• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯
উন্নয়নের অনুপ্রেরণা নারী

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

আন্তর্জাতিক নারী দিবস আজ

উন্নয়নের অনুপ্রেরণা নারী

  • আফজাল বারী
  • প্রকাশিত ০৮ মার্চ ২০২০

মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে, আদিকাল থেকে আজকের যে সভ্যতা তাতে নারী-পুরুষের সমান অবদান রয়েছে। নারী-পুরুষের কর্মপ্রচেষ্টায় সভ্যতা সূচিত হয়েছে। সভ্যতা নির্মাণে কারো অবদানই কম নয়। এ কারণেই কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন—‘কোন কালে একা হয়নি কো জয়ী পুরুষের তরবারী/শক্তি দিয়েছে প্রেরণা দিয়েছে বিজয় লক্ষ্মী নারী’।

আজ বিশ্ব নারী দিবস। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে আন্তর্জাতিকভাবে পালিত হচ্ছে দিবসটি। এ বছর প্রতিপাদ্য ‘আই এম জেনারেশন ইক্যুইলিটি: রিলাইজিং উইমেনস রাইটস’। জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা প্রতিবছরই ভিন্ন ভিন্ন দাবি নিয়ে প্রতিপাদ্য সাজায়, যার মূলকথাটি বিশ্বব্যাপী নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় গণজাগরণ সৃষ্টি করা, নারীর জন্য এ পৃথিবীকে বাসযোগ্য করে গড়ে তোলা। এই প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সংগতি রেখেই বাংলাদেশের প্রতিপাদ্য ‘প্রজন্মের সমতা এবং নারীর অধিকার’। বিশ্বজুড়ে নারী-পুরুষের সমমজুরি, সম্পদে সমান অংশীদারত্ব, গৃহস্থালি কাজের আর্থিক মূল্যায়ন, নারীর প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর সম-অংশগ্রহণ, নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি যৌন হয়রানিসহ সব রকম সহিংসতা দূর করে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষেত্রে নারী-পুরুষ সমতা অর্জনের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোই এবারের প্রতিপাদ্যের মূল কথা।

১৯১০ সালের ৮ মার্চ নিউইয়র্কের সেলাই কারখানার নারীশ্রমিকদের নারী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার প্রতি সম্মান জানাতে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। জাতিসংঘ ১৯৭৫ সাল থেকে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন শুরু করে। তখন থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দিবসটি উদ্যাপন করা হয়।

দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক বাণী দিয়েছেন। এ উপলক্ষে সংবাদপত্রে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করা হয়েছে। দিবসটিকে কেন্দ্র করে নানা ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, আজ রোববার সকাল ১০টায় রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদ্যাপনের মূল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন। ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে উদ্বোধন অনুষ্ঠান, দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে আলোচনা, সাংস্কৃতিক পরিবেশনা, ডকুমেন্টারি প্রদর্শন ও জাতীয় পর্যায়ে ৫ জন শ্রেষ্ঠ জয়িতাকে সম্মাননা প্রদান করা হবে।

নারী দিবস পালনের লক্ষ্যে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শোভাযাত্রা, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশে নারী উন্নয়নে অসামান্য অগ্রগতি, সমতা সৃষ্টি, বৈষম্য হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিবাহ বন্ধে সচেতনতা বৃদ্ধি, নারীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন, স্যুভেনির প্রকাশিত ও প্রদর্শিত হচ্ছে। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক নারী দিবস ২০২০ উপলক্ষে ১৬ থেকে ১৮ মার্চ দেশজুড়ে তিন দিনব্যাপী ‘নারী উন্নয়ন মেলা’ আয়োজন করা হবে।

উন্নয়নের সব শাখায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়লেও সম্প্রতি নারীর প্রতি নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সলিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাবমতে, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। আগের বছর ২০১৮ সালে এই সংখ্যা ছিল ৭৩২ জন। এদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ধর্ষণসহ নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩২৬ এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৩৭ জন নারী ও কন্যাশিশু।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের দেওয়া তথ্যমতে, গত বছরের জানুয়ারি মাসে ৫২ জন নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়। গণধর্ষণের শিকার হয় ২২ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ৫ জনকে। এ ছাড়াও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ৭ জনকে। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসেই ধর্ষণের শিকার হয়েছে মোট ১১৬ জন। এদের মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২০ জন। এ ছাড়াও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ২৪ জন নারী ও শিশুকে। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৩৭ জন নারী ও কন্যা নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ৭৪ কন্যাশিশুসহ ১১৪ জন। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৯ জনকে এবং ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে ১ জন। ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৯ জনকে।

মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেহ উদ্দীন এ প্রসঙ্গে বলেন, নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে বেশ কিছু আইন হয়েছে, কিন্তু নারী নির্যাতন প্রতিরোধে অনেক কঠোর আইন থাকলেও তা বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তবে মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে বলে দাবি এই নারী নেত্রীর।

কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনীতি একটি পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে ওঠার শর্ত পূরণে সক্ষম হয়েছে। ধীরে ধীরে এই অর্থনীতি কৃষির পরিবর্তে সেবা ও শিল্প খাতের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উন্নয়নের লক্ষ্যে শিল্পায়নকে গুরুত্ব দিয়ে ক্রমান্বয়ে জমির বিভাজন ঘটছে; ভূমি ও কৃষির বাণিজ্যিকীকরণ হচ্ছে; ভূমি দখল হয়ে যাচ্ছে। কৃষির এই সঙ্গিন অবস্থায় নারী কৃষির হাল ধরেছেন। নারী কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পরিবারের খাদ্যের জোগান থেকে শুরু করে দেশের খাদ্য সার্বভৌমত্ব সুরক্ষায় অবদান রাখছেন। অথচ নারীই কৃষক হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি আজও। ভূমির মালিকানায় নারীর সীমিত প্রবেশাধিকার থাকলেও বাজারব্যবস্থায় নেই বললেই চলে।

বাংলাদেশে ১৫ বছরের বেশি বয়সী ১০ কোটি ৯১ লাখ মানুষের মধ্যে নারীর সংখ্যা সাড়ে ৫ কোটি। কর্মক্ষম জনশক্তির অর্ধেকের বেশি নারী হলেও কর্মবাজারে আছেন মাত্র ২ কোটি। এ হিসাবে নারী জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৪ শতাংশ সরাসরি কর্মবাজারে আছেন। বাইরে থাকা সাড়ে ৩ কোটি নারী কাজে যোগ দিলে দেশের মোট দেশজ আয়ে (জিডিপি) বড় ধরনের প্রবৃদ্ধি ঘটবে বলে মন্তব্য করেন বিশেষজ্ঞরা। তবে উপযুক্ত পরিবেশের অভাব ও পারিবারিক কাজের চাপে তাদের বড় অংশ শ্রমবাজারের বাইরেই থেকে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর শ্রমশক্তি জরিপ বলছে, গৃহস্থালির কাজ নারীর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যোগ দেওয়ার পথে বড় বাধা। কর্মবাজারে যোগ না দেওয়া নারীর ৮১ দশমিক ১০ শতাংশই এর জন্য ঘরের কাজের চাপকে দায়ী করেছে। উপযুক্ত কাজ পেলে শ্রমবাজারে যোগ দিতে ইচ্ছুক এমন নারীর সংখ্যাও পুরুষের প্রায় দ্বিগুণ। শ্রমশক্তি জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, কাজ পেলে শ্রমবাজারে আরো ১৫ লাখ ৮৭ হাজার নারী অংশ নেবে। আর যোগ দেবেন এমন পুরুষের সংখ্যা ৮ লাখ ৪৬ হাজার।

এদিকে দেশের বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত ১ কোটি ৮৬ লাখ ৪৬ হাজার নারীর মধ্যে টাকার বিনিময়ে কাজ করছেন মাত্র ৫৯ লাখ ৩ হাজার। তাদের মাসিক আয় গড়ে ১২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা। এ হিসাবে তারা বছরে বেতন ও মজুরি বাবদ আয় করেন ৮৬ হাজার ৮০২ কোটি টাকা। তবে বেতন ছাড়াও ঘরে-বাইরে কাজ করেন অনেক নারী। এই হোম মেকারদের কাজের স্বীকৃতি নেই।

গণপরিবহনে যাতায়াত করাটা নারীদের জন্য যে আর নিরাপদ নয়, এটা এখন চরম বাস্তবতা। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সংগঠনের পরিসংখ্যানেও বিষয়টি স্পষ্ট।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্যমতে, ২০১৯ সালে ৫৯ জন নারী গণপরিবহনে ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এসব ঘটনার মধ্যে ১৬টি ধর্ষণ, ১২টি গণধর্ষণ, ৯টি ধর্ষণের চেষ্টা ও ১৫টি যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেছে।

সংগঠনটির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী বাংলাদেশের খবরকে বলেন, প্রকৃতপক্ষে নারী নির্যাতনের ঘটনা আরো অনেক বেশি। বেশির ভাগ নারীই লজ্জা ও সামাজিক মর্যাদাহানির কারণে অভিযোগ করেন না। আবার অভিযোগ করার পর হয়রানি ও বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণেও অনেক ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যায়। গণপরিবহনে নারী নির্যাতন বন্ধে সিসি ক্যামেরা স্থাপন ও ট্রাফিক সিস্টেম ডিজিটাল করার দাবি জানান তিনি। একই সঙ্গে বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে এবং মনিটরিং জোরদার করতে হবে। তিনি জানান, ২০১৭ সালে গণপরিবহনে চাঞ্চল্যকর রূপা গণধর্ষণ ও হত্যার ঘটনার পর দেশব্যাপী আন্দোলন ও ১৪ দিনের মধ্যেই বিচারের রায় ঘোষণা হয়। এরপর গণপরিবহনে নারী নির্যাতনের ঘটনা কিছুটা কমে। দুই বছরে এ ধরনের ঘটনা ঘটে ২০টি। তবে বিচারহীনতার কারণে ২০১৯ সালে তা দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads