• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯
হোটেল রেস্তোরাঁর অধিকাংশ খাবার অনিরাপদ

হোটেল রেস্তোরাঁর অধিকাংশ খাবার অনিরাপদ

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

হোটেল রেস্তোরাঁর অধিকাংশ খাবার অনিরাপদ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ মার্চ ২০১৯

খাবারের উপাদান তৈরি থেকে বিপণন এবং গ্রহণ পর্যন্ত সব প্রক্রিয়াতেই চলছে ভেজালের মিশ্রণ। মান রক্ষার বিষয়টি জরুরি হলেও মুনাফালোভীরা খাবারে ভেজাল মেশানোর এই অসদুপায় থেকে কোনোভাবেই নিবৃত হচ্ছে না। একের পর এক ভেজালবিরোধী অভিযান চললেও থামানো যাচ্ছে না ভেজালের এই নৈরাজ্য।

হোটেল রেস্তোরাঁয় খাবারের উপাদান প্রস্তুত করা, রান্না করা, সংরক্ষণ ও সরবরাহ প্রক্রিয়ায় দূষণ অব্যাহত আছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, ৭১.৫ ভাগ হোটেল রেস্তোরাঁর খাবার মানহীন এবং অস্বাস্থ্যকর। পথখাবারের ৫৫ ভাগেই পাওয়া গেছে জীবাণু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যস্ততার কারণে বেশিরভাগ মানুষ হোটেল রেস্তোরাঁর খাবার ও হালকা খাবারের জন্য পথখাবারের ওপর নির্ভর করে। রাজধানী ঢাকার এমন কোনো অলিগলি নেই যেখানে ফুটপাথে খাবার বিক্রি হয় না। কিন্তু ফুটপাথে তৈরি এসব খাবার কতটা নিরাপদ? এক গবেষণায় উঠে এসেছে, ফুটপাথে তৈরি করা এসব খাবারের ৫৫ শতাংশের মধ্যে নানা ধরনের জীবাণু রয়েছে। এ ছাড়া যারা এসব খাবার বিক্রির সঙ্গে জড়িত তাদের হাতও নানা ধরনের জীবাণুতে আক্রান্ত। আবার কাগজের তৈরি যেসব প্যাকেটে এসব খাবার সরবরাহ করা হয়ে থাকে সেটাও অধিক জীবাণুযুক্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেখানে খাবারের জন্য মানুষ বেশি নির্ভর করে এসব খাবারের গুণগত মান আগে নিশ্চিত করতে হবে। অনেক মানুষ শখেরবশে এসব খাবার খেয়ে রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন।

অনুসন্ধানে রাজধানীর বিভিন্ন ফুটপাথে দেখা গেছে অধিকাংশ খাবার খোলা অবস্থায় বিক্রি হয়। বিশেষ করে শিঙ্গাড়া, চপ, পুরি, বেগুনি, ছোলা-মুড়ি খোলা অবস্থায় তৈরি হয় ফুটপাথে। পাশ দিয়ে যানবাহন ধুলা উড়িয়ে চলে। এসব ধুলাবালি বাতাসে মিশে গিয়ে পড়ছে খোলা রাখা খাবারে। শীতকালে রাস্তায় পিঠাপুলি বিক্রি রাজধানীর জনপ্রিয় একটি পেশা। বিশেষ করে মহিলারা এ সময়ে নানা ধরনের পিঠা তৈরি করে বিক্রি করে থাকেন। এসব খাবারও খোলা জায়গায় তৈরি হয়। শীতে গরম গরম এসব পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খোলা অবস্থায় তৈরি ও বিক্রি করার কারণে নানা জীবাণুর মিশ্রিত হয় এসব খাবারে। ভোক্তারা জেনে না জেনেই এসব খাবার খেয়ে থাকেন।

আইসিডিডিআর,বি’র এক গবেষণায় উঠে এসেছে, রাজধানী ঢাকার পথখাবারের ৫৫ শতাংশে নানা ধরনের জীবাণু থাকছে। এসব খাবার বিক্রেতার ৮৮ শতাংশের হাতে থাকে জীবাণু। এতে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা শহরের রাস্তাগুলোতে প্রায় দুই লাখ বিক্রেতা নানা ধরনের খাবার বিক্রি করেন। তাদের বিক্রীত খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে আছে— শুকনো, তেলে ভাজা, রান্না করা, আগুনে সেদ্ধ-পোড়ানো, তেলে মাখানো খাবার। গবেষণায় বলা হয়, এসব খাবার সুস্বাদু হওয়ায় কোনো ধরনের যাচাই না করেই ক্রেতারা খেয়ে থাকেন। এসব খাবারের মধ্যে রয়েছে চা, ঝালমুড়ি, পিঠা, বাদাম, ছোলা, চটপটি, ফুচকা, চাটনি, আচার, মিষ্টি, ডিম (ভাজা বা সেদ্ধ), রুটি, পরোটা, পুরি, চিপস, মোয়া, গজা, শিঙ্গাড়া, সমুচা, পেঁয়াজু, শরবত, ফলের রস, আখের রস, হালিম, আইসক্রিম, নুডলস, পোলাও, তেহারি, খিচুড়ি, ভাত ও শিক কাবাব।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, নিরাপদ খাদ্য মানুষের জন্মগত অধিকার। কিন্তু এই অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে মানুষ। অসাধু ব্যবসায়ীদের ভেজালের কারণে খাদ্য আর নিরাপদ থাকছে না। যারা হরহামেশা এসব পথখাবার খেয়ে থাকেন তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এসব খাবারের মান নিয়ে তারা অত ভাবেন না। সুস্বাদু হওয়ায় এবং হাতের কাছে পাওয়ার কারণে যাচাই না করেই এসব খাবার তারা খেয়ে থাকেন।

প্রতিষ্ঠানটির গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, রান্নার জন্য খাবারের উপাদান প্রস্তুত করা, রান্না করা, সংরক্ষণ ও সরবরাহ করার প্রক্রিয়া অর্থাৎ পুরো প্রক্রিয়ার প্রায় সব স্তরেই খাবারে দূষণ ঘটে চলেছে। অনিরাপদ পানির ব্যবহার খাবার জীবাণুযুক্ত হওয়ার আরো একটি বড় কারণ। খাবার বিক্রেতার হাতে, গামছায়, খাবার সরবরাহের প্লেটে ও কাগজেও জীবাণু থাকে। বিশেষত, ময়লা কাগজে টাকা তাদের নাড়াচাড়া করতে হয়। মাছিসহ অন্যান্য কীটপতঙ্গের কারণেও খাবারে দূষণ ঘটে। গবেষণা থেকে উঠে এসেছে পথখাবার বিক্রেতা এবং যারা এসব খাবার কিনে খান উভয়পক্ষেই সচেতনতার দরকার।

গবেষকরা অনুসন্ধানে দেখেছেন তৈরি প্রক্রিয়া, রান্না, সংরক্ষণ, সরবরাহ এসব স্তরে খাবার দূষিত হয়। দূষণ বা জীবাণুযুক্ত হওয়ার একটি বড় কারণ অনিরাপদ পানির ব্যবহার।

এসব থেকে রক্ষা পেতে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ— বিক্রেতার খাবার খোলা অবস্থায় না রাখা, সরু মুখওয়ালা পানির পাত্র ব্যবহার, কাঁচা খাবার বা সরঞ্জাম পরিষ্কার রাখা, হাত ধোয়া, গ্লাভস ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া। এছাড়া ক্রেতা যেন খাবারে হাত না দেন বা বিক্রেতা যেন একই পানি বার বার ব্যবহার না করেন, সে বিষয়ে সচেতন করতে হবে। পথখাবার বিক্রেতারা যাতে এসব নিয়ম মেনে চলেন, সে জন্য ব্যাপকভিত্তিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাও জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য ফসল উৎপাদনের শুরু থেকে খাবার গ্রহণ পর্যন্ত প্রতিটি স্তরে গুণগত মান রক্ষা করা খুবই জরুরি। কারণ, যে কোনো স্তরে খাদ্যের গুণগতমান নষ্ট হয়ে যেতে পারে। খাদ্য যে সকল প্রক্রিয়ায় উৎপাদন করা হয় সেখান থেকে কোনো প্রকার দূষণ, বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত না হয় তারও যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। খাদ্যে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অতিমাত্রার কেমিক্যাল ব্যবহার করলে তা দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে।

সরেজমিনে দেখা যায়, টয়লেটের পাশে রান্নাঘরে চলে হোটেল রেস্তোরাঁর রান্নাবান্না। আর ওই খাবারের ওপর মাছি উড়ে এসে বসে। দোকানে অনেক কর্মচারী। তারা বার বার বাথরুমে যাওয়া-আসা করলে সঠিকভাবে পরিচ্ছন্ন হয় না। ফ্রিজে জমিয়ে রাখা কয়েকদিনের পুরনো রান্না করা খাবার খেতে দেওয়া হয়। শিঙ্গাড়া-সমুচাও দ্বিতীয়বার তেলে ভেজে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ রাজধানীর হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের মান পরীক্ষা করে লেবেলিং করেছে।

ইতোমধ্যে রাজধানীর ২শ’ হোটেল রেস্তোরাঁর খাবার পরীক্ষা করে দেখেছেন বেশিরভাগই মানহীন। এ অবস্থায় প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ঢাকার সব হোটেল রেস্তোরাঁর খাবার পরীক্ষা করা হবে। যেসব প্রতিষ্ঠানে খাবার মানহীন সেসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হবে। বাকিগুলো মান অনুযায়ী লেবেলিং করা হবে।

নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার হোটেল রেস্তোরাঁর খাবারের মান নিয়ে জরিপ চালিয়েছে। তাতে দেখা গেছে, ২০০ হোটেলের মধ্যে ৫৭টির মান ভালো এবং ১৩৪টির মান নিম্ন। জরিপ অনুযায়ী ৭১ শতাংশ রেস্তোরাঁর খাবারের মান নিম্নমানের এবং স্বাস্থ্যসম্মত নয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads