• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

দেশি প্রতিষেধক ঠেকাবে সাপের ছোবলে মৃত্যু

ভেনম রিসার্চ সেন্টারে পোষা হচ্ছে ৬০ সাপ

  • রায়হান উল্লাহ
  • প্রকাশিত ১২ নভেম্বর ২০২০

সাপের ছোবলে মানুষের মৃত্যু ঠেকাতে দেশেই বিষের প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। দুই বছরের মধ্যে এ উদ্যোগ সফল হবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০১৮ সালের মার্চ মাসে বিশ্ব স্থাস্থ্য সংস্থা ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা অনুযায়ী প্রতিষেধক (অ্যান্টিভেনম) তৈরির কাজ শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় ৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ বছর মেয়াদি এই প্রকল্প বাস্তবায়নে দেশে প্রথমবারের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের একটি ভবনে বিভিন্ন বিষাক্ত সাপ লালন করা হচ্ছে।

এতে জড়িত আছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগ, মেডিসিন টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ফর অ্যাডভান্স মেন্টর ট্রপিকেল মেডিসিন এবং জার্মানির গ্যাটে ইউনিভার্সিটি। প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গড়ে তোলা হয়েছে ভেনম রিসার্চ সেন্টার।

প্রাথমিকভাবে ৫টি বিষাক্ত সাপ দিয়ে এই ভেনম রিসার্চ সেন্টার শুরু হলেও সোয়া এক বছরে ছোটবড় মিলিয়ে এই গবেষণাগারে সাপের সংখ্যা ঠেকেছে ৬০টিতে। পদ্ম গোখরো, খৈয়া গোখরো, কাল কেউটে, শঙ্খিনী, দুই প্রজাতির সবুজ বোরা মিলিয়ে পরিণত সাপ আছে ১৪টি।

চমেক হাসপাতালে ডেন্টাল বিভাগের সাথে লাগোয়া ভবনের নিচতলায় বিশেষ ব্যবস্থায় তৈরি ঘরে এসব সাপ নিরাপদে বড় হচ্ছে। রিসার্চ সেন্টারে চিকিৎসকদের পাশাপাশি কাজ করছেন চবি প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। গবেষণার পাশাপাশি শিক্ষার্থীরাও এখানে পালিত সাপগুলোর তত্ত্বাবধান করে থাকেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী এসব সাপের দেখভাল করা হয় বিশেষ ব্যবস্থায়। সাপদের খাওয়ানোর জন্য খাবারও এ প্রকল্পের আওতায় উৎপাদন করা হচ্ছে। আলাদা কক্ষে ইঁদুর জাতীয় প্রাণীর পালন করা হচ্ছে।

এদিকে দেশে রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহূত প্রতিষেধক ভারত থেকে আমদানি করা হয়। তবে এগুলো অনেক ক্ষেত্রে শতভাগ কার্যকর নয়।

অন্যদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৮ সালের প্রতিবেদন বলছে, বাংলাদেশে প্রতি বছর সাত লাখের মতো মানুষ সাপের কামড়ের শিকার হন; যার মধ্যে মারা যান ছয় হাজার।

জানা যায়, বাংলাদেশে সামুদ্রিকসহ প্রায় ১০০ প্রজাতির সাপ রয়েছে যার মধ্যে প্রায় ১০ প্রজাতির সাপ মানুষের জন্য বিপজ্জনক। গবেষকদের মতে, বাংলাদেশের মতো ছোট একটি দেশে এত পরিমাণ সাপের উপস্থিতি পৃথিবীতে বিরল। সরকারি হিসাবমতে, বছরে প্রায় ১ লাখ মানুষ সাপের কামড়ে আহত হন এবং প্রায় ৬ হাজার মানুষ মারা যান। ক্রমশ এ সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

ভিন্ন প্রেক্ষিতে ভেনম রিসার্চ সেন্টারে গবেষণা সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, বিভিন্ন প্রজাতির সাপ থেকে সংগ্রহ করা বিষ থেকে তৈরি অ্যান্টিভেনমের মান যাচাইয়ের জন্য এ বছরেই দেশের বাইরের ল্যাবে পাঠানো হবে। তিনি বলেন, ‘পাঁচটি প্যাকেজে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। প্রথম প্যাকেজে চট্টগ্রাম, খুলনা, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জায়গায় থেকে সাপ সংগ্রহ ও সেগুলো লালন-পালন এবং পরিচর্যা অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয় প্যাকেজে বিষ সংগ্রহ এবং সেগুলো বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ভাগের বিষয়টি রয়েছে। তৃতীয় প্যাকেজে বিষগুলো দিয়ে একটি মডেল তৈরি এবং অ্যান্টিভেনমগুলো ক্যাটাগরি অনুযায়ী এই মডেলে অন্তর্ভুক্ত করার কথা। এই তৃতীয় প্যাকেজ পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। এরপর চতুর্থ প্যাকেজে অ্যান্টিভেনমগুলো পরীক্ষামূলকভাবে সাপে কাটা রোগীর দেহে প্রয়োগ করা হবে। এর আগে বিভিন্ন প্রাণীর শরীরেও প্রয়োগ হবে অ্যান্টিভেনম। সবশেষ পঞ্চম প্যাকেজে বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হবে অ্যান্টিভেনম।’

সেন্টারের এক সহযোগী গবেষক বলেন, সাপের বিষের প্রতিষেধক তৈরি করতে পারলে প্রতি বছর প্রায় ১০ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। বাংলাদেশে এখন শুধু একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠান অ্যান্টিভেনম বিপণন করে। তাদের এক ভায়ালের দাম প্রায় এক হাজার টাকা।

প্রকল্পের প্রধান গবেষক ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অনিরুদ্ধ ঘোষ জানান, ২০২২ সালের মধ্যে কার্যকর অ্যান্টিভেনম বাজারে আনার ব্যাপারে তারা আশাবাদী। এরই মধ্যে তিনটি ধাপ শেষ হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিষেধকটি এখন কেবল মানবদেহে প্রয়োগের ধাপটি বাকি। ডা. অনিরুদ্ধ ঘোষ বলেন, ‘সাপে কাটলে একজন মানুষের শরীরে তিন ধরনের প্রভাব পড়ে। সেগুলো হচ্ছে হেমোটক্সিন বা রক্ত দূষণ, মায়োটক্সিন বা মাংসপেশি অকার্যকর এবং নিউরোটক্সিন বা মস্তিষ্ক অকার্যকর। বাংলাদেশে বেশিরভাগ মানুষ সাপে কাটার পর ওঝার কাছে যান। যথাযথ প্রতিষেধকের পরিবর্তে ওঝা ঝাড়ফুঁকের আশ্রয় নেওয়ায় তৈরি হয় মৃত্যুঝুঁকি।’

তিনি জানান, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা অনেক আগে থেকেই আছে। ১৯৯৩-৯৪ সাল থেকে ভারতে অ্যান্টিভেনম তৈরি শুরু হয়। এদেশে সাপে কাটা রোগীর অ্যান্টিভেনম ব্যবহার হয় ভারতের তৈরিগুলো।

তবে অঞ্চলভেদে সাপের বিষে অনেক তফাত থাকে উল্লেখ করে এই গবেষণাগার প্রধান বলেন,  ভারত ও বাংলাদেশের সাপে কাটা রোগীর অ্যান্টিভেনমও আলাদা হয়। এজন্য হু-এর নির্দেশনা অনুযায়ী বিশ্বের সব দেশকে নিজেদের সাপের অ্যান্টিভেনম তৈরি করতে হবে।

ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, লালন-পালন করা সাপের শরীর থেকে ভেনম সংগ্রহের পর পরীক্ষামূলক ডোজ তৈরি করে  ডব্লিউএইচওর নিয়ন্ত্রিত মান পর্যায়ে রেখে তা অন্য কোনো প্রাণী বিশেষ করে উট, ঘোড়া, ভেড়া বা ছাগল জাতীয় প্রাণীর শরীরে প্রবেশ করিয়ে অ্যান্টিবডি তৈরি হবে।

পরবর্তীতে বিশেষ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অ্যান্টিবডি থেকে অ্যান্টিভেনম তৈরি হবে যা ‘বিষ দিয়ে বিষক্ষয়ের’ মতোই কাজ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে দেশে উৎপাদিত অ্যান্টিভেনম পরীক্ষামূলকভাবে মানব শরীরে দেওয়ার মতো পর্যায়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করে ডা. অনিরুদ্ধ বলেন, এটি সফল হলে পরবর্তীতে তা বাণিজ্যিক পর্যায়ে উৎপাদনে যাওয়া যাবে।

বাংলাদেশে সকল বিষধর সাপে কাটা রোগীর জন্য নিরাপদ ও কার্যকরী প্রতিষেধক তৈরি হবে দাবি করে তিনি বলেন, সাপে কাটার মতো অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুহার আরো অনেক কমে আসবে।

দেশে অ্যান্টিভেনম রিসার্চ কোন পর্যায়ে আছে প্রশ্নে ভেনম রিসার্চ সেন্টারের গবেষণা সহকারী মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ বছর প্রকল্পের কাজ প্রায় ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। সব ঠিক থাকলে আগামী ২০২২ সালের মধ্যে উৎপাদন শুরু হবে। এরপর ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রতিষেধক বাজারে ছাড়া হবে।’ তিনি বলেন, বিষ সংগ্রহের জন্য বাছাই করা বিভিন্ন জাতের সাপ ছিদ্রওয়ালা প্লাস্টিকের বাক্সে রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া সাপদের বিচরণের জন্য কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশও তৈরি করা হয়েছে। এগুলোর খাবার হিসেবে ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী দেওয়া হচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস (ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম) শাখার পরিচালক ডা. হাবিবুর রহমান বলেন, বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ১০ হাজার ভায়াল অ্যান্টিভেনমের চাহিদা রয়েছে। চাহিদার ভিত্তিতে প্রত্যেক বিভাগীয় হাসপাতালে বছরে ৫০০ ভায়াল, প্রত্যেক মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ১০০ ভায়াল এবং প্রত্যেক সদর হাসপাতালে ৫০ ভায়াল অ্যান্টিভেনম সরবরাহ করা হয়। তিনি বলেন, দেশে অ্যান্টিভেনম তৈরির গবেষণা সফল হলে বাইরে থেকে এই প্রতিষেধক আর আনতে হবে না। দেশেই অনেক সাশ্রয়ী দামে পাওয়া যাবে সাপের বিষের প্রতিষেধক।

প্রকল্পের কো-ইনভেস্টিগেটর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী বলেন, প্যারাফিনের লেয়ার দিয়ে সাপের কামড়ের অনুভূতি তৈরির মাধ্যমে আমরা বিষ বা ভেনম সংগ্রহ করেছি। এ ছাড়া বিষদাঁতের সাথে লাগিয়ে গ্লাস ক্যাপিলারি পদ্ধতিতে বিষ সংগ্রহ করা হয়েছে।

তিনি বলেন, সাপে কাটা রোগীর চিকিৎসা তুলনামূলক ব্যয়বহুল। প্রতি বছর সরকারকে এ খাতে ভর্তুকি দিতে হয়। আমদানি নির্ভরতা কমানো এবং প্রতিষেধক যেন শতভাগ কার্যকর হয়, সে লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি।

চমেকের মেডিসিন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. আবদুল্লাহ আবু সাঈদ বলেন,  ‘সেন্টারের সাপগুলোকে ছিদ্রওয়ালা প্লাস্টিকের বক্সে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সাপদের বিচরণের জন্য কৃত্রিমভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশও তৈরি করা আছে। প্রটোকল মেনে সাপদের ইঁদুরসহ বিভিন্ন প্রাণী খাবার হিসেবে দেওয়া হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সাপগুলোকে ধরে ধরে খাওয়ানো হয়। প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষার্থীরা এ কাজটি করছে বলে জানান তিনি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads