• মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৭ জৈষ্ঠ ১৪২৮

জাতীয়

পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের হয়রানি বন্ধ হয়নি

টাকা ছাড়া মেলে না পুলিশ প্রতিবেদন

  • এমদাদুল হক খান
  • প্রকাশিত ২৭ আগস্ট ২০১৯

আমি এসবির সাব ইন্সপেক্টর। আপনার পাসপোর্ট ভেরিফিকেশন রিপোর্টটি তদন্তের ভার আমার ওপর। এটি দ্রুত পেতে হলে আমাকে বিকালে দুই হাজার টাকা পাঠান। টাকা পেলে কালই প্রতিবেদনটি জমা দেওয়া হবে। এভাবেই ফোন করে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। শুধু তা-ই নয়, পাসপোর্ট করতে গিয়ে নানা রকম হয়রানির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ।

রাজধানীসহ দেশের অধিকাংশ পাসপোর্ট অফিসই এখনো দালালদের হাতে জিম্মি। টাকা না দিলে অনেক সময় আবেদনপত্রও জমা দিতে পারেন না সাধারণ মানুষ। নানা অজুহাতে আবেদনপত্র জমা নেওয়া হয় না। তবে দালালের হাতে টাকা দিলে দ্রুত আবেদনপত্র জমা দেওয়া যায়। এদিকে আবেদন জমা দিতে পারলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কারণে নির্ধারিত সময়ে পাসপোর্ট হাতে পান না আবেদনকারীরা। টাকা ছাড়া পুলিশি রিপোর্ট পৌঁছায় না পাসপোর্ট অফিসে। আবেদনকারীকে জিম্মি করে টাকা আদায় করেন পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের সদস্যরা। টাকা না দিলে দীর্ঘদিন আবেদনপত্র পড়ে থাকে এসবি অফিসে। ফলে জরুরি প্রয়োজনে অতিরিক্ত ফি দিয়েও পাসপোর্ট পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা।

নাহিদ হাসান রুমি নামে এক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন, তিনি আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। এর দুদিন পরই ০১৫৩৩-১০১৭৪০ নম্বর থেকে এক ব্যক্তি ফোন করে বলেন, আমি এসবির সাব-ইন্সপেক্টর আসাদ বলছি। আপনি যে পাসপোর্টের আবেদন করেছেন, আমি তার তদন্তকারী কর্মকর্তা। আপনার ফাইলটি আমার কাছে আছে। দুই হাজার টাকা বিকাশ করেন, তাহলে কালই আপনার প্রতিবেদন পৌঁছে যাবে। অনেক দেনদরবার করে তাকে ১ হাজার ২০০ টাকা পাঠান। এরপর ২-৩ দিন পর আবার মোশাররফ নামে এক ব্যক্তি নিজেকে এসবির এসআই পরিচয় দিয়ে ০১৭১৪-৭৮৯৪৯৬ নম্বর থেকে ফোন করেন। এরপর দ্বিধায় পড়ে যান নাহিদ হাসান। একপর্যায়ে তিনি বুঝতে পারেন, আগে তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন।

এ বিষয়ে পিবিআই ঢাকা মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ জানান, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের পাশে একটি স্টুডিও ও ফটোকপির দোকানের সামনে থেকে সম্প্রতি প্রতারক চক্রের তিন সদস্যকে গ্রেপ্তার করে পিবিআই। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, এ ধরনের প্রতারণায় জড়িত রয়েছে রুবেল, মনির ও ইউসুফসহ আরো ৭-৮ জন। চক্রের প্রধান রাকিব মিয়া।

আবুল কালাম আজাদ জানান, আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিস এলাকার বিভিন্ন ফটোকপির দোকানদার ও দালালদের কাছ থেকে প্রতিটি আবেদন ফরমের কপি ২০০-৩০০ টাকার বিনিময়ে সংগ্রহ করে তারা। সেই ফরমে দেওয়া মোবাইল নম্বরে ফোন করে এসবির পুলিশ অফিসার পরিচয় দিয়ে আবেদনকারীদের কাছে ভেরিফিকেশনের খরচ বাবদ টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। প্রতিদিন তারা অন্তত ৫০ জন আবেদনকারীকে ফোন করে। ফোন করার জন্য তারা শেরেবাংলা নগর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠসহ বিভিন্ন নিরিবিলি স্থান বেছে নেয়। আবেদন করার দু-তিন দিন পর অফিস সময়ে ফোন করে তারা। বেশির ভাগ সময় আবেদনকারীরা দেখা করতে চাইলে তারা বলে, খরচের বিষয় আছে, আপনি আমার বিকাশ নম্বরে টাকা পাঠিয়ে দেন। আমি রিপোর্ট যথাসময়ে পাঠিয়ে দেব।

কামাল আহমেদ নামে এক ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি পাসপোর্ট রিনিউয়ের জন্য আবেদন করেন। ২১ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও তিন মাস ঘুরে পাসপোর্ট সংগ্রহ করা হয়েছে। অথচ আমার এক বন্ধু দালালের সহযোগিতা নিয়ে ২১ দিনের জায়গায় ১২ দিনে পাসপোর্ট হাতে পেয়েছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাজধানীসহ দেশের পাসপোর্ট অফিসগুলোতে বাড়ছে দালাল চক্রের তৎপরতা। বিশেষ করে আগারগাঁওয়ের পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্য কিছুতেই যেন থামছে না। অফিসের ভেতরে-বাইরে, এমনকি রাস্তার ওপরও দালালদের সরব উপস্থিতি চোখে পড়ার মতো। মাঝেমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে গুটিকয়েক দালাল ধরা পড়লেও বাকিরা নির্বিঘ্নে তাদের কাজ করে যাচ্ছে। পাসপোর্টের ফরম পূরণ করে জমা দেয়, টাকা জমা দেওয়া থেকে শুরু করে তা হাতে পাওয়া পর্যন্ত-সব জায়গাতেই রয়েছে দালালদের অবাধ যাতায়াত। আর এই দালাল চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও যোগসাজশ থাকার অভিযোগ রয়েছে।

ভুক্তভোগীরা বলছেন, রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে দালালদের দৌরাত্ম্যে দিন দিন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মানুষ। দালাল, কর্তব্যরত আনসার সদস্য এবং পাসপোর্ট অফিসের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে গড়ে তুলেছেন একটি সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট। আর এ সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ে প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার হচ্ছেন আবেদনকারীরা। এই সিন্ডিকেটকে পাস কাটিয়ে সহজে পাসপোর্ট পাওয়া অনেকটাই অসম্ভব। পাসপোর্ট পেতে কোনো না কোনোভাবে পড়তে হয় দালালদের কবলে। পাসপোর্ট অফিসে সেবা নিতে আসা অনেকেই কর্মচারীদের দুর্ব্যবহার ও অসহযোগিতার অভিযোগ করেন। প্রতিনিয়ত তারা দালালের দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ ও প্রতারিত হচ্ছেন। আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে সরেজমিন গিয়ে এ ধরনের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।

পাসপোর্ট ফরম জমা দেওয়ার পর সাহিদ উদ্দিন নামে সত্তোর্ধ এক বৃদ্ধের সঙ্গে কথা হয়। তিনি জানান, বাবা বলে লাভ কি? সকালে আসছি একবার এই ফ্লোরে তো আরেকবার ওই ফ্লোরে পাঠিয়ে দেয়। কারো কাছে সহযোগিতা চাইলে সবাই বলে ব্যস্ত, অন্য জায়গায় দেখান। এই করে করে নিজেই হেঁটে হেঁটে পাঁচতলায় উঠেছি। ছবি তুলে এখন যাচ্ছি। লিফটে উঠতে গেলে লম্বা লাইন। এখানে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকলে ওদিকে আবার লাইনের পেছনে পড়ে যাই। তাই ভোগান্তি মাথায় নিয়েই আমাকে যেতে হবে।

এ প্রসঙ্গে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের পরিচালক আবদুল্লাহ আল-মামুন জানান, আমাদের প্রতিদিন যে পরিমাণ পাসপোর্ট প্রিন্ট, আবেদন গ্রহণ ও সম্পূর্ণ করার ক্ষমতা রয়েছে, প্রতিদিন তার থেকে কয়েক গুণ আবেদন জমা পড়ে। ফলে নির্ধারিত সময়ে কিছু আবেদনকারী পাসপোর্ট পান না। ব্যবস্থাপনার এই ঘাটতির সুযোগ নেয় একশ্রেণির কর্মচারী ও দালাল।

রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা জান্নাতুল ফেরদৌস ছয় হাজার ৯০০ টাকা জমা দেন জরুরিভাবে পাসপোর্ট পেতে। সাত দিনের মধ্যে তার পাসপোর্ট পাওয়ার কথা থাকলেও এসবি রিপোর্টের কারণে তিনি প্রায় এক মাস পর পাসপোর্ট হাতে পান। একই অভিযোগ খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা শারমীন আক্তারের। তিনি বলেন, আমার জরুরি পাসপোর্ট দরকার ছিল। তাই ছয় হাজার ৯০০ টাকা ব্যাংকে জমা দিয়ে পাসপোর্টের জন্য জরুরি আবেদন করি। কিন্তু নির্ধারিত ডেলিভারির তারিখ পার হলেও পাসপোর্ট না পেয়ে এসবি অফিসে যোগাযোগ করি। সেখানে গিয়ে জানতে পারি, আমার পাসপোর্টের পুলিশি প্রতিবেদন আটকে রাখা হয়েছে। টাকা না দিলে রিপোর্ট ছাড়া হবে না। পরে সংশ্লিষ্ট এসবির অফিসারের দাবিকৃত টাকা দিলে আমার প্রতিবেদনটি পাসপোর্ট অফিসে পাঠানো হয়। ফলে সাত দিনের জায়গায় আমার পাসপোর্টটি হাতে পেতে লেগে যায় দেড় মাস। 

এ ব্যাপারে স্পেশাল ব্রাঞ্চের পাসপোর্ট বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার ফরিদা ইয়াসমিন বলেন, আমরা যত দ্রুত সম্ভব রিপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখা যায়, আবেদনকারী ঠিকানা ঠিকমতো লেখেনি। তখন একটু সময় লাগে। কোনো অফিসার টাকা না পেলে তদন্ত রিপোর্ট আটকে রাখেন-এমন অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, কারো বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে দুয়েক জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তিনি কোনো আবেদনকারীকে অর্থনৈতিক লেনদেন না করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, কেউ টাকা দাবি করলে বিষয়টি যেন তাকে জানানো হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads