• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা আড়ালেই থাকছে

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা আড়ালেই থাকছে

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২০

সড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাগুলোর পাশাপাশি ঘটছে যৌন হয়রানি, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাও। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে নানা পরামর্শ ও বিভিন্ন দাবি উপস্থাপিত হলেও গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার জন্য নারীবান্ধব পরিবহন ব্যবস্থা গড়তে হবে। পাশাপাশি নারী গাড়িচালক প্রশিক্ষিত করার ক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে বলে মনে করছেন নারী অধিকার সংগঠকরা। সম্প্রতি প্রকাশিত ব্র্যাকের ‘নারীর জন্য যৌন হয়রানি ও দুর্ঘটনামুক্ত সড়ক’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের গণপরিবহনে যাতায়াতের সময় ৯৪ শতাংশ নারী মৌখিক, শারীরিক বা অন্য কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছেন। ৪১ থেকে ৬০ বছর বয়সী পুরুষদের দ্বারাই যৌন হয়রানির শিকার হন বেশিরভাগ নারী, যার হার ৬৬ শতাংশ। নারীদের যৌন হয়রানির মূল কারণ হচ্ছে আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ না থাকা, বাসে অতিরিক্ত ভিড়, যানবাহনে পর্যাপ্ত আলোর অভাব ইত্যাদি।

ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, শারীরিকভাবে যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে ৮১ শতাংশ নারী বলেছেন, তারা চুপ থাকেন এবং ৭৯ শতাংশ বলেছেন আক্রান্ত হওয়ার স্থান থেকে সরে যান।

এ ব্যাপারে ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস অ্যান্ড ডাইভার্সিটি প্রোগ্রামের জেন্ডার স্পেশালিস্ট হোসনে আরা বেগম বলেন, সমান অধিকারের কথা বললেও সমানাধিকার নীতি এখনো আমরা করতে পারিনি। শুধু গণপরিবহন নয়, নারীর চলাচলের সবদিকই আমাদের ভাবতে হবে। গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তার কথা বলছি; কিন্তু পরিবহনে হয়রানির পর শুধু কয়েকটি সংগঠন বা কয়েকজন নারীই প্রতিবাদ করেন। স্বাধীনভাবে গণপরিবহনে চলাচলের ক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিতে বিভিন্ন পরিবহন সংস্থা বা ধর্মীয় সংগঠনের এগিয়ে আসা উচিত।

সম্প্রতি প্রকাশিত বেসরকারি সংগঠন অ্যাকশন এইডের একটি জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বড় শহরগুলোতে দিনে যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে নানারকম হেনস্তার শিকার হন নারী যাত্রীদের একটা বড় অংশ। বাসে পুরুষ যাত্রীদের মাধ্যমে ৪২ শতাংশ ও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হন ৫৩ শতাংশ নারী যাত্রী।

২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বগুড়ায় পরীক্ষা দিয়ে বাসে কর্মস্থল ময়মনসিংহে যাবার পথে জাকিয়া সুলতানা রূপা নামে এক কলেজছাত্রীকে গণধর্ষণের পর হত্যা করে গাড়ির চালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজর। ঘটনার পরে রূপার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্ত শেষে বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে টাঙ্গাইলে দাফন করা হয়। রূপা ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১৮ সালে বাসের চালক এবং সহকারীসহ চারজনের ফাঁসির আদেশ দেন আদালত।

২০১৯ সালের ১০ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম মহানগরে চলন্ত বাসে এক গৃহবধূকে ধর্ষণের চেষ্টার ঘটনা ঘটে। ঘটনার সময় সেই নারীর চিৎকারে শুনে পেছনে থাকা গরুবোঝাই একটি ট্রাকের চালক বাসটির গতিরোধ করেন। পরে স্থানীয় লোকজন বাসের চালক ও তার সহকারীকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন।

পোশাক কারখানায় কাজ শেষে জামালপুরে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বাস ধরতে গত ২৪ জানুয়ারি রাত সাড়ে ৯টার দিকে আশুলিয়ার বাইপাইল এলাকায় যান এক পোশাককর্মী। সেখানে এক পিকআপ ভ্যানের চালক নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা বলে ওই পোশাককর্মীকে তুলে নেন। পরে চালক ও হেলপার মিলে তাকে ধর্ষণ করে ফেলে যায় রাস্তায়।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, রাস্তাঘাট, গণপরিবহনসহ সর্বত্র উদ্বেগজনকভাবে নারী ও শিশু নির্যাতনের ভয়াবহতা বেড়েছে। নারীরা স্বাধীন চলাফেরায় অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ছে। এ অবস্থার উত্তরণের জন্য ধর্ষণের বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতা’র নীতি গ্রহণ ও দ্রুত কার্যকরে প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্টদের কাছে জোর দাবি জানান তিনি।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, ধর্ষণ, শ্লীনতাহানি কিংবা যৌন হয়রানি রোধে অভিযুক্তদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর টহল জোরদার করার পাশাপাশি নারীর চলাচল নিরাপদ করার লক্ষ্যে গণপরিবহনে সিসি ক্যামেরা স্থাপনে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় এবং পরিবহন মালিক সমিতিকে।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) বলছে, দেশে অপেশাদার চালক হিসেবে লাইসেন্স নেওয়া নারীর সংখ্যা বাড়লেও পেশাদার হিসেবে লাইসেন্স নেওয়া নারীর সংখ্যা বাড়েনি। পেশাদার নারী চালকের সংখ্যা পেরোয়নি ৩ হাজারও। যদিও নতুন সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮তে নারী চালক নিয়োগে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।

ব্র্যাকের প্রশাসন এবং সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচির পরিচালক আহমেদ নাজমুল হোসাইন বলেন, সরকারি নিয়োগে ১০ শতাংশ নারী কোটা থাকে। সরকারি দপ্তরে গাড়িচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে এ কোটা পূরণই হয় না। ভারী যান চালানোর লাইসেন্সসহ যেসব শর্ত থাকে তা নারীরা পূরণ করতে পারেন না। ফলে নারীরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে আবেদনই করতে পারছেন না।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, নারীবান্ধব চালক তৈরিতে ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল নারীদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ পর্যন্ত অপেশাদার মৌলিক গাড়িচালনা প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ৭ হাজার ৩৮৮ জন, যার মধ্যে ১ হাজার ৯৭৩ জন নারী। পেশাদার চালকের প্রশিক্ষণ পেয়েছেন ১০ হাজার ৩৭৩ জন, যার মধ্যে ২১৪ জন নারী। ভবিষ্যতে ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল প্রতিটি জেলা ও বিভাগ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা আছে।

এ ব্যাপারে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী রওশন আখতার গণমাধ্যমকে বলেন, নারীর ক্ষমতায়ন, নারীর চলাফেরায় নিরাপত্তা ও বিশেষ করে আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে নারীদের চালক হিসেবে গড়ে তোলা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ লক্ষ্যে কাজ করছে মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় নারীদের ড্রাইভিং শেখাচ্ছে। গতানুগতিক ধারা থেকে বেরিয়ে নতুন আইডিয়া-প্রকল্পে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ১ হাজার ৯ নারীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা)-এর চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, নারী চালকের সংখ্যা বাড়লে সড়কে দুর্ঘটনা কমবে। নারীর নিরাপত্তার বিষয়টি কিন্তু সবক্ষেত্রেই বিঘ্নিত হচ্ছে, কারণ নৈতিকতার অধঃপতন। এই জায়গায় আমাদের জোরালোভাবে কাজ করতে হবে। নারীদের পরিবহন সেক্টরে বেশি করে আনা গেলে গণপরিবহনে নারীর চলাফেরা সাহসী হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads