• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
বিআইডিএসের সমালোচনামূলক কথন

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

দারিদ্র্যে প্রশ্নবিদ্ধ প্রবৃদ্ধি

বিআইডিএসের সমালোচনামূলক কথন

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৯ এপ্রিল ২০১৯

মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি বছর বছর বাড়লেও এর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কমছে না দারিদ্র্য। পাঁচ বছরের ব্যবধানে ২৩ জেলায় দারিদ্র্যের হার বেড়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে দিনাজপুর জেলায় দারিদ্র্যের হার ২৬ দশমিক ৪০ শতাংশ বেড়েছে। কুড়িগ্রাম জেলায় প্রায় ৭১ শতাংশ মানুষ এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন। দরিদ্র না কমে উল্টো বৈষম্য বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন বিশেষজ্ঞরা। আর বিনিয়োগ, রফতানি, প্রবাসী আয় ও কর্মসংস্থানের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে উন্নতি না হওয়ায় এসব প্রশ্ন আরো প্রবল হচ্ছে। সরকারি গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সমালোচনামূলক অনুষ্ঠান বিআইডিএস ক্রিটিক্যাল কনভারসেশনের প্রথম দিন রোববারের বিভিন্ন অধিবেশনে বক্তাদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে এসেছে।

রাজধানীর একটি হোটেলে গতকাল দুই দিনের সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. কেএএস মুরশিদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ ও পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম। 

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রথম দিনে তিনটি অধিবেশনে মোট পাঁচটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এসব অধিবেশনে উপস্থাপিত গবেষণার ওপর দেশ-বিদেশের অর্থনীতি ও সমাজ বিশেষজ্ঞরা বক্তব্য দেন। এসব প্রকাশনায় প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য ও বৈষম্য ছাড়াও ব্যাংক খাতের করুণ অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়। ঋণের উচ্চ সুদহার, খেলাপি ঋণ, অপ্রয়োজনে নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা ও সুশাসনের অভাবে ব্যাংক খাতের পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না বলে দাবি করা হয় গবেষণায়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভালো করছে। ব্যাংক খাত খুশি হওয়ার মতো অবস্থায় নেই। অর্থনীতিকে রাজনীতি থেকে আলাদা করার বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক অর্থনীতি হওয়ায় রাজনীতি থেকে অর্থনীতিকে বের করে আনাটা সহজ হবে না।

তিনি আরো বলেন, ব্যাংক খাতে প্রধান ভূমিকা পালন করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। নিশ্চয়ই এ বিষয়ের আইনকানুন আছে।  বিশেষ গ্রুপের ইন্টারেস্টের বিষয়টি থাকবেই বলে মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, বৈষম্য অনেক বড় বিষয়। এ সমস্যার সমাধানে নির্লোভ ও নির্মোহ গবেষণা প্রয়োজন।

কর্মসংস্থান নিয়ে মন্ত্রী বলেন, যারা শিক্ষিত তারা তাদের মতো চাকরি চান। যেকোনো মূল্যে ঢাকায় থাকবেন, অন্য কোথায়ও যাবেন না, আরামে অফিসে বসে কাজ করতে চান। এমনটা হবে না। আবার অনেকেই এমন চাকরি চান যেখানে তাদের যোগ্যতা নেই। কৃষক ও শ্রমিক বেকার থাকেন না। যারা শিক্ষিত তারা কাজ পান না, বেকার থাকেন।

ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ বলেন, দেশে এক দলের শাসন ব্যবস্থা চলছে। এক্ষেত্রে জবাবদিহিতা থাকতে হবে। একজনের কাছে জবাবদিহিতা থাকলে চলবে না। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী যেটা বলুক না কেন নিচের দিকে তা বাস্তবায়ন হবে না। অর্থনীতিকে অর্থনীতি দিয়েই বিবেচনা করতে হবে। ব্যাংক খাতে  বা আর্থিক সুশাসনের প্রয়োজন। উচ্চ ও মধ্যম আয়ের দেশে যেতে হলে সবকিছু আন্তর্জাতিক মানে যেতে হবে। ব্যাংক খাতের বেশ কিছু ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থা অতীতে থাকলেও বর্তমানে সেগুলো পিছিয়ে আনা হয়েছে। ঋণখেলাপির সংজ্ঞা, ঋণের স্থিতি এসব বিষয়ে গবেষণা না করেই বিশ্বমান থেকে নামিয়ে আনাটা ঠিক হয়নি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। ব্যবসায়ীদের চাপেই খেলাপি ঋণের সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হয়েছে বলেও দাবি করেন এ অর্থনীতিবিদ।

সামষ্টিক অর্থনীতি ও আর্থিক খাত নিয়ে অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিচার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) চেয়ারম্যান ড. জায়েদি সাত্তার। অধিবেশনে দুটি প্রবন্ধ উপস্থাপনা করেন আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সিনিয়র গবেষণা ফেলো ড. কাজী ইকবাল ও ড. মনজুর হোসেন। প্যানেল আলোচক ছিলেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন, ইকোনমিক রিচার্স গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক ড. সাজ্জাদ জহির, ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান।

এ অধিবেশনের প্রবন্ধে বলা হয়েছে, ব্যাংক মালিকদের সংগঠন ব্যাংকের আমানত ও ঋণে সুদের হার ৬ ও ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা কার্যকর করেনি। ঋণের সুদহার এখন ১৩ থেকে ১৫ শতাংশের মধ্যে। সঞ্চয়পত্রে উচ্চ সুদহার এবং খেলাপির কারণে ঋণের সুদের হার কমছে না। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার সংশোধনের পাশাপাশি ব্যাংক খাত সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

এতে আরো বলা হয়েছে, দেশে বর্তমানে ৫৯টি ব্যাংক রয়েছে। এ অবস্থায় নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। ব্যাংকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় তারল্য সঙ্কট বেড়েছে। রাজনৈতিক চাপে নতুন ব্যাংক দেওয়া হলেও সেগুলো জনগণের আস্থা বাড়াতে পারছে না। দুই-একটি ব্যাংক এ ক্রেডিট রেটিং পেলেও বাকিগুলো বি ও সি পেয়েছে। আমানতের ওপর নির্ভর না করে এসব ব্যাংককে বন্ডের ওপর নির্ভর করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

আলোচনায় পরিবারভিত্তিক ব্যাংক পরিচালনার ব্যবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গ্রাহকদের অধিকার রক্ষায় আমানত বীমা, নতুন ব্যাংকের প্রয়োজনীয়তা মূল্যায়ন এবং নতুন ব্যাংক ঠেকানো না গেলে  ইউনিট ব্যাংকের  উদ্যোগ নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এ খাতে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠারও তাগিদ দেওয়া হয়েছে আলোচনায়। এ অধিবেশনে জিডিপি প্রবৃদ্ধির মান নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়।

জায়েদি সাত্তার বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রয়েছে। এটা ধরে রাখতে হবে। ব্যাংক খাতের সুশাসন এক সময় উন্নত হয়েছিল। পরে এখন সেটি নিচের দিকে নেমেছে। প্রবৃদ্ধি অনুযায়ী কর্মসংস্থান হচ্ছে না। টেকসই উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানোর প্রয়োজন।

ড. সেলিম রেজা বলেন, প্রবৃদ্ধির সঙ্গে উৎপাদনশীলতা মেলানো কঠিন। সরকারের হিসাবের সঙ্গে বাস্তবতার মিল হচ্ছে না। জিডিপি হিসাবের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) স্বাধীনতা প্রয়োজন। তথ্য-উপাত্ত গ্রহণযোগ্য হতে হবে। অভ্যন্তরীণ চাহিদার ভিত্তিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে দাবি করে তিনি বলেন, রফতানিনির্ভর প্রবৃদ্ধির বিকল্প নেই। রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে। সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাড়াতে হবে। অর্থনৈতিক অঞ্চল হলেও এফডিআই আনতে হবে।

মাহবুবুর  রহমান বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতির যে আকার এখানে নতুন ব্যাংকের প্রয়োজন নেই। যেসব উদ্দেশ্যে নতুন ব্যাংকগুলো এসেছে সেসব উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি। ব্যাংক খাতে দক্ষতার অভাব রয়েছে। সুদ বেশি দিয়ে আমানত নিয়ে কম সুদে ঋণ দেওয়া সম্ভব নয়। ব্যাংক খাতে অসুস্থ প্রতিযোগিতার কারণে খেলাপি ঋণ বাড়ছে।

ড. জাহিদ হোসেন বলেন, টেকসই আর্থিক খাতের জন্য মুদ্রা ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। পোশাক খাতের মতো অন্যান্য শিল্পেও প্রণোদনা দিতে হবে।

বৈষম্য ও আঞ্চলিক দারিদ্র্য নিয়ে অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন যুক্তরাষ্ট্রের আলস্টার ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক এসআর ওসমান। অধিবেশনে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক ড. বিনায়েক সেন ও সিনিয়র গবেষণা ফেলো এসএম জুলফিকার আলী। বক্তব্য  দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. এমএ বাকী খলিলী, সাবেক অধ্যাপক এমএ তসলিম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন ও অ্যাকশন এইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির।

এ অধিবেশনে বিনায়েক সেন বলেন, বাংলাদেশে প্রবৃদ্ধির সঙ্গে বৈষম্য বাড়ছে। সরকারের পক্ষ থেকে সীমিত পরিসরে বিষয়টা স্বীকার করা হলেও গুরুত্ব দেওয়া হয় না। প্রবৃদ্ধি বাড়লে বৈষম্য বাড়বে বলেও সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়ে থাকে। তবে ধারাবাহিকভাবে উচ্চ প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা বেশ কয়েকটি দেশে বৈষম্য কমেছে বলে তিনি দাবি করেন। এসএম জুলফিকার আলী তার প্রবন্ধে বলেন, প্রবৃদ্ধি বাড়লেও বেশ কিছু জেলায় দারিদ্র্য বাড়ছে। আয় বাড়লেও এসব জেলায় দারিদ্র্য বৃদ্ধির তথ্যে তিনি সংশয় প্রকাশ করেন।

এ অধিবেশনে ফারাহ কবীর বলেন, রাজনৈতিক উদ্যোগ ও সদিচ্ছার অভাবের কারণে অসমতা বাড়ছে। বৈষম্য কমাতে অঞ্চলভিত্তিক উন্নয়নের পরিকল্পনা প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads