• মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৭ বৈশাখ ১৪২৯
বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুর বিকাশ

ছবি : সংগৃহীত

জাতীয়

বাধাগ্রস্ত হচ্ছে শিশুর বিকাশ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৬ আগস্ট ২০১৯

শ্রেণি অনুসারে বইয়ের সংখ্যা নির্ধারণ করে অন্যান্য বইয়ের সংখ্যা কমিয়ে আনার প্রস্তাব এখনো আলোর মুখ দেখেনি।

প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ এমনকি আদালতের রায়ের পরও দেশের শিশুদের কাঁধ থেকে নামছে না বইয়ের বোঝা। পাঠ্যবইয়ের সঙ্গে প্রায় হাফডজন অনুমোদনহীন বই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর। ফলে প্রতিনিয়ত ভারী বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে চলতে গিয়ে শিশুদের যেমন মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তারা আক্রান্ত হচ্ছে নানা রোগে।

শিশুর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, সেজন্য উন্নত দেশ এমনকি পার্শ্ববর্তী ভারতেও শিশুদের ওপর থেকে বইয়ের চাপ কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

চিকিৎসক ও শিক্ষাবিদরা বলেছেন, উন্নত দেশের মতো যে কোনো উপায়ে বইয়ের সংখ্যা কমানো জরুরি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনহীন বই চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিনিয়ত ভারী বইয়ের বোঝা কাঁধে বহন করার কারণে শিশুরা আর্থ্রাইটিস ও অস্টিওপোরোসিসের মতো জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারে, যা ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বিশেষজ্ঞরা পাঠ্যবইয়ের বোঝা কমাতে একটি বইয়ের মধ্যে দুই থেকে তিনটি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করারও প্রস্তাব দিয়েছেন।

দেশের অন্যতম নামি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সেখানে সরকারি নির্দেশ মেনে কেবল জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) অনুমোদিত বই পড়ানো হয়। কিন্তু সরকার অনুমোদিত বই হলেও রক্ষা নেই শিশুদের।

ষষ্ঠ শ্রেণির শিশুকে পড়তে হয় ১২টি বিষয়, যার জন্য পাঠ্যবই রয়েছে সমপরিমাণে। এই শ্রেণিতেই বাংলা প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র। ইংরেজি প্রথম ও দ্বিতীয় পত্র। কৃষিশিক্ষা, অঙ্ক, বিজ্ঞান, অর্থনীতি, ধর্ম, কর্ম ও জীবনমুখী শিক্ষা, চারু ও কারুকলা এবং সমাজ। শিশুদের এক ডজন বই ও সমপরিমাণ খাতা নিত্যসঙ্গী। এর সঙ্গে যুক্ত আছে প্রতিটি বিষয়ে ভালো করার জন্য শিক্ষকদের দেওয়া কোচিংয়ের পড়ার চাপ। অভিভাবকরা বলছেন, অসংখ্য বইয়ের পড়ার চাপে শিশুরা অসুস্থ হয়ে পড়ে প্রায়ই।

প্রতিদিন ১২ বিষয়ের ক্লাস না হলেও অন্তত সাতটি ক্লাস হয়। সেক্ষেত্রে সাতটি বই, সাতটি খাতা, কলম, পানির বোতল, খাবারসহ প্রত্যেক শিশুকে একটি বিশাল ব্যাগ বহন করতে হয়। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণি পার হওয়ার পর শুরু হয় অসংখ্য অনুমোদনহীন বই পড়ানোর চাপ। ফলে প্রত্যেক শ্রেণিতে সরকার অনুমোদিত বইয়ের বাইরেও কর্তৃপক্ষের চাপিয়ে দেওয়া অনেক বই পড়তে বাধ্য করা হয় শিশুদের।

শহরাঞ্চলের কিন্ডারগার্টেনে শিশুদের ১৩ থেকে ১৪টি বিষয়ও চাপিয়ে দেওয়া হয়। এসব বই প্রকাশনা সংস্থার কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা নিয়ে পাঠ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এনসিটিবি প্রতিবছর অনুমোদনহীন বই পড়ানোর বিরুদ্ধে লোকদেখানো হুঁশিয়ারি দিচ্ছে।

রাজধানীর একটি হাসপাতালে এক অভিভাবক তার শিশুসন্তানকে নিয়ে যান চিকিৎসকের কাছে। কারণ প্রাথমিকের ওই শিশুটির কদিন ধরেই পিঠে ব্যথা। ব্যথা অনুভবের পর শিশুটির বাবা চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন। চিকিৎসক দেখে বললেন, ঘাড়ে ভারী ব্যাগ বহনের কারণে শিশুটির হাড়ে সমস্যা হচ্ছে। এ সময় শিশুটি জানায়, তাদের ক্লাসের অনেকেরই এমন হয়। কিন্তু সব বই ক্লাসে না নিয়ে গেলে শিক্ষকরা রাগারাগি করেন। তাই সবাই বইখাতা নিয়ে আসে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অসংখ্য পাঠ্যবইয়ের চাপ ও ভারী ব্যাগের কারণে শিশুদের ক্ষতির কথা অস্বীকার করছেন না প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টরা।

এক শিক্ষক বলেন, আসলে একটি শিশুকে যখন অনেক বিষয়ের চাপ নিতে হয়, তখন তার মনে প্রভাব পড়বেই। তার ওপর যদি অনেক বইখাতা নিয়ে তাকে প্রতিনিয়ত স্কুলে আসতে হয়, তাহলে তার শারীরিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হয়।

কীভাবে বইয়ের সংখ্যা কমানো যায়? এমন প্রশ্নে এই শিক্ষক বলছিলেন, আমাদের সময়েও ছিল একটি বইয়ের মধ্যে অনেক বিষয়। ক্যামেস্ট্রি আর বায়োলজি যুক্ত করে একটি বই। এভাবে করতে পারলেও বইয়ের সংখ্যাটা কমে।

অন্যদিকে পাশের দেশ ভারতে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর বইয়ের চাপ কমাতে কাজ শুরু হয়েছে অনেক আগেই। অথচ বাংলাদেশে চাপ কমানোর পরিবর্তে যেন দিন দিন শিশুদের ওপর চাপ বাড়ানোই হচ্ছে। অথচ শিশুদের বইয়ের বোঝা কমাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বহুবার নির্দেশ দিয়েছেন। এ বিষয়ে আছে উচ্চ আদালতের রায়ও। প্রায় তিন বছর আগে এক রায় দিয়ে একটি আইন প্রণয়নের নির্দেশনাও দিয়েছিলেন হাইকোর্ট। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষার্থীর শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভারী ব্যাগ বহন করা যাবে না বলে রায় দিয়েছিলেন আদালত। রায়ের কপি পাওয়ার ছয় মাসের মধ্যে এ বিষয়ে আইন করতে সরকারকে নির্দেশও দেওয়া হয়। হাইকোর্টের এই রায়ে আশা জেগেছিল। কিন্তু ফলাফল শূন্য।

এদিকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা দাবি করেন, আমাদের প্রকাশিত বইয়ের আকার ও ওজন খুবই কম। সরকারি কোনো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এনসিটিবি প্রকাশিত বইয়ের অতিরিক্ত পড়ানো হয় না। এর সঙ্গে খাতা থাকে। সব মিলিয়ে প্রথম শ্রেণির বইয়ের ওজন হয়তো এক কেজিও হবে না। অথচ প্রাথমিকের সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে আছে বহু প্রতিষ্ঠান। আছে হাজার হাজার কেজি স্কুল, যার দায়িত্বও এই মন্ত্রণালয়ের। প্রতিটি কিন্ডারগার্টেন অযাচিত বই পাঠ্যভুক্ত করে। ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে ওঠা ওইসব প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনেই চলছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুদের শরীরের ওজনের ১০ শতাংশের বেশি ভার বহন করা উচিত নয়। এতে শিশুদের পিঠ ও পায়ে ব্যথাসহ বিভিন্ন রকমের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শিশুরা হয়ে যেতে পারে বামন বা খর্বাকৃতির। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া-আসা দুবার করে ব্যাগ টানতে গিয়ে এসব শিশু শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে গিয়ে কখনো কখনো বেঁটে হওয়ার কারণ হতে পারে।

ঢাকা মেডিকেলের চিকিৎসক ডা. সমরেশ হাজরা সেন্ট যোসেফ স্কুলের উদাহরণ টেনে বলেন, সেন্ট যোসেফে তৃতীয় শ্রেণির একটি শিশুকে যেসব বিষয় পড়ানো হয়, সেসব বিষয়ের প্রশ্ন আমার ধারণা দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের পরীক্ষাতেও আসে না। এভাবে শিশুদের ওপর চাপ দিলে নেতিবাচক ফল হবেই।

ভারী ব্যাগের কারণে ছোটবেলা থেকেই শিশুদের ব্যাক পেইন বা মেরুদণ্ডের ব্যথায় ভোগার আশঙ্কা থাকে। কিন্তু সমস্যা সমাধানের উপায় কী? শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. মাকসুদ কামাল বলছিলেন, শিশুদের ওপর পরীক্ষা ও বইয়ের বোঝা অবশ্যই কমাতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads