• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
পুলিশে শাস্তি নিয়ে টালবাহানা!

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

পুলিশে শাস্তি নিয়ে টালবাহানা!

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৭ জুলাই ২০১৯

দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি বড় অংশ পুলিশ। অনেক ক্ষেত্রে বলা যায়, পুলিশ দেশের আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। এসবের মধ্যেও পুলিশের কিছু সদস্য আইনবহির্ভূত কাজে জড়িয়ে পড়েন। বাহিনীটির সুনাম রক্ষার্থে তাদের শাস্তি দেওয়া হয়। এ শাস্তির নানা রকমফের আছে।

পুলিশ প্রবিধান (পিআরবি) ১৮৬১ বলছে, কোনো পুলিশ সদস্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়ালে তার বিরুদ্ধে দুই ধরনের বিভাগীয় শাস্তি লঘু ও গুরুদণ্ডের বিধান আছে। গুরুদণ্ডের আওতায় চাকরি থেকে বরখাস্ত, পদাবনতি, পদোন্নতি স্থগিত, বেতন বৃদ্ধি স্থগিত ও বিভাগীয় মামলা হয়। মামলায় অপরাধ প্রমাণিত হলে বরখাস্ত করা হয়। গুরুদণ্ডের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ আছে। ছোট অনিয়ম বা অপরাধের জন্য দায়িত্ব থেকে প্রত্যাহার, অপারেশনাল ইউনিট থেকে পুলিশ লাইনস বা রেঞ্জে সংযুক্ত করে লঘুদণ্ড দেওয়ার বিধান আছে।

এসবের মধ্যে অনেকেই বলছেন পুলিশের শাস্তি নিয়ে নানা টালবাহানা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের গুরুত্ব থাকলেও কম গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ফলে দেখা যায়, যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা খালাস পেয়ে যান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপরাধ করেও শাস্তি পেতে হয় না। আবার অনেক ক্ষেত্রে বিভাগীয় শাস্তির নামে যেসব শাস্তি দেওয়া হয়, বিশেষজ্ঞদের মতে তা আসলে কোনো ধরনের শাস্তিই নয়। এ ছাড়া পুলিশের কোনো সদস্য অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে দেশের প্রচলিত আইনে বিচারের বিধান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তা কার্যকর হয় না। অনেক ক্ষেত্রে ফৌজদারি অপরাধের বিচারও করা হয় বিভাগীয় আইনে। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্তদের বিভাগীয় শাস্তির আওতায় আনার কথা বলে আড়াল করার অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত এবং বিচারও করে পুলিশ। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে অপরাধীরা পার পেয়ে যান।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উন্নত বিশ্বে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ এলে আলাদা কমিশন করে তার বিচার করা হয়। বাংলাদেশেও পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্ত এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বা নির্বাচন কমিশনের মতো স্বাধীন কমিশন গঠনের ব্যাপারে মত দেন তারা। এতে অপরাধ অনেকাংশে কমবে বলেও মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এমনটা না হলে পুলিশ বিভাগে অপরাধ বাড়বে। ক্রমশ বিভাগটির সুনাম নষ্ট হবে। যা নানা সময় হচ্ছেও। তারা মুষ্টিমেয় কতক সদস্যের জন্য পুরো বিভাগটির ভালো কাজ সামনে আসছে না বলেও মত দেন।

এসবের মধ্যেও পরিসংখ্যান বলছে, কিছু আশার কথা, গত ৯ বছরে ১ লাখ ২০ হাজার ১৯১টি ঘটনায় পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা, অপহরণ, খুন, ছিনতাই, নির্যাতন, ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায়, মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া, যৌন হয়রানিসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় তাদের বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, ‘বিভাগীয় শাস্তির ক্ষেত্রে সাধারণত দায়িত্বে অবহেলা, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বৈধ আদেশ অমান্য করা, ক্ষমতার অপব্যবহার, অপেশাদার আচরণ, উৎকোচ গ্রহণ ইত্যাদি গুরুত্ব পায়।’

আইন, মানবাধিকার ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক নূর খান লিটন বলেন, ‘পুলিশে শাস্তি হলেও এক ভাগ ক্ষেত্রেও চাকরি যায় না। পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্তের পর সাধারণত তাদের ক্লোজড বা সংযুক্ত করা হয় এবং পরবর্তীতে বলা হয়, তাদের শাস্তি দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘কোনো কোনো ক্ষেত্রে কিছু সময়ের জন্য তাদের হয়তো অন্যত্র সংযুক্ত করে রাখা হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা বাহিনীতেই থেকে যান। খুব কমসংখ্যক ঘটনায় পুলিশ বাহিনী থেকে বের করে দেওয়া হয়।’ নূর খান লিটন বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অভিযোগের গুরুত্ব থাকলেও কম গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন উপস্থাপন করা হয়। ফলে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা খালাস পেয়ে যান।

প্রত্যাহার বা সাময়িক বরখাস্তের নামে পুলিশের যে শাস্তি দেওয়া হয়, তা কোনো শাস্তির পর্যায়েই পড়ে না বলে মন্তব্য করেন মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জহিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, বড় কোনো ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই বদলি, প্রত্যাহার, ক্লোজ বা সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দেওয়া হয়। এসব শাস্তিতে সাময়িকভাবে কাজের ‘বিঘ্ন ঘটা’ ছাড়া কোনো প্রভাবই পড়ে না পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পরবর্তী সময়ে বড় শাস্তি পেতে হয় না অভিযুক্তকে। ফলে প্রচলিত এই শাস্তি পুলিশের অপরাধ কমাতে কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে না। তিনি আরো বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অপরাধ পুলিশই তদন্ত করছে। আবার বিচার প্রক্রিয়ায়ও অংশগ্রহণ করছে। ড. জহিরুল বলেন, পুলিশের দুর্নীতি, ঘুষ, অন্যায়ের ক্ষেত্রে যদি নিজ বিভাগ দায়িত্ব পালন করে তাহলে সঠিক তদন্ত, চার্জশিট বা সঠিক ফলাফল আসবে না।

এসবের মধ্যেও বিভিন্ন অপরাধে পুলিশের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির ঘটনা বাড়ছে। এর কারণ জানতে চাইলে সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা বলেন, ‘শাস্তি হওয়াটা ভালো দিক। তার মানে প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা আছে। শাস্তি হওয়া নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। শৃঙ্খলা মেনে চলা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয় যথাযথ কারণেই।’

পুলিশের শাস্তির বিষয়ে ছাড় মেলে না জানিয়ে সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ বলেন, এখানে আস্থার সংকট আছে। আস্থা ও ভরসার জায়গায় আমরা একটু সন্দেহগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। তিনি বলেন, পুলিশের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ার পর খুব কমই শাস্তি থেকে বাঁচতে পারছে। তবে অনেক ক্ষেত্রে রাজনীতিকীকরণের একটি অপচেষ্টা চলে। নূর মোহাম্মদ আরো বলেন, পুলিশকে আরো শক্তিশালী এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে আলাদা কমিশন প্রয়োজন যেটি পুলিশ সংস্কার কমিশনে ছিল। বিষয়গুলো নির্ভর করে সরকারের ওপর।

এদিকে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ফৌজদারি অপরাধে সবার জন্য যে আইন আছে, পুলিশের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। কিন্তু পুলিশের এসব অপরাধ প্রচলিত আইনে কেন শাস্তির আওতায় আসছে না প্রশ্নে তিনি বলেন, অবশ্যই ফৌজদারি আইনের আওতায় আসবে, না আসাটা অনভিপ্রেত। পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত পুলিশই করছে জানিয়ে সরকারের সাবেক এ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, এটা শুধু পুলিশে নয়, দুদকের কোনো সদস্য অপরাধ করলেও তার বিরুদ্ধে তদন্ত করছে দুদক। প্রকৃতপক্ষে আমাদের একটি প্রক্রিয়ায় যাওয়া উচিত, যেখানে কেউ অপরাধ করলে তৃতীয়পক্ষ তদন্ত করবে।

বিশিষ্ট আইনজীবী ড. শাহ্‌দীন মালিক বলেন, একজন সাধারণ মানুষ অপরাধ করলে যে ধরনের শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়, পুলিশের কেউ অপরাধ করলেও সেই শাস্তির মুখোমুখি করা উচিত। তিনি বলেন, পুলিশ আইন ভেঙে কেন অপরাধে জড়াচ্ছে সেটা খুঁজতে হবে। পুলিশে নিয়োগ-বাণিজ্য বন্ধ করতে হবে। বাহিনীতে ঢুকতেই যদি কাউকে অপরাধের শিকার হতে হয়, পেশাগত জীবনে সে অপরাধ করবেই।

এর মধ্যে অনেকেই বলছেন পুলিশে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধের কথা। সব মিলিয়ে বাহিনীটি স্বচ্ছ থেকে জনগণের সেবক হয়ে থাকবে-এমনটাই মত তাদের। তাতে দেশেরও কল্যাণ।

বিচার বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য : ২০১০ কনস্টেবল থেকে এসআই পদমর্যাদার ১১ হাজার ৩৩ জনকে লঘুদণ্ড, ৫৩৮ জনকে গুরুদণ্ড, ৪৯ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৬৪ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ২০১১ সালে ১২ হাজার ৯৭২ জনকে লঘুদণ্ড, ৬১২ জনকে গুরুদণ্ড, ৯০ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৩৭ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর দেওয়া হয়। ২০১২ সালে ১২ হাজার ৯৯২ জন পুলিশ সদস্যের শাস্তি হয়। এর মধ্যে ১৭৪ জনকে চাকরিচ্যুত ও ১৪ জনকে বাধ্যতামূলত অবসরে পাঠানো হয়। ২০১৩ সালে ১৪ হাজার ৬০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭৫ জনকে চাকরিচ্যুত ও একজনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ২০১৪ সালে ১৫ হাজার ২৯৭ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ৭৩ জনকে চাকরিচ্যুত ও ৭ জনকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়। ২০১৫ সালে ১০ হাজার ৩৪ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে চাকরি হারান ৭৮ জন। ২০১৬ সালে ১৩ হাজার পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ২০১৭ সালে ১৬ হাজার ২৫৮ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৪ হাজার ৩৯৫ জনকে (কনস্টেবল থেকে এসআই পদবির) লঘুদণ্ড, ইন্সপেক্টর পদমর্যাদার ৩৫৭ জনকে গুরুদণ্ড ও ২৯ জনকে লঘুদণ্ড, ৭ জনের বিরুদ্ধে সাময়িক বরখাস্তসহ বিভাগীয় শাস্তি এবং ২৫ জনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ২০১৮ সালে ১২ হাজার ৭৩৩ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads