• মঙ্গলবার, ১৪ মে ২০২৪, ৩১ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

করোনা আক্রান্তদের বড় অংশ ডায়াবেটিক রোগী

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৫ নভেম্বর ২০২০

দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১১ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। এ রোগে আক্রান্ত মানুষের হার দিন দিন বাড়ছে। দেশে মৃত্যুর প্রথম পাঁচটি কারণের একটি ডায়াবেটিস। গতকাল শনিবার ছিল বিশ্ব ডায়াবেটিক দিবস। এবার ডায়াবেটিক দিবসের সঙ্গে বিশেষ গুরুত্ব বহন করছে করোনা সংক্রমণের বিষয়টি। চিকিৎসকরা বলছেন, যে কয়েকটি অসুখে আগে থেকে আক্রান্ত থাকার করোনার ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায় তার মধ্যে ডায়াবেটিস অন্যতম। আন্তর্জাতিক জরিপ বলছে, করোনা আক্রান্ত মানুষের ডায়াবেটিস থাকলে তার মৃত্যুঝুঁকি সাত দশমিক তিন শতাংশ বেশি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাপক বিস্তার ঘটা এ রোগ প্রতিরোধে দরকার জাতীয় নীতি প্রণয়ন।

গত ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা আক্রান্ত তিন জন রোগীর কথা জানায় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)। তার ঠিক ১০ দিন পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যু হয়।  সেদিন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেছিলেন, ৭০ বছর বয়সি রোগী ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ, কিডনি সমস্যা ও হূদরোগে ভুগছিলেন। এ ছাড়া নিপসমের এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনা আক্রান্ত রোগীরা আগে থেকে যেসব জটিল রোগে ভুগছেন তার মধ্যে  প্রথম হচ্ছে ডায়াবেটিস। এরপর রয়েছে উচ্চরক্তচাপ, ফুসফুসের সংক্রমণ, কিডনি রোগসহ অন্যান্য রোগ।

শুরু থেকেই ষাটোর্ধ্ব ও অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্তরা করোনার মৃত্যুঝুঁকিতেও বেশি বলে জানিয়ে এসেছেন চিকিৎসকরা। অন্যান্য জটিল রোগের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ডায়াবেটিস। ৫৭ বছরের আয়েশা খানম করোনাতে আক্রান্ত হওয়ার পর কোভিড ডেডিকেটেড এক হাসপাতালে ভর্তি হন। কিন্তু ডায়াবেটিস থাকার কারণে তিনি খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া স্যাচুরেশন নেমে যায় ৭০-এর কাছাকাছি।

করোনা আক্রান্ত মানুষের ডায়াবেটিস থাকলে হলে তার মৃত্যুঝুঁকি সাত দশমিক তিন শতাংশ বেশি বলে আন্তর্জাতিক জরিপগুলো দাবি করেছে। তবে আমাদের দেশে এখনো আক্রান্তদের কত শতাংশের ডায়াবেটিস আছে, তাদের কত শতাংশ মারা গেছেন তার তথ্য-উপাত্ত এখনো পুরোপুরি পাওয়া যায়নি। তারপরও করোনায় আক্রান্তদের মধ্যে যারা হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের একটা বড় অংশই ডায়াবেটিক রোগী, বলছেন চিকিৎসকরা।

আন্তর্জাতিক কয়েকটি জরিপের কথা উল্লেখ করে গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজের অ্যান্ডোক্রাইনলোজি অ্যান্ড মেটাবোলিজম বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. তানজিনা হোসেন বলেন, করোনা হয়েছে এমন রোগীদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য রোগের মধ্যে হূদরোগ এক নম্বর, দুই নম্বরে কিডনি রোগ আর তিন নম্বরেই রয়েছে ডায়াবেটিস। আমার হাসপাতালে যত রোগী ভর্তি হন, তাদের মধ্যে শতকরা ৬০ শতাংশই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীরা করোনায় আক্রান্ত হলে তাদের অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়ে যায়। যারা হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন তাদের প্রায় সবারই অক্সিজেন লাগছে, তারাই আইসিইউতে যাচ্ছেন। আবার ডায়াবেটিসের কারণেই হূদরোগ, কিডনি রোগ, উচ্চরক্তচাপের মতো অসুখে আক্রান্ত হন, সব মিলিয়ে করোনা আক্রান্ত হলে এসব রোগীই সবচেয়ে ঝুঁকিতে পড়েন।

যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রেখে জীবনযাপন করছেন, তারাও করোনা আক্রান্তের কারণে ঝুঁকিতে পড়ছেন। ডায়াবেটিস রোগীদের করোনা হলে তাদের অবস্থা টালমাটাল অবস্থায় থাকে। তিনি বলেন, এই রোগীদের স্টেরয়েড দেওয়ার কারণে সুগার বেড়ে যায়। সব মিলিয়ে তাদের খুব ফ্ল্যাকচুয়েট করে, অনেক বেড়ে যায়। যাদের আগে নিয়ন্ত্রিত ছিল তাদের ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যায়। কারো কারো আবার সুগার কমে যায়, বিভিন্ন ধরনের সমস্যার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় তাদের। আর সে সময় ডায়াবেটিসের যদি ঠিকমতো ম্যানেজমেন্ট না করা যায়, তাহলে মৃত্যুঝুঁকি আরো বেড়ে যায়। এছাড়া করোনায় আক্রান্ত হওয়া ডায়াবেটিক রোগীদের ম্যানেজ করা খুব টাফ। স্বাদ-রুচি না থাকার কারণে তারা ঠিকমতো খেতে পারেন না, সে কারণে সুগার কমে যায়। আবার স্টেরয়েডের কারণে সুগার বেড়ে যায়, ইনফেকশন নিজেই আবার সুগার বাড়ায়, যার কারণে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের ম্যানেজ করতে খুব বেগ পেতে হয় আমাদের।

যারা ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তাদের প্রতি বিশেষভাবে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, তারা বাইরে বের না হওয়াই ভালো। কিন্তু যদি বিশেষ প্রয়োজনে বের হতেই হয় মাস্ক পরা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, জনসমাগমে না যাওয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি অবশ্যই মেনে চলতে হবে। পরিবারে যিনি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত, তাদের অন্যদের তুলনায় বিশেষভাবে দেখভাল করতে হবে। ডায়াবেটিক রোগীদের জন্য সচেতনতা অনেক বেশি দরকার।

দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো- ডায়াবেটিসের ওপর নজর রাখুন। এর অর্থ হলো, লক্ষণ নেই এমন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের রক্ত পরীক্ষা করে ডায়াবেটিসের পরিস্থিতি জানা, পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আগেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে চিকিৎসার আওতায় আনা এবং এ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করা। প্রতিরোধ ছাড়া কোনো পথ নেই, এমন মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ ডায়াবেটিস সমিতির সভাপতি অধ্যাপক এ কে আজাদ খান। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে একত্র হয়ে এ বিষয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে। মানুষ সচেতন হলে আক্রান্তের হার কমবে। এটাই পথ। এ জন্য ডায়াবেটিস প্রতিরোধ জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে।

ব্রিটেনভিত্তিক জনস্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সাময়িকী ল্যানসেট-এ প্রকাশিত এক গবেষণায় দেশে ডায়াবেটিক রোগীর হার বৃদ্ধির প্রমাণ পাওয়া যায়। গত ৯ এপ্রিল ল্যানসেটে প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ডওয়াইড ট্রেন্ডস ইন ডায়াবেটিস সিনস ১৯৮০ : আ পুল্ড অ্যানালাইসিস অব ৭৫১ পপুলেশন বেসড স্টাডিজ উইথ ৪.৪ মিলিয়ন পার্টিসিপেন্টস’ শীর্ষক ওই গবেষণায় দেখা গেছে, ১৯৮০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের হার বেড়েছে। এই হার নারীর চেয়ে পুরুষের মধ্যে বেশি।

ল্যানসেট বলছে, ১৯৮০ সালে দেশের ৩ দশমিক ৮ শতাংশ পুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। ২০০০ সালে আক্রান্ত পুরুষের হার বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। আর ২০১৪ সালে এ হার বেড়ে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ৩ শতাংশে। নারীর ক্ষেত্রে চিত্রটি কিছুটা ভিন্ন। ১৯৮০ সালে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত নারী ও পুরুষের হার সমান, অর্থাৎ ৩ দশমিক ৮ শতাংশ ছিল। ২০০০ সালে নারীর আক্রান্তের হার বেড়ে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ হয়। আর ২০১৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৯ দশমিক ৩ শতাংশ। অর্থাৎ পুরুষের চেয়ে ১ শতাংশ কম। এ সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগের চিকিৎসক শাহজাদা সেলিম বলেন, বিষয়টি এমন নয় যে মানুষ বাড়ছে বলেই ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ঘটনা হচ্ছে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের হার দ্রুত বাড়ছে।

অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে মৃত্যুর চতুর্থ প্রধান কারণ ডায়াবেটিস। গত বছর বাংলাদেশে ডায়াবেটিসে ৫ দশমিক ৪ শতাংশ বা ৪৪ হাজার ৩৩৪ জনের মৃত্যু হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে অবস্থিত ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিকস অ্যান্ড  ইভালুয়েশন, বিশ্বব্যাংক ও ল্যানসেটের যৌথ বিশ্লেষণে মৃত্যুর পাঁচটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়। অন্য প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ (সেরিব্রোভাসকুলার ডিজিজ), হূৎপিণ্ডের রক্তনালির রোগ (স্কিমিক হার্ট ডিজিজ), দীর্ঘস্থায়ী শ্বাসতন্ত্রের রোগ (সিওপিডি) ও শ্বাসতন্ত্রের নিচের অংশের সংক্রমণ (লোয়ার রেসপিরেটরি ইনফেকশন)।

বাংলাদেশে ডায়াবেটিসের জাতীয় পর্যায়ের তথ্য পাওয়া যায় ২০১১ সালের বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে। এতে বলা হয়েছিল, দেশের প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১১ শতাংশ নারী-পুরুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। আক্রান্ত ব্যক্তিদের হার শহরে বেশি। এ ছাড়া ২৫ শতাংশ নারী ও পুরুষ প্রাক-ডায়াবেটিস পর্যায়ে আছে। অর্থাৎ তাদের রক্তে শর্করা নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডায়াবেটিস হচ্ছে জীবনধারাজনিত (লাইফস্টাইল) রোগ। কায়িক শ্রম কমে যাওয়া, কম হাঁটা, অধিক তেলযুক্ত খাবার ও ফাস্টফুড খাওয়া, খেলাধুলা না করা, স্থূল হওয়া, মানসিক চাপ- এসব কারণে ডায়াবেটিসের প্রকোপ বাড়ছে। রক্ষণশীল হিসেবে বাংলাদেশে ৮০ লাখের বেশি মানুষ ডায়াবেটিসে ভুগছে। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিক ফেডারেশন বলছে, মানসম্পন্ন সেবার জন্য একজন রোগীর পেছনে বছরে কমপক্ষে ২৮ ডলার খরচ করা দরকার। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের এ বিরাটসংখ্যক মানুষকে মানসম্পন্ন সেবা দিতে হলে স্বাস্থ্য বাজেটের বড় অংশ শুধু ডায়াবেটিস খাতে রাখতে হবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads