• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
মানব পাচার বেড়েছে সিলেটে

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

সংশ্লিষ্টদের উদাসীনতায় ৮ বছরে মাত্র ৭৩ মামলা

মানব পাচার বেড়েছে সিলেটে

  • আবু তাহের চৌধুরী, সিলেট
  • প্রকাশিত ২৭ মে ২০১৯

প্রায় ৫ বছর আগে সিলেটের জকিগঞ্জ এলাকার ১৫ বছরের এক কিশোরকে শ্রমিকের কাজের কথা বলে সৌদি আরব পাঠায় স্থানীয় এক দালাল। সেখানে নিয়ে তাকে উটের জকির কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন উটের জকি হিসেবে কাজ করে এই কিশোর। এক সময় সে অসুস্থ হয়ে পড়ে।

এই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে কৌশলে সেখান থেকে পালিয়ে আসে। পরে বাংলাদেশের দূতাবাসের মাধ্যমে দেশেও ফিরে আসে সে। দেশে আসার পর সেই দালাল ও এজেন্সির ওপর মামলা দায়ের করে কিশোরের বাবা। সেই মামলা এখনো বিচারাধীন আছে সিলেট নারী শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে।

এই কিশোরের বাবা শেষ পর্যন্ত আদালতের আশ্রয় নিলেও সিলেটে এ ধরনের বেশিরভাগ ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। থেকে যায় অন্তরালে। স্বজন হারানোর ভয় আর আর্থিক সংকটে পুলিশ-আদালতের দ্বারস্থ হন না ভুক্তভোগীরা। ফলে সিলেটে মানব পাচার বাড়লেও এ নিয়ে আইনের দ্বারস্থ হতে আগ্রহী নন ভুক্তভোগীরা। বরং এসব ঘটনায় পুলিশ-আদালত এড়িয়েই চলতে চান তারা।

ভুক্তভোগীদের এই লুকোচুরির কারণে মানব পাচারের ঘটনা আরো বাড়ছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সর্বশেষ গত ৯ মে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে নিহত সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের আবদুল আজিজের ভাই মফিজ উদ্দিন মানব পাচার ও মানি লন্ডারিং আইনে ফেঞ্চুগঞ্জ থানায় মামলা করেছেন। এই মামলায় এনামুল হক নামের এক ট্রাভেলস এজেন্সির ব্যবসায়ীকে আসামি করা হয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় আজিজসহ এই পরিবারের আরো তিন নিকটাত্মীয় সাগরে ডুবে নিহত হন।

সিলেটে মানব পাচারের পৃথক টাইব্যুনাল নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালেই এ সংক্রান্ত মামলাগুলোর বিচার হয়। এই ট্রাইব্যুনালের হিসাব অনুযায়ী, ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন প্রণয়নের পর থেকে ২০১৯ সালের চলতি মাস (মে) পর্যন্ত মানব পাচারের মামলা হয়েছে মাত্র ৭৩টি। এর মধ্যে নিষ্পত্তি হয়েছে ২৬টি, বিচারাধীন আছে ৪৭টি মামলা। চলতি বছরে এ পর্যন্ত মানব পাচারের মামলা হয়েছে দুটি। মানব পাচারের তুলনায় এই মামলার সংখ্যা একেবারেই যৎসামান্য বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ  কে আবদুল মোমেনও মনে করেন, মানব পাচার রোধে দেশে শক্তিশালী আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। আর এর সুযোগ নিচ্ছে পাচারকারীচক্র।

গত শুক্রবার সিলেটে নিজ বাড়িতে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, মানব পাচার রোধে ৩৬টি আইন রয়েছে। কিন্তু সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ হচ্ছে না। ভুক্তভোগীরাও আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন না। কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তখন একটু তোড়জোড় হয়। এবার আশা করছি পাচারকারীদের কঠিন শাস্তি হবে।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, পাচারকারীদের শাস্তি না হলে পাচার রোধ করা কঠিন হবে। এ ব্যাপারে বড় ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ তারা সহজে পার পেয়ে যাচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, সিলেটে অবৈধ পথে বিদেশ যাওয়ার প্রবণতা আগের চাইতে অনেক বেড়েছে। দারিদ্র্য, বেকারত্ব, রাজনৈতিক অস্থিরতা, শ্রমের কমমূল্যসহ নানা কারণে তরুণ ও যুবকদের একটি বড় অংশ যে কোনো উপায়ে বিদেশে বিশেষত ইউরোপ যেতে আগ্রহী। তরুণদের এই বিদেশমুখীনতাকে কাজে লাগিয়ে সিলেটে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি মানব পাচারকারী চক্র। এদের মধ্যে নিয়মিতই অবৈধ পথে দেশ ছাড়ছে তরুণরা। সিলেট থেকে ইউরোপ ছাড়াও ইদানীং মধ্যপ্রাচ্যেও বেড়েছে মানব পাচারের ঘটনা। অবৈধ পথে যাচ্ছেন নারীরাও। মাঝে মাঝে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেই আলোচনায় ওঠে আসে মানব পাচারের বিষয়টি। সর্বশেষ লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবিতে বহু হতাহতের ঘটনায় ফের আলোচনায় উঠে আসে মানব পাচারের বিষয়টি। এ পর্যন্ত পাওয়া তথ্যমতে, ওই দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্য ২০ জনই সিলেটের।

সিলেটে মানব পাচারের মামলা পরিচালনাকারী স্পেশাল পিপি অ্যাডভোকেট শাহ মোশাহিদ আলী বলেন, সিলেটে মানব পাচারের ঘটনা দিন দিন বাড়ছে। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই বিদেশ থেকে ফিরে আর মামলা করার সাহস পান না। কারণ বিদেশে যাওয়া-আসায় তারা আগেই নিঃস্ব হয়ে পড়েন। মামলা পরিচালনার খরচ মেটানোর সামর্থ্য থাকে না তাদের। তাছাড়া নতুন করে তারা ঝামেলায় জড়াতেও চান না। এছাড়া এসব মামলার আসামিরা থাকে বিভিন্ন স্থানের। তাদের ধরে এনে অনেক ক্ষেত্রে আদালতে হাজির করা যায় না। পুলিশও ততটা আন্তরিকতা দেখায় না। এতে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা কঠিন হয়ে পড়ে। এসব কারণে বেশিরভাগ ভুক্তভোগী মানুষই মামলা করতে আসেন না।

সিলেট আদালতে চলমান একটি মামলার উদাহরণ দিয়ে পিপি শাহ মোশাহিদ আলী বলেন, সুনামগঞ্জের এক নারীকে দালাল ও এজেন্সির লোকজন মিলে গৃহকর্মীর কাজের কথা বলে সৌদি আরব পাঠায়। কিন্তু সেখানে নিয়ে তাকে দেহব্যবসার কাজে লাগানো হয়। পরবর্তীতে দেশে এসে ওই নারী দালাল ও এজেন্সির বিরুদ্ধে মামলা করেন। তবে এমন ক্ষেত্রে মামলা করার নজির খুবই কম বলেও জানান এই আইনজীবী।

এদিকে মানব পাচার রোধে সিলেটে অভিযানে নেমেছে প্রশাসন।

জেলা প্রশাসনের অভিযানের সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ নাছির উল্লাহ খান বলেন, সিলেটে মানব পাচার অনেক বেড়ে গেছে। প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মানব পাচারকারী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ভ্রাম্যমাণ আদালত যাদের বৈধতা নেই তাদের জরিমানা ও সতর্ক করে দিচ্ছে। সময় বেঁধে দিচ্ছে। প্রয়োজনে আরো কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে মানুষের আরো সচেতনতা দরকার। তারা যেন প্রলোভনে পড়ে অবৈধ পথে বিদেশ না যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads