• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

আজ দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী

যার শূন্যতায় ভুগছে এখনো নগরবাসী

  • হাসান শান্তনু
  • প্রকাশিত ৩০ নভেম্বর ২০১৯

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রয়াত মেয়র আনিসুল হকের নেওয়া অন্তত ১০টি বড় উদ্যোগ ও প্রকল্পের অগ্রগতি থেমে আছে। কিছু উদ্যোগের বাস্তবায়ন চলমান হলেও গতি একবারেই ধীর। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, দলীয় চিন্তার সীমাবদ্ধতা, চক্রের স্বার্থগত সমীকরণ ও দায়িত্বরতদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাহসিকতার অভাবে প্রকল্পগুলো প্রত্যাশিত গতি পাচ্ছে না। জনপ্রিয় ওই মেয়রের প্রয়াণের পর থেকে ডিএনসিসির দাপ্তরিক কাজেও ধীরে ধীরে ফিরে এসেছে গতিহীনতা। ঢাকা উত্তরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমেও ঢিলেমি ভাব। প্রায়ই দলীয় ও ব্যক্তিগত স্বার্থ বিবেচনায় ঠিকাদারি পাওয়ায় কাজের স্বচ্ছতা ও মান নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এসব নিম্নমানের কাজের ধকল আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে সইতে হচ্ছে নগরের বাসিন্দাদের।

জানা গেছে, নগরের দায়িত্বপ্রাপ্তদের নাগরিকসেবা দেওয়ার কার্যক্রমও আনিসুল হকের সময়ের তুলনায় গতি হারিয়ে ফেলেছে। স্বপ্নদ্রষ্টা ওই নগরপিতার মৃত্যুর পর একপর্যায়ে নির্বাচিত মেয়র ও জনপ্রতিনিধি পেলেও নগরবাসীর দুর্ভোগ কমছে না। নানা কারণে যেন বাড়ছেই ভোগান্তি। ডিএনসিসির দাপ্তরিক ভবনের টেবিলে টেবিলে জমছে লিখিত অভিযোগের স্তূপ। সমাধান খুব সামান্য মিললেও আশ্বাসের ফুলঝুরি ফুটছে। চুপটি মেরে থাকা অসৎ কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা মাথাচাড়া দিয়ে ফের চর্চা করছেন তাদের সেই পুরনো ‘অভ্যাস’।

জনদুর্ভোগ কমানোর মতো সিদ্ধান্ত নিতে অনীহার পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতির ‘প্রতিযোগিতায়’ ডিএনসিসিকে যেন হারাতে চাচ্ছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনও (ডিএসসিসি)। অথচ আনিসুল হকের অসমাপ্ত কাজ ‘সমাপ্তের’ ঘোষণাও দিয়েছিলেন ডিএসসিসি মেয়র সাঈদ খোকন। আনিসুল হক বিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের উত্তরের মেয়র হলেও বিদ্যমান পরিস্থিতিতে তার শূন্যতা যেন ভুগছেন পুরো নগরবাসীই। তার অভাবও টের পাচ্ছেন তারা।

নগরবিদ ও ডিএনসিসির কয়েক কর্মকর্তা বাংলাদেশের খবরকে বলেন, আনিসুল হকের নেওয়া প্রশংসিত উদ্যোগগুলো তার মৃত্যুর পর চালিয়ে নেওয়ার মতো নেতৃত্ব না থাকাই এর মূল কারণ। অপরিকল্পিত ঢাকা নগরীকে তিনি নতুন একটা পরিকল্পনা কাঠামোর মধ্যে এনে নতুন করে সুন্দর, আধুনিক ও রুচিশীল রাজধানী উপহার দিতে চেয়েছিলেন দেশবাসীকে। সেই লক্ষ্যে তিনি কাজও শুরু করেছিলেন। কাজগুলো যখন মাঝপথে তখনই তিনি পাড়ি জমান পরপারে। ফলে তার অসমাপ্ত কাজগুলো থমকে আছে।

তার উদ্যোগগুলোর পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা না হলে নগরবাসী বঞ্চিত হবেন বলে মনে করেন নগর গবেষণা কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ঢাকায় আনিসুল হকের মতো শক্তিশালী নেতৃত্ব দরকার।’

ঢাকা উত্তরের বাসিন্দারা অভিভাবক না থাকা সন্তানের মতো ছন্নছাড়া ও স্বপ্নহীন ছিলেন যখন, ঠিক তখন তিনি ডিএনসিসির দায়িত্ব নেন। অনাথ ডিএনসিসিকে দুই হাতে আগলে ধরে বুকে টানেন। নগরবাসীকে তিনি প্রথমবারের মতো সাহসী স্বপ্ন দেখান। পরিচ্ছন্ন ঢাকা ও সবুজ ঢাকার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন তিনি। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি পেলেও নগরবাসীকে আনিসুল হকের মতো কেউ স্বপ্ন দেখাতে পারছেন না। স্বপ্ন যেখানে নেই, সেখানে তা বাস্তবায়নের প্রশ্নও আসে না। ‘সমস্যা চিহ্নিত এবার সমাধান যাত্রা’-এ স্লোগানে ২০১৫ সালে ডিএনসিসির মেয়র পদে নির্বাচন করে জয়ী হন আনিসুল হক। ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর লন্ডনের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। নগরবাসীর নানা আশা-নিরাশা ও হতাশার দোলাচলে আজ পূর্ণ হচ্ছে তাকে হারানোর দুই বছর।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, রাজধানীর যে সমস্যাগুলোয় কেউ কোনোদিন হাত দেননি, সমাধানের জন্য কেউ কখনো কথা বলেননি, উদ্যোগ নেননি-এমনকি কখনো প্রতিশ্রুতি দেওয়ার জন্যও প্রতিশ্রুতি দেননি, মেয়র নির্বাচিত হয়ে আনিসুল হক শুরু থেকেই ঠিক সেই বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেন। ঢাকার গুলশান-বারিধারায় বিভিন্ন বিদেশি দূতাবাস ফুটপাতের জায়গা দখল করে নিরাপত্তা চৌকি গড়ে তোলে। কোনো উন্নয়নশীল দেশে প্রভাবশালী দেশগুলোর দূতাবাসের এ ধরনের নিরাপত্তা স্থাপনা অপসারণ করা সম্ভব-তা কল্পনাও করতে পারেননি কেউ। অথচ এখন এসব এলাকার ফুটপাত দিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরা করতে পারছেন নগরবাসী। কাজটি করেছিলেন আনিসুল হক। অল্প সময় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পেলেও তিনি এরকম আরো অনেক জনপ্রিয় ও সাহসী পদক্ষেপের স্বাক্ষর রেখে গেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৫ সালে ডিএনসিসির মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর সাহসী কিছু পদক্ষেপ নেন আনিসুল হক। একে একে ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী করার বিভিন্ন উদ্যোগ নেন তিনি। ঢাকার তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনের সড়কটি দখলমুক্ত করে সাড়া জাগিয়েছিলেন আনিসুল হক। নিরাপত্তার নামে কংক্রিটের বণ্টক বসানোয় ফুটপাতে পথচারী চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ২০১৫ সালের ২৯ নভেম্বর তেজগাঁওয়ে অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে গিয়ে তিনি অবরুদ্ধ হন। তবু পিছু হটেননি। তেজগাঁও সাতরাস্তা থেকে তেজগাঁও রেলক্রসিং পর্যন্ত সড়কের ওপর অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে সক্ষম হন। পরে সড়কটির আধুনিকায়ন করে দৃষ্টিনন্দন সড়ক বিভাজক নির্মাণ করা হয়। সড়কের ভূমি ও জরিপ অধিদপ্তরের সামনের সড়কজুড়ে এখন মাঝেমধ্যে ট্রাক রাখা হচ্ছে। সাতরাস্তা মোড়ে এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানির উল্টোদিকে তেজগাঁও ট্রাকস্ট্যান্ডের সামনে এবং রেলক্রসিংয়ের আগে সড়কের পাশে এক সারি করে ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান দাঁড় করিয়ে রাখা হচ্ছে। অথচ আনিসুল হক বেঁচে থাকাকালে এমন দৃশ্য দেখতে হয়নি।

এ ছাড়া তিনি গাবতলী, কল্যাণপুর, আমিনবাজার, মহাখালী, মোহাম্মদপুর ও আবদুল্লাহপুর বাসস্ট্যান্ডসহ ডিএনসিসির আরো আটটি এলাকা পার্কিংমুক্ত করেন। এসব জায়গায়ও অবৈধ পার্কিং ফিরে আসছে। আনিসুল হক মেয়র থাকাকালেই স্বাধীনতাবিরোধী মোনায়েম খানের পরিবারের অবৈধ দখল থেকে ১৪ কাঠা জমি উদ্ধার করে ডিএনসিসি। পাশের কবরস্থানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওই জায়গায় একটা পার্কের নকশা করা হয়। তার এ সাহসিকতা সে সময় সব মহলেই ব্যাপক প্রশংসিত হয়।

এখন এ নিয়ে আলাদা কোনো প্রকল্প ডিএনসিসিতে নেই। তিন বছরে পাঁচ লাখ গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিয়ে ২০১৬ সালের মে মাসে ‘সবুজ ঢাকা’ প্রকল্প উদ্বোধন করা হয়। রাস্তায় প্রয়োজনীয় আলো ও নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে এলইডি বাতি ও সিসি ক্যামেরা বসানোর প্রকল্প নেন নগরবাসীর কাছে অন্ধকারে আলোর প্রদীপের মতো প্রয়াত মেয়র। তার মৃত্যুর পর প্রকল্পগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে। বাস্তবায়ন হয়নি কারওয়ানবাজার স্থানান্তরের কাজও। নানা জটিলতায় আটকে আছে আনিসুলের নেওয়া ঢাকার গণপরিবহনকে সমন্বিত করার পরিকল্পনাও। গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে চার হাজার বাস নামানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। ঢাকা শহরে এক কোম্পানির অধীনে বাস চালু করার উদ্যোগের পাশাপাশি সড়ক ব্যবস্থার আধুনিকায়নে ইউলুপ নির্মাণেরও উদ্যোগ নেন তিনি। রাজধানীতে গণশৌচাগারের তীব্র সংকট থেকে উত্তরণে মেয়র ১০০টি আধুনিক গণশৌচাগার নির্মাণের উদ্যোগ নেন। ওয়াটারএইডের সহায়তায় বেশ কয়েকটি চালু হয়েছে। ডিএনসিসি এখন বলছে, গণশৌচাগার নির্মাণের মতো জায়গা পাওয়া যাচ্ছে না।

আনিসুল হকের দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণে আজ শনিবার পরিবারের পক্ষ থেকে তার আত্মার শান্তি কামনা করে ঢাকার গুলশান আজাদ মসজিদে আসর নামাজের পর বিশেষ দোয়া করা হবে। এর আগে সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে তার কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হবে। গত বৃহস্পতিবার বিকালে তার গড়ে তোলা নাগরিক টেলিভিশনে দোয়া অনুষ্ঠিত হয়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads