• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯
দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভোট আজ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু)

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

দীর্ঘ প্রতীক্ষার ভোট আজ

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ১১ মার্চ ২০১৯

টানা ২৮ বছরের অপ্রত্যাশিত অচলায়তন ভাঙছে আজ। দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও আইনি লড়াইয়ের পর্ব পার হয়ে অবশেষে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদের বহুল কাঙ্ক্ষিত নির্বাচন। আজ সোমবার প্রত্যাশিত সেই নির্বাচনের দিন। দেশের রাজনীতিতে শিক্ষিত নেতৃত্ব তুলে আনতে প্রায় তিন দশক ধরেই ডাকসু নির্বাচনের দাবি ছিল। একদিকে সুষ্ঠু নির্বাচনের ‘শঙ্কা’, অন্যদিকে ‘ভোটের অধিকার নিশ্চিত করাসহ অবাধ নির্বাচনের আশাবাদের’ মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজকের নির্বাচন। তাই আজ জাতির চোখ থাকবে ডাকসু নির্বাচনের দিকে, যেখান থেকে নির্বাচিত হবে আগামীর নেতৃত্ব।

প্রায় তিন দশক পর আজ ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে নতুন এক ইতিহাসের সাক্ষী হবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীরা। গতকাল রোববার পর্যন্ত ঢাবির যেসব শিক্ষার্থীর কাছে ডাকসু ছিল একটি ধারণা মাত্র, যার কথা তারা শুনেছেন ও বইয়ে পড়েছেন, আজ তারা সেই ডাকসু নির্বাচনে ভোট দিয়ে আগামীর নেতৃত্ব নির্বাচন করবেন। কেমন হবে এবারের নির্বাচন, কেমন নেতৃত্ব বেরিয়ে আসছে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে- উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনার মধ্যে এমন প্রশ্ন গতকালও ঘুরপাক খায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

স্বাধীন বাংলাদেশে এত বছর ধরে বন্ধ থাকা ডাকসু নির্বাচনের সব বাধা কেটেছে উচ্চ আদালতের এক নির্দেশে। আইনি জটিলতা কাটতেও আন্তরিক ভূমিকা ছিল অনেকের। সর্বোপরি শেষ পর্যন্ত সদিচ্ছা দেখায় ঢাবি প্রশাসন ও সরকার। একপর্যায়ে ঘোষণা আসে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার। সেই থেকে সবাই একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের অপেক্ষায়। সব ছাত্রসংগঠনের অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে উৎসবের আমেজ বিরাজ করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার, মধুর ক্যান্টিন ও টিএসসিতে। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও যে ডাকসু জাতিকে নেতৃত্ব দেয়, ভোটের মধ্য দিয়ে তেমন নেতৃত্ব আসবে বলে প্রত্যাশা সবার।

ডাকসু ও বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোর নির্বাচন ঘিরে ঢাবি ক্যাম্পাসে এক ধরনের আগ্রহ ও চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে, যা ক্যাম্পাসের বাইরেও আলোড়ন তুলেছে। দশ বছর ধরে ক্যাম্পাসে সরকারবিরোধী দলের ছাত্রসংগঠন ছাত্রদলের জন্য বৈরী পরিবেশ হলেও এ নির্বাচন ঘিরে সেখানে এক ধরনের গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। এ নির্বাচন ঠিকমতো অনুষ্ঠিত হলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হবে, যার মাধ্যমে ক্যাম্পাসগুলোয় হারানো গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে। আর শিক্ষার্থীরা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ভাবনাগুলো তুলে ধরার একটি প্লাটফর্ম পাবেন। পাশাপাশি ‘দ্বিতীয় সংসদ’ বলে খ্যাত ডাকসু থেকে জাতি শিক্ষিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব পাবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অবশ্য ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনের মতো নতুন প্রেরণা ও উদ্যমে আলোচনার উত্তাপ ছড়াচ্ছে সরকারি অন্য ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও। ডাকসুর আদলে ছাত্র সংসদের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বীকার করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) শীর্ষ কর্মকর্তারা। ডাকসুর আদলে ছাত্র সংসদ চালু করে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি নির্বাচন ও রাজনীতিতে দক্ষ নেতা সৃষ্টির করার বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার প্রাথমিক পরিকল্পনাও করছে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়।

আজ সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ভোট নেওয়া হবে ডাকসু নির্বাচনে। এ নির্বাচনে মোট ভোটদাতা ৪৩ হাজার ২৫৬ জন। ডাকসুতে ২৫টি পদের জন্য লড়ছেন ২২৯ প্রার্থী। অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় এবার প্রার্থীর সংখ্যার দিক থেকেও নতুন রেকর্ড। ১৮টি আবাসিক হলে মোট প্রার্থী ৫০৯। একেকটি হলে ১৩টি পদে নির্বাচন হবে।

ডাকসুতে প্যানেল দিয়ে নির্বাচন করছে ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, বাম সংগঠনগুলোর জোট, কোটা আন্দোলনকারীদের সংগঠন সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ, স্বতন্ত্র জোট, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রলীগ-বিসিএল, ছাত্র মৈত্রী, ইসলামী শাসনতন্ত্র ছাত্র আন্দোলন, ছাত্র মুক্তিজোট, জাতীয় ছাত্রসমাজ ও ছাত্র আন্দোলন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থীও আছেন।

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে সক্রিয় ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে ছাত্রলীগ ছাড়া অন্য সংগঠনগুলো হলগুলোতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দিতে পারেনি। ইতোমধ্যে হল সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। ডাকসুর গঠনতন্ত্রে নির্বাচন করার বয়স ত্রিশের মধ্যে বেঁধে দেওয়া আর ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের দৌরাত্ম্যের কারণে হলগুলোতে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে অভিযোগ ছাত্রদলসহ অন্য সংগঠনগুলোর। তবে এ অভিযোগ ভিত্তিহীন উল্লেখ করে ছাত্রলীগ নেতারা বলেন, কর্মী সঙ্কটের কারণেই অনেকের পক্ষে পূর্ণাঙ্গ প্যানেল দেওয়া সম্ভব হয়নি।

বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জানায়, ডাকসুতে প্রার্থীর সংখ্যা বিবেচনায় এবার ভোট নেওয়া হবে অপটিক্যাল মার্ক রিকগনিশন, ওএমআর ফর্মে। ভোট উপলক্ষে আজ বন্ধ থাকবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব পাঠদান ও পরীক্ষা। ভোটকেন্দ্রে ঢুকতে শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড দেখাতে হবে। ব্যালট পেপারে প্রার্থীর নামের ডানপাশে নির্ধারিত ঘরে ক্রস চিহ্ন দিয়ে ভোট দিতে হবে। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ বুথ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা রাখা হবে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ। এ নির্বাচন ঘিরে গতকাল রোববার সন্ধ্যা ৬টা থেকে ২৪ ঘণ্টা বৈধ কার্ড ছাড়া কেউ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ঢুকতে পারবেন না বলে নিষেধাজ্ঞা দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ।

ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনে ব্যালট ও ব্যালট বাক্স রাতেই হলগুলোতে পাঠিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কেন্দ্রগুলোতে কখন ব্যালট ও ব্যালট বাক্স পাঠানো হবে এমন প্রশ্নের জবাবে ডাকসু নির্বাচনের কর্মকর্তা আবদুল বাছির গতকাল বিকালে বলেন, ‘এগুলোর প্রক্রিয়া চলছে। আরো দুই-তিন ঘণ্টা সময় লাগবে। এরপরই আমরা হলগুলোতে পাঠিয়ে দেব।’

রাতে না পাঠিয়ে ভোটের আগে সকালে ব্যালট পেপার ও ব্যালট বাক্স পাঠানোর দাবিতে গতকালও প্রগতিশীল ছাত্রজোট, স্বতন্ত্র জোট, স্বাধিকার স্বতন্ত্র পরিষদ ও সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ উপাচার্যের কার্যালয়ে সামনে অবস্থান নিয়ে তার বরাবর স্মারকলিপি দেন।

গত বছরের জানুয়ারিতে দেওয়া এক নির্দেশে উচ্চ আদালত পরবর্তী ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনে ব্যবস্থা নিতে বলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে। এর আগে ২০১২ সালের ১১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও কোষাধ্যক্ষকে ডাকসু নির্বাচনে ব্যবস্থা নিতে লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়। কর্তৃপক্ষ ওই নোটিশের জবাব না দেওয়ায় ওই বছরই ২৫ শিক্ষার্থীর পক্ষে একটি রিট হয়। বিষয়টি নিয়ে পরে উচ্চ আদালত রুল জারি করেন।

উচ্চ আদালতের ছয় মাসের মধ্যে ডাকসু নির্বাচনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে দেওয়া রায় স্থগিত চেয়ে আবেদন করে কর্তৃপক্ষ। গত বছরের অক্টোবরে আপিল বিভাগ উচ্চ আদালতের রায়ের ওপর দেওয়া স্থগিতাদেশ বহাল রাখেন। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিষয়টি শুনানির জন্য উত্থাপিত হয়। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ উচ্চ আদালতের রায়ের ওপর দেওয়া স্থগিতাদেশ তুলে নেন। ফলে চলতি বছরের মার্চের মধ্যে ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠানের সব বাধা কেটে যায়।

১৯২১ সালে উপমহাদেশের প্রথম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাবি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র সংসদ সৃষ্টি হয়। তখন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের এক টাকা চাঁদা দিয়ে এর সদস্য হতে হতো। এভাবেই যাত্রা শুরু হয় দেশের স্বাধিকার, ভাষার সংগ্রাম ও স্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার ডাকসুর। এর আগে মোট ৩৬ বার এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯০ সালের ৬ জুন ডাকসু সর্বশেষ নির্বাচন হয়। ঢাবির সিনেটে শিক্ষক প্রতিনিধি, রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি, সিন্ডিকেট সদস্য, ডিন, শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সংগঠনসহ সব সংগঠনের নির্বাচন নিয়মিত অনুষ্ঠিত হলেও শুধু বন্ধ ছিল ডাকসু নির্বাচন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads