিক্রম করে এবং স্ফুলিঙ্গের উপস্থিতিতে আগুন ধরে বিস্ফোরণ হতে পারে। আগুনের তীব্রতা, বিস্ফোরণ ও ছড়িয়ে পড়ার মুখ্য কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে দাহ্য প্রসাধনী ও অন্যান্য সামগ্রীর বিপুল মজুত। কারণ, ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বিভিন্ন ধরনের প্রসাধন সামগ্রী ভস্মীভূত ও প্রায় অক্ষত অবশিষ্টাংশ দেখা যায়।

আইইবির সাধারণ সম্পাদক (সম্মানী) খন্দকার মনজুর মোর্শেদ বলেন, চুড়িহাট্টায় ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত কমিটি এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। আমরা ওই প্রতিবেদনটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করেছি। প্রতিবেদনে আগুন লাগার কারণ এবং কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে এ ধরনের ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে বলে আমি মনে করি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads