• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বিজয় স্মারক সশস্ত্র বাহিনী দিবস

  • প্রকাশিত ২১ নভেম্বর ২০২০

কর্নেল (অব.) মুহাম্মদ ফারুক খান   

 

 

মহান মুক্তিযুদ্ধের অগ্রযাত্রা ও বিজয়ের স্মারক হিসেবে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর ‘সশস্ত্র বাহিনী দিবস’ পালন করা হয়। এ বছর ৫০তম সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালন করা হবে। ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত ‘বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী’ সম্মিলিতভাবে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক (Conventional) আক্রমণের সূচনা করে।

সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে জাতির পিতা, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা, বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক (Commander-in-Chief) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। গভীর শ্রদ্ধা জানাই মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী বীর শহীদদের প্রতি। বিশেষ করে দেশের জন্য শাহাদতবরণকারী সশস্ত্র বাহিনীর বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। সশ্রদ্ধ চিত্তে স্মরণ করি সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মদানকারী বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর (সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং কোর), বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি হামিদুর রহমান (১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট), বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহি মোস্তফা কামাল (৪ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট), বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ইঞ্জিন রুম আর্টিফিশার মোহাম্মদ রুহুল আমিন (নৌবাহিনী), বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মতিউর রহমান (বিমানবাহিনী), বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ শেখ (ইপিআর, বর্তমানে বিজিবি) ও বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ ল্যান্স নায়েক মুন্সি আবদুর রউফকে (ইপিআর, বর্তমানে বিজিবি)। সশ্রদ্ধ সালাম জানাই সব বীর মুক্তিযোদ্ধাকে এবং আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সব বীর সদস্যকে।

স্বাধীনতা আমাদের সর্বকালের শ্রেষ্ঠ অর্জন। বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই মহান স্বাধীনতার স্থপতি। দীর্ঘ ২৩ বছর (১৯৪৮-১৯৭১) ধরে বাঙালি জাতিকে স্বাধিকার আদায়ে উদ্বুদ্ধ এবং প্রস্তুত করে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের বিজয়কে ত্বরান্বিত করতে ১৯৭১ সালের এ দিনে অর্থাৎ ২১ নভেম্বর আমাদের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা সম্মিলিতভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করে। এর ফলে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে তাই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম।

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ডাক দেন। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ঐতিহাসিক এ ভাষণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে শৃঙ্খলমুক্তির আহ্বান জানিয়ে ঘোষণা করেন, ‘রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ।’ তিনি নির্দেশ দেন, ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো, যার যা কিছু আছে তা-ই নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে।’ বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা বাংলাদেশ। মুজিবের নেতৃত্বে বাঙালি জাতির এ জাগরণে ভীত ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করে শুরু করে অত্যাচার, নির্যাতন, খুন।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে অর্থাৎ ১২টা ২০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইপিআরের ওয়্যারলেস এবং টেলিগ্রামের মাধ্যমে সে বার্তা ‘This may be my last message. From to-day Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last, your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.’ (সম্ভবত এটাই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। আমি বাংলাদেশের জনসাধারণকে আহ্বান জানাচ্ছি, তোমরা যে যেখানেই আছ এবং যাই তোমাদের হাতে আছে, তার দ্বারাই শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত দখলদার সৈন্য বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে। পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর শেষ সৈনিকটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে বিতাড়িত করে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে)। ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা অনেকেই শুনেছেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা শুনেছিলেন তৎকালীন ঢাকায় অবস্থিত পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৪ পদাতিক ডিভিশনে কর্মরত আইএসপিআরের (ISPR) পরিচালক ব্রিগেডিয়ার সিদ্দিক সালেক। তিনি তার ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’ বইয়ের ৭৫ পৃষ্ঠায় লিখেছেন— ‘When the first shot had been fired, the voice of Sheikh Mujibur Rahman came faintly through on a wavelength close to that of the official Pakistan Radio. In what must have been, sounded like a pre-recorded message, the Sheikh proclaimed East Pakistan to be the People's Republic of Bangladesh.’ (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র-৩য় খণ্ড)। বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা জাতির কাছে পৌঁছে যায়। সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্য, আধা-সামরিক বাহিনী তথা ইপিআর, পুলিশ এবং আনসারসহ আপামর জনগণ যে যেখানে পেরেছে, সেখান থেকেই বিদ্রোহ করে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। শুরু হয় বীরত্বপূর্ণ মুক্তিযুদ্ধ।

১৭ এপ্রিল ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এমপিকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এমপিকে উপরাষ্ট্রপতি এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ এমপিকে প্রধানমন্ত্রী করে মেহেরপুরের মুজিবনগরে ‘বাংলাদেশের প্রথম সরকার’ গঠিত হয়। সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত বাঙালি সদস্য, ইপিআর, পুলিশ, আনসারসহ ছাত্র, শ্রমিক, জনতা তথা বীর বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। সর্বাধিক কার্যকর এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সামরিক নেতৃত্বের প্রয়োজন বোধ করে সরকার এবং এ লক্ষ্যে কার্যকর অবকাঠামো গঠনের নিমিত্তে কর্নেল এমএজি ওসমানীকে (পরে জেনারেল) কেবিনেট মিনিস্টার মর্যাদাসহ বাংলাদেশ ফোর্সেসের প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। এ ছাড়াও কর্নেল (অব.) এমএ রবকে বাংলাদেশ ফোর্সেসের চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ হিসেবে নিযুক্তি দেয়া হয়। কর্নেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর সব বিচ্ছিন্ন সংগঠনকে কেন্দ্রীয় কমান্ডের আওতায় নিয়ে আসেন এবং ফোর্সেস সদর দপ্তর থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কার্যকরভাবে পরিচালনা করতে অপারেশনাল নির্দেশনা প্রণয়ন করেন। এ বিরাট বাহিনীকে সাহায্য, সহযোগিতা, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ, জনবল সংগ্রহ এবং সাধারণ জনগণকে দেখাশোনা করার জন্য ১৯৭০-এর নির্বাচনে নির্বাচিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে সাব-সেক্টর/ক্যাম্প পরিচালিত হয়, যা মুক্তিযুদ্ধে এক বিরাট সহযোগিতা হিসেবে বিবেচিত হয়।

রণনীতির কৌশল হিসেবে ভৌগোলিক অবস্থা বিবেচনা করে প্রথমেই সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। প্রতিটি সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর এক-একজন জ্যেষ্ঠ অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিভিন্ন সেক্টর ও বাহিনীর মধ্যে সমন্বয় সাধন করা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, অস্ত্রের জোগান নিশ্চিত করা, গেরিলা বাহিনীর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা ইত্যাদি কাজ কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে করতে থাকে। গেরিলা যুদ্ধের জন্য নিয়োজিত অংশকে বলা হতো গণবাহিনী, যা সাধারণ জনগণ থেকে বাছাইকৃত লোকবল নিয়ে গঠিত হয়েছিল। নিয়মিত যুদ্ধের জন্য সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী, ইপিআর, পুলিশ, আনসার ইত্যাদি বাহিনীর লোকবল নিয়ে একটি নিয়মিত বাহিনী এবং তিনটি ব্রিগেডও গঠন করা হয়েছিল। (১) জেড ফোর্স (২) এস ফোর্স (৩) কে ফোর্স। ‘জেড ফোর্সের’ অধিনায়ক নিয়োগ দেয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে, যা ১ম, ৩য় এবং ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয়। ‘এস ফোর্সের’ অধিনায়ক নিয়োগ দেয়া হয় মেজর কেএম সফিউল্লাহকে, যা ২য় এবং ১১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত হয়েছিল। মেজর খালেদ মোশাররফকে ‘কে ফোর্সের’ অধিনায়ক নিয়োগ দেয়া হয়, যা গঠিত হয়েছিল ৪র্থ, ৯ম এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে। বাংলাদেশ ফোর্সেসের অধীনে এই ১১টি সেক্টর এবং তিনটি ব্রিগেডের মাধ্যমে ৪ ডিসেম্বর যৌথ বাহিনী গঠনের পূর্বপর্যন্ত ব্যাপকভাবে সমগ্র বাংলাদেশে কার্যকরভাবে পাকিস্তানি দখলদারদের বিরুদ্ধে অসংখ্য সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল। নৌ কমান্ডোরা চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর অকেজো এবং বিমানবাহিনী বিভিন্ন স্থাপনায় বোমা হামলা করে। আমাদের নৌ ও বিমানবাহিনীও মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও কার্যকর অবদান রাখে।

১৯৭১-এর ২১ নভেম্বর বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং আপামর জনসাধারণ একযোগে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যে সমন্বিত আক্রমণের সূচনা করে, শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের বাহিনী এবং ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ কমান্ডের নেতৃত্বে ৩ ডিসেম্বর চূড়ান্ত অভিযানের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকালে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয়।

বিশ্বের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, অধিকাংশ সময়ই মিত্রবাহিনী (Allied Forces) অধিকৃত অঞ্চল/দেশ থেকে ফেরত আসে না। যেমন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আজো আমেরিকার সশস্ত্র বাহিনী জার্মানি এবং জাপান থেকে ও ব্রিটিশ সশস্ত্র বাহিনী জার্মানি থেকে ফেরত আসেনি বরং কৌশলগত কারণে আজো সে দেশে অবস্থান করছে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সাহসী এবং দূরদর্শী নেতৃত্বে ভারতীয় মিত্রবাহিনী আমাদের মুক্তিযুদ্ধ শেষেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে ১৭ মার্চ ১৯৭২ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে যায়, যা ইতিহাসে বিরল। রাশিয়ান বাহিনী, যারা যুদ্ধবিধ্বস্ত চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর চালু করতে এসেছিল, তারাও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন শেষে ফিরে যায়।

শুধু স্বাধীনতা যুদ্ধে নয়, সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী। শুধু দেশেই নয়, বিদেশের মাটিতে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর কর্মকাণ্ড বিশ্বের সব দেশের শীর্ষস্থানে রয়েছে, যার প্রশংসায় পঞ্চমুখ জাতিসংঘ। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী মিশনে সিয়েরালিয়ন, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, কঙ্গো, হাইতি, লেবানন, সোমালিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি সশস্ত্র বাহিনী শান্তি রক্ষার পাশাপাশি ওইসব দেশের আর্থিক ও সামাজিক উন্নয়নে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং অসহায় মানুষের পুনর্বাসনে সার্বিক সহযোগিতা করে যাচ্ছে। ২৩ জুলাই ২০১৫ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির ব্যবস্থাপনায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন MONUSCO (কঙ্গো) পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। কঙ্গোর রাজধানী কিনসাসাতে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত (SRSG) এবং ফোর্স কমান্ডার লে. জেনারেল কার্লোস আলবার্টো মনিটোসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। তারা উভয়েই বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের কঙ্গো মিশনে অবদান, অর্জন ও কার্যকর ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে তাদের অবদান দেশ-বিদেশে প্রশংসিত হয়েছে এবং বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়েছে।

১৯৭৬ সাল থেকে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে কাউন্টার ইনসারজেন্সি অভিযানে জড়িয়ে পড়ে শান্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে, যারা উপজাতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য লড়ছিল। বিচ্ছিন্ন এ যুদ্ধে অফিসারসহ বিভিন্ন পদবির অনেক সৈনিককে অকালে প্রাণ দিতে হয়েছে; কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম বিচ্ছিন্ন হতে পারেনি। ১৯৯৭ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার ও শান্তিবাহিনীর মধ্যে শান্তিচুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পর থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম অপেক্ষাকৃত শান্ত। পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ নাগরিকদের স্বাভাবিক জীবনযাপন অব্যাহত রাখতে সেনাসদস্যদের প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে।

জাতীয় উন্নয়নে সশস্ত্র বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল অবদান আজ সর্বজনস্বীকৃত। সশস্ত্র বাহিনী এমন এক বাহিনী, যার প্রতি দেশের জনগণের রয়েছে অগাধ আস্থা, বিশ্বাস ও ভালোবাসা। বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কল্যাণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতা ছাড়াও দেশের অবকাঠামো এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ছিন্নমূল মানুষের জন্য বাসস্থান তৈরিসহ অন্যান্য জনকল্যাণমুখী কাজে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী নিবেদিতপ্রাণ। ছবিসহ ভোটার তালিকা, জাতীয় পরিচয়পত্র, মেশিন রিডেবল পাসপোর্টসহ জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণ, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস নির্মাণে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ভূমিকা অত্যন্ত গৌরবজনক।

দুঃখজনক হলেও সত্য, অতীতে আমাদের প্রিয় সশস্ত্র বাহিনীর কিছু সদস্য ভুলক্রমে অভ্যুত্থান, পাল্টা অভ্যুত্থান অর্থাৎ হত্যা, ক্যু এবং ষড়যন্ত্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নিজেদের এবং সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষতিসাধন করেছে। সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে দেখা যাবে, এসব রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ডের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দেশ এবং সশস্ত্র বাহিনীর ওইসব সদস্য, যারা এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন অথবা জড়িত বলে সন্দেহ করা হয়। অর্থাৎ প্রকারান্তরে সার্বিকভাবে দেশ ও সশস্ত্র বাহিনীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা জানি, একজন সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যকে প্রশিক্ষণসহ পেশাগতভাবে উপযুক্ত করতে দেশের অনেক সম্পদের প্রয়োজন হয়। দেশের কেউ চায় না, দেশ ও জাতির এ সম্পদ অকালে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিনষ্ট হোক।

পরিশেষে আমরা আশা করব, গণতান্ত্রিক ও নিয়মতান্ত্রিক নেতৃত্বের প্রতি অনুগত ও শ্রদ্ধাশীল থেকে পেশাগত দক্ষতা ও দেশপ্রেমের সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের সশস্ত্র বাহিনী তাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে সদা তৎপর থাকবে। জাতির সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলাই হবে তাদের অঙ্গীকার। সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি জাতির প্রয়োজনে সর্বদা অবদান রাখবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।

 

লেখক : সংসদ সদস্য; সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads