• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯
ডেঙ্গু আক্রান্তের চেয়ে আতঙ্ক বেশি

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

ডেঙ্গু আক্রান্তের চেয়ে আতঙ্ক বেশি

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ০৪ আগস্ট ২০১৯

‘পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে হাসপাতালে ঘুরি। মারাত্মক সব রোগী দেখি, কখনো ভয় পাইনি। কিন্তু এবার ডেঙ্গুর ভয়াবহতা দেখে ভয়ে আছি। শিশুদের কষ্ট দেখার মতো না। আমারও দুই বছরের একটি সন্তান আছে। ওকে নিয়ে চিন্তায় আছি। রাতে আতঙ্কে ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমের ঘোরে বারবার বাবুর গায়ে হাত দিই।’

ওপরের কথাগুলো বলছিলেন একটি ওষুধ কোম্পানির মার্কেটিং বিভাগে কাজ করা আওলাদ হোসেন। পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে ছোটেন তিনি। বিভিন্ন রোগে আক্রান্তদের মধ্যে তার অধিকাংশ সময় কাটে। রোগ আর রোগী দুটিই তার কাছে সাধারণ বিষয়। কিন্তু এবারের ডেঙ্গু সংক্রমণ সবকিছু বদলে দিয়েছে। যেমনটা বদলেছেন আওলাদ।

সম্প্রতি অনেকটা মহামারী আকারে দেখা দেওয়া ডেঙ্গু আওলাদকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের আর্তনাদ ও রোগীর চাপ দেখে নিজেও সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকেন। সন্তানের চিন্তায় কয়েক দিন ধরে রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। অজানা আতঙ্কে এক রাতেই ঘুম ভাঙে বারবার।

শুধু আওলাদ নন, রাজধানীতে বসবাস করা অধিকাংশ মানুষই এখন আতঙ্কের মধ্যে আছেন। বাসাবাড়ি, অফিস, স্কুল, ফুটপাত, চায়ের দোকান-সবখানেই ডেঙ্গু নিয়ে অজানা আতঙ্ক। যেকোনো আলোচনায়ই এখন স্থান করে নিচ্ছে ডেঙ্গু। গত শুক্রবার কলাবাগান এলাকায় মশক নিধনে ফগার মেশিন নিয়ে ঘুরছিলেন সিটি করপোরেশনের দুই কর্মচারী। এ সময় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী কাজী সাজ্জাদুল হককে বলতে বলতে শোনা যায়, ‘মশার ওষুধ পুরোটাই ভাঁওতাভাজি। শুধু ধোঁঁয়া দেখিয়ে মশাকে ভয় পাওয়ানোর চেষ্টা। এডিস মশা কি ভয় পায়! উল্টো আমরা ভয়ে আছি। স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও দুই মেয়রের আসনকেই ভয় পাইয়ে দিয়েছে মশা। পুরো দেশের সবকিছু বদলে দিয়েছে মশা। এখন মিন্নি, বন্যা, প্রিয়া, ক্রিকেট সব আলোচনা বাতিল হয়ে আমরা শুধুই এডিসময়, মশাময়।’

হাসির ছলে বলা হলেও সাজ্জাদের কথাগুলো কষ্টদায়ক। ডেঙ্গু আতঙ্ক কতটা ভয়ানক পর্যায়ে গেছে তা-ও বোঝায়। এমনই আতঙ্কে গত ২ আগস্ট শুক্রবার সন্ধ্যায় একসঙ্গে সাত বন্ধু ছুটে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডেঙ্গু সেলে। বহির্বিভাগ থেকে টিকেট কেটে চিকিৎসক দেখিয়ে ডেঙ্গুর পরীক্ষা করান।

হাসপাতালে আসার কারণ জানতে চাইলে নাজমুল ইসলাম নামের একজন বলেন, ‘ভাই, ডেঙ্গু এখন মারাত্মক। কখন কাকে ধরে বলা যায় না। হঠাৎ করেই শরীর গরম, জ্বর জ্বর বোধ করছিলাম। তাই হাসপাতালে এলাম।’

বিএসএমএমইউতে টিকেট কাউন্টারে দায়িত্বরত একজন বলেন, ‘মানুষের মধ্যে যে কি আতঙ্ক তা এখানে কিছুক্ষণ থাকলেই বুঝতে পারবেন। সুস্থ মানুষও ডেঙ্গুর ভয়ে দৌড়ে হাসপাতালে আসছেন। প্রতিদিন যত মানুষ ডেঙ্গুর পরীক্ষা করাতে আসছে, এর ১ শতাংশও বাস্তবে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত নন।’

বিএসএমএমইউ’র ডেঙ্গু সেলে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক বলেন, ‘এবার ডেঙ্গুর ধরন আলাদা। জ্বর না থাকলেও ডেঙ্গু হতে পারে। তবে এটাও সত্য ডেঙ্গু নিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক একটু বেশিই। অনেকে ডেঙ্গুর আতঙ্কে আমাদের কাছে ছুটে আসছেন। দেখে আমরা ধারণা করছি ডেঙ্গু হয়নি, তারপরও আমরা ডেঙ্গুর পরীক্ষা দিচ্ছি। এতে যিনি আমাদের কাছে আসছেন তিনি যেমন আতঙ্কমুক্ত হচ্ছেন, তেমনি আমরাও ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারছি।’

ওই চিকিৎসক আরো বলেন, ‘ডেঙ্গুতে এবার আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি, এই কথাটা কিন্তু ঠিক। আমার কাছে মনে হচ্ছে যত না মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হচ্ছে তার থেকে আতঙ্কের মাত্রা অনেক বেশি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘আতঙ্কিত হওয়াটাই স্বাভাবিক। মানুষ একটা কারণে আতঙ্কিত হয় না। এর পেছনে নানা কারণ থাকে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটছে।’ তিনি বলেন, ‘দিনের পর দিন একজন আতঙ্কের মধ্যে থাকলে নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। আতঙ্কের কারণে আপনার বডি সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করবে না। ব্লাড প্রেশারের সমস্যা দেখা দেবে। আতঙ্কে থাকলে ঠিকমতো খেতে পারবে না। ঠিকমতো নিজের সেবা-শুশ্রূষা করতে পারবে না। যারা দুর্বলচিত্তের, তাদের মধ্যে কোন রোগ তৈরি হয় তারও কোনো ঠিক নেই।’

কোরবানির হাটেও আতঙ্ক : রাজধানীর বিভিন্ন কোরবানির হাটে গরু ব্যবসায়ীদের মধ্যেও আতঙ্ক বিরাজ করছে। কোরবানির ঈদের আর কয়েকদিন বাকি। ঈদ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা গরু, ছগল, মহিষসহ বিভিন্ন পশু রাজধানীর পশুর হাটগুলোতে নিয়ে আসছেন। তাদের থাকতে হচ্ছে হাটেই। শুধু ব্যবসায়ী নন, হাসিল ঘরের কর্মীদের মধ্যেও ভয় কাজ করছে।

গত শুক্রবার রাজধানীর সবচেয়ে বড় পশুর হাট গাবতলী গিয়ে ব্যবসায়ী ও হাসিল ঘরের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্যই জানা গেছে।

কুষ্টিয়া থেকে গরু নিয়ে গাবতলী হাটে আসা রিয়াজুল হকের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘গরুর হাটে প্রচুর আবর্জনা থাকে। বিভিন্ন স্থানে পানিও জমে আছে। এসব আবর্জনা ও পানি থেকেই তো মশা-মাছি জন্ম নেয়।’

রিয়াজুল হক বলেন, ‘ভাই, মরার ভয় তো সবারই আছে। ঢাকায় এসে দেখি, সব জায়গায় শুধু ডেঙ্গুজ্বর। এটা দেখে খুব ভয় লাগছে। কখন যে এডিস মশা কামড় দেয়, সেটা তো জানি না।’

গরু ব্যবসায়ী হারুন মিয়া বলেন, ‘গরু নিয়ে এসেছি তিন দিন হয়েছে। রাতে এই হাটেই ঘুমাতে হয়। খুব মশা এখানে। তাই রাতে মশারি টাঙিয়ে ঘুমাই। শুনেছি, এই মশা নাকি কামড়ায় দিনের বেলা। কিন্তু দিনের বেলা অনেক কাজ থাকে। এখন দিনের বেলায় তো আর মশারি টাঙিয়ে বসে থাকা যায় না।’

গাবতলীর ১ নম্বর হাসিল ঘরের ক্যাশিয়ার মোহাম্মদ সোলায়মান বলেন, ‘কোরবানির হাট জমে উঠবে আর এক সপ্তাহের মধ্যেই। খুব ভয়ে আছি। কারণ, সারা দিন এখানেই তো বসে থাকতে হয়। ময়লা-আবর্জনা থাকে অনেক, আবার কিছু কিছু স্থানে পানিও জমে থাকে। তিনি বলেন, আমাদের হাটে প্রতিদিন ময়লা পরিষ্কার করা হয়। সিটি করপোরেশনের লোক এসে প্রতিদিন সকালে পুরো হাট পরিষ্কার করে দিয়ে যায়। আমাদের পক্ষ থেকেও লোক রাখা আছে। তারাও বিভিন্ন সময় পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে রাখে।’

আতঙ্ক নিয়েই কাজ করছেন চিকিৎসক-নার্সরা : ডেঙ্গু ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার পর শত শত মানুষ এখন ছুটছেন হাসপাতালগুলোতে। কেউ রোগী হিসেবে ভর্তি হতে, কেউবা ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে। তবে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ভয় এখন শুধু সাধারণ মানুষের মাঝে সীমাবদ্ধ নেই, এ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে হাসপাতালের চিকিৎসক ও নার্সদের মধ্যেও।

ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, দায়িত্বরত নার্সরা রোগীদের বারবার তাগাদা দিচ্ছেন মশারি টাঙানোর জন্য। নার্স মনি আক্তার বলেন, ‘আমরা নিজেরাও তো ভয়ে আছি। যেমন এই পেশেন্ট মশারি টাঙাল না। তাহলে কী হবে? মশা কামড় দেবে। তখন পাশের আরেক ব্যক্তি আক্রান্ত হতে পারে। এই যে আমরা কাজ করছি, সে জন্য আমরাও তো সেফ না।’

একই হাসপাতালের চিকিৎসক আইরিন নবী বলেন, সাধারণত এক দিনে যত রোগী দেখতাম, এখন তার তিনগুণ বেশি দেখছি।

শুধু সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল নয়, তার কাছেই ঢাকা শিশু হাসপাতালেও একই চিত্র। হাসপাতালের এক চিকিৎসক বলেন, ‘বিষয়টা যদিও আমাদের জন্য খুবই কষ্টকর, তারপরও আমাদের কাজ করতে হচ্ছে।’

অ্যাথলেটদের ডেঙ্গু আতঙ্ক : এসএ গেমসের অনুশীলন ক্যাম্পে বাড়ছে ডেঙ্গু আতঙ্ক। অ্যাথলেটদের সুরক্ষায় মশারি সরবরাহ করা হয়েছে, দেওয়া হচ্ছে মশানাশক ওষুধ। এবার বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন (বিওএ) সভাপতির নির্দেশে অ্যাথলেটদের সুরক্ষায় মাঠে নামছে সেনাবাহিনীর একটি দল।

গতকাল সুলতানা কামাল মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্সে ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা প্রতিরোধে কাজ করে সেনাবাহিনীর ওই দল। পরবর্তী সময়ে মোহাম্মদপুর শারীরিক শিক্ষা কলেজে স্থাপিত আবাসিক ক্যাম্পে এ কার্যক্রম পরিচালনা করে দলটি।

এরই মধ্যে দশের অধিক অ্যাথলেটকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছুটতে হয়েছে। তাদের তিনজন ডেঙ্গু আক্রান্ত। বাকিদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। কাবাডি খেলোয়াড় জান্নাতুল নাঈম বৃষ্টি, খো খো খেলোয়াড় আসমা ও বাস্কেটবল খেলোয়াড় বৃষ্টি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।

ঢামেকে কমছে ডেঙ্গু রোগী, ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি ৫৪ জন : ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ক্রমেই কমে আসছে। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল ১০টা পর্যন্ত) এ হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৫৪ জন। যা এর আগের কয়েক দিন একই সময়ে দুই শর বেশি ছিল।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক নাসির উদ্দিন জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ৫৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। এ সংখ্যাটি ছাড়িয়ে গিয়েছিল ২০০ এর ওপরে। যা এখন কমে আসছে।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ঢামেকে সর্বমোট ৬৯৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। প্রতিদিনই সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন আক্রান্তরা। গত ২৪ ঘণ্টায় ১৬৭ জন ডেঙ্গু রোগীকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads