• রবিবার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

নতুন বছরে আরো এগিয়ে যাবে আধুনিক পুলিশ

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ০১ জানুয়ারি ২০২১

করোনাকালীন লকডাউনে পুলিশের ভূমিকায় ভূয়সী প্রশংসায় পঞ্চমুখ ছিল সবাই। লকডাউনকালে ফ্রন্টলাইন ফাইটার হিসেবে বিবেচিত ছিল বাংলাদেশ পুলিশ। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের দায়িত্বে অবিচল থেকে আস্থার প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় তারা। সংকটকালীন এ সময়েও আধুনিকায়নে পিছিয়ে থাকেনি পুলিশ সদর দপ্তর। বিশেষ করে পুলিশের প্রধান ড. বেনজীর আহমেদের পুলিশকে উন্নত বিশ্বের কাতারে নিয়ে যাওয়ার যে চেষ্টা সেটাতে সফল হয়েছেন তিনি। ট্যাকটিক্যাল বেল্টের পাশাপাশি বডি অন ক্যামেরায় পুলিশকে অন্তর্ভুক্ত করা পুলিশের জন্য একটি বড় অধ্যায়। এছাড়া রাজশাহীতে কিশোর গ্যাংয়ের ডাটাবেজসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সিসি ক্যামেরা স্থাপন একটি বড় মাইলফলক।

কক্সবাজারে মেজর (অব.) সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর নানা সমালোচনাকে কাটিয়ে সেখানকার সকল পুলিশ সদস্যকে বদলি করে নতুন পুলিশ সদস্যদের পোস্টিং সর্বমহলেই প্রশংসিত হয়েছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, করোনা মহামারীর সময় পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পুলিশের অনেকেই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গত ২৭ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডিএমপিসহ দেশের বিভিন্ন ইউনিটে লকডাউনসহ বিভিন্ন সময় নিরাপত্তা দিতে গিয়ে পুলিশের বিভিন্ন পদ মর্যাদার ১৮ হাজার ৮১১ জন সদস্য আক্রান্ত হয়েছেন। এদের মাঝে মৃত্যুবরণ করেছেন ৮২ জন। এখনো চিকিৎসাধীন আছেন ৩১৭ জন।

আক্রান্তদের মধ্যে অতিরিক্ত আইজিপি ৬ জন, ডিআইজি ১০ জন, অতিরিক্ত ডিআইজি ১৯ জন, পুলিশ সুপার ১১২ জন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ১৮৭ জন, সহকারি পুলিশ সুপার ২২৮ জন, ইন্সপেক্টর ৯৫৭ জন, এসআই ৩০০৭, এএসআই ২৮৩৫, নায়েক ৫৫০ জন, কনস্টেবল ৮ হাজার ৮২৩, অন্যান্য ২০৭৭ জন। মোট ১৮,৮১১ জন।

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় লকডাউন, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে নিজেরা আক্রান্ত হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মোট আক্রান্ত ৩১৭৮ জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ৩১১১ জন। মৃত্যুবরণ করেছেন ২৫ জন। এখনো হাসপাতালে চিকিৎসাধীন  ৪২ জন। আক্রান্তদের মধ্যে যুগ্ম কমিশনার ৩ জন, উপ-পুলিশ কমিশনার ১৬ জন, অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ৫০ জন, সহকারি পুলিশ কমিশনার ২৯ জন, ইন্সপেক্টর ১৮০ জন, এসআই ৫৮৮ জন, এএসআই ৫০৫ জন, নায়েক ১০৭ জন, কনস্টেবল ১,৫৫৩ জন ও অন্যান্য ১৪৭ জন। মোট ৩ হাজার ১৭৮ জন।

করোনাকালে পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যরা অনেক মানবিক আচরণ করেছেন। যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে। আক্রান্তদের সহায়তা থেকে শুরু করে হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে সেবা দিয়েছে পুলিশ। অনেক আক্রান্ত পরিবারের ঘরে খাওয়ার পৌঁছে দিয়েছেন। সেই সাথে লকডাউন চলাকালে ঘড়ে থাকার আহ্বান জানানোসহ যাদের ঘরে খাবার ছিল না তাদের নীরবে ঘরে খাবার পৌঁছে দিয়েছে পুলিশ। এছাড়া ডিএমপির পক্ষ থেকে প্রত্যেক থানা এলাকায় রান্না করা খাবার অসহায় মানুষের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। মাস্কসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী বিতরণ ও রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরের রাস্তায় জীবাণুনাশক পানি ছিটিয়েছে পুলিশ। লকডাউনের সময়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় কৃষকের পাকা ধান কেটে ঘরে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে পুলিশ।

এদিকে সংকটকালেও বাহিনীর আধুনিকায়নে অনেকদূর এগিয়েছে পুলিশ। বিশেষ করে কাঁধে রাইফেল নিয়ে চিরাচরিত যে ডিউটি সেখান থেকে বেরিয়ে গেছে। ইতোমধ্যে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সদস্যরা ট্যাকটিক্যাল বেল্ট পরে ডিউটি শুরু করেছে। বিষয়টি পুলিশে ইতিবাচক হিসেবেই নিয়েছে।

রাইফেল, কখনো কাঁধে ঝোলানো কখনো হাতে। বছরের পর বছর ধরে পুলিশের মাঠপর্যায়ের সদস্যদের এভাবে দায়িত্ব পালন করতে দেখে সবাই অভ্যস্ত। তবে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা রাইফেল বয়ে বেড়ানোর অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটতে যাচ্ছে বাংলাদেশ পুলিশে। উন্নত বিশ্বের আদলে বাংলাদেশ পুলিশের সদস্যদের দেওয়া হয়েছে পিস্তল। এ জন্য বাংলাদেশ পুলিশে সংযোজন করা হয়েছে ট্যাকটিক্যাল বেল্ট। ছয় চেম্বারের আধুনিক এই ট্যাকটিক্যাল বেল্টেই থাকবে পিস্তল, হ্যান্ডকাফ, অতিরিক্ত ম্যাগজিন, এক্সপেন্ডেবেল ব্যাটন, পানির পটসহ প্রয়োজনীয় সবকিছু। দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের হাত থাকবে সম্পূর্ণ খালি। এতে বিপদগ্রস্ত মানুষের যে কোনো প্রয়োজনে দ্রুত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে পুলিশ। আবার অপরাধীকে দ্রুত ঘায়েল করতে ট্যাকটিক্যাল বেল্টে থাকা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবেন অনায়াসেই।

পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ট্যাকটিক্যাল বেল্টের মূল স্লোগান হলো ‘হ্যান্ডস ফ্রি পুলিশিং’ মানে হাত খালি রাখা। এতে বড় অস্ত্র বহনের ঝক্কি-ঝামেলা আর থাকবে না। এতে পুলিশের কাজে গতি আসবে, মনোবলও বাড়বে। একই সঙ্গে পুলিশকে দেখতেও আরো আধুনিক ও যুগোপযোগী লাগবে।

গত ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে প্রাথমিকভাবে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) ও চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের (সিএমপি) পুলিশ সদস্যদের মাঝে ১০ হাজার ট্যাকটিক্যাল বেল্ট সরবরাহ করে পুলিশ সদর দপ্তর। পর্যায়ক্রমে পুরো পুলিশ বাহিনীর সব সদস্যকে এই ট্যাকটিক্যাল বেল্ট দেওয়া হবে। পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ পুলিশকে আধুনিকভাবে গড়ে তোলার অংশ হিসেবে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। এরই অংশ হিসেবে তিনি পুলিশে ট্যাকটিক্যাল বেল্টের মতো আধুনিক সরঞ্জাম যুক্ত করতে যাচ্ছেন।

এদিকে ট্যাকটিক্যাল বেল্টের পর পুলিশের অভিযানে এবার যুক্ত হয়েছে লাইভ ক্যামেরা। কোনো গুরুত্বপূর্ণ অভিযানে এই ক্যামেরার মাধ্যমে সরাসরি পুলিশ সদর দপ্তরসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা যুক্ত হয়ে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেবেন। অভিযানের স্বচ্ছতা আনতে এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ, বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা।

ট্যাকটিক্যাল বেল্টের পর লাইভ ক্যামেরা যুক্ত হয়ে অভিযানে যাওয়া পুলিশের আধুনিকায়নে আরো একটি নতুন উদ্যোগ। শুধু অভিযানে নয়, চেকপোস্ট ডিউটিগুলোও লাইভ ক্যামেরার আওতায় আনা হবে। লাইভ ক্যামেরা নিয়ে অভিযানে যাওয়া পুলিশের উদ্যোগটি শুরু হচ্ছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ দিয়ে। পর্যায়ক্রমে সারা দেশেই এটি চালু করা হবে।

এই নতুন ক্যামেরার বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ সদর দপ্তর লজিস্টিক শাখার অতিরিক্ত এসপি ফয়জুল ইসলাম বলেন, বডি অন ক্যামেরা আমদানি করার কথা চলছে। এটা আরো তিন মাসের মতো সময় লাগবে। আশা করছি আগামী মার্চে বডি অন ক্যামেরা কেনা শুরু হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে এটি ডিএমপি দিয়ে শুরু হবে। পরবর্তীতে সারা দেশে এটি চালু করা হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে, পুলিশের যে-কোনো অপারেশন, চেকপোস্ট ও গুরুত্বপূর্ণ ডিউটিতে পুলিশ সদস্যদের পোশাকের সঙ্গে লাইভ ক্যামেরা রাখার প্রস্তুতি চলছে। অপারেশন বা ডিউটিরত অবস্থায় ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যে-কোনো সময়, সেই ক্যামেরার অ্যাক্সেস নিতে পারবে পুলিশ সদর দপ্তর। দিতে পারবে প্রয়োজনীয় নির্দেশনাও।

পুলিশ সদর দপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, সবক’টি ক্যামেরা কন্ট্রোলের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে থাকবে একটি মনিটরিং সেল। সারা দেশে যে-কোনো জায়গায় ডিউটিরত অবস্থায় পুলিশ সদস্য থাকবে অন ক্যামেরায়। পুলিশ সদর দপ্তর ও সংশ্লিষ্ট জেলা মনে করলে, সুনির্দিষ্ট ওই পুলিশ কর্মকর্তা বা ইউনিটের কর্মকাণ্ড দেখতে পারবেন। তা ছাড়া ক্যামেরার সঙ্গে ইয়ারফোন যুক্ত থাকায় প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিতে পারবেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও।

অন্যদিকে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের কিশোর গ্যাংয়ের ওপর নজরদারীর জন্য বিশেষ অ্যাপসহ শহরজুড়ে সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ঢাকা রেঞ্জে বিভিন্ন থানার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে থানার কর্মকান্ড এসপি ও ডিআইজি অফিস মনিটরিং করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কক্সবাজারে অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনীর মেজর সিনহা হত্যাকাণ্ডের পর সেখানকার উর্ধ্বতন থেকে সকল পুলিশ সদস্যকে পর্যায়ক্রমে প্রত্যাহার করা হয়েছে, যা সর্বমহলে প্রশংসিত হয়েছে।

পুলিশে আধুনিকায়নে যে কাজগুলো শুরু হয়েছে এটি সম্পন্ন হলে বদলে যাবে পুলিশ। আধুনিক পুলিশের সেবাও হবে অন্যরকম। ইতোমধ্যে ৯৯৯ এ পুলিশের সেবার একটি উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে। সব উদ্যোগ সম্পন্ন হলে উন্নত বিশ্বে পুলিশের সেবা যে রকম পাওয়া যায় আমাদের দেশেও সম্ভব বলে অনেকেই মনে করেন।

সার্বিক বিষয়ে আইজিপি ড. বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ট্যাকটিক্যাল বেল্টের কারণে বিপদগ্রস্ত মানুষের যে-কোনো প্রয়োজনে দ্রুত সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিতে পারবে পুলিশ। আবার অপরাধীকে দ্রুত ঘায়েল করতে ট্যাকটিক্যাল বেল্টে থাকা প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করতে পারবে অনায়াসেই।’

আইজিপি বলেন, উন্নত দেশের আদলে পুলিশ সদস্যদের রাস্তায় দায়িত্ব পালনকালে সাধারণত যেসব সরঞ্জামাদি ব্যবহার করতে হয় তা এ বেল্টে এমনভাবে সংযোজন করা হয়েছে যাতে তারা ‘হ্যান্ডস ফ্রি’ রেখে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। এর ফলে উন্নত দেশের পুলিশের মতো বাংলাদেশ পুলিশের গেট আপে পরিবর্তন আসবে, পুলিশের দক্ষতা বাড়বে এবং জনগণকে আরো সহজে তাৎক্ষণিক সেবা দেওয়া সম্ভব হবে।

সর্বাধুনিক এই অপারেশনাল গিয়ারে তিনটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে বলে জানান আইজিপি। সেগুলো হলো- ট্যাকটিক্যাল বেল্ট, স্মল আর্মস উইথ থাই হোলেস্টার ও হ্যান্ডস ফ্রি কমিউনিকেশন।

পুলিশ প্রধান আরো বলেন, ‘এটা চালু করার কিছু উদ্দেশ্য আছে আমাদের। যেমন  পুলিশ সদস্যদের অপারেশনাল সক্ষমতা বাড়াতে হাত খালি রাখা। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে রুটিন দায়িত্ব পালনের সময় ভারি অস্ত্রের চেয়ে হালকা অস্ত্র ব্যবহার করা। এটি পুলিশ সদস্যদের দীর্ঘক্ষণ দায়িত্ব পালনকে সহজ করবে।’

এ সময় আইজিপি এটাও উল্লেখ করেন, তবে অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির উদ্ভব হলে জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বড় অস্ত্রের ব্যবহার অব্যাহত থাকবে।

এ ছাড়া বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক দেশের মতো বাংলাদেশ পুলিশকেও গড়ে তোলা হবে বলে জানান আইজিপি। তিনি আরো বলেন, পুলিশ ও জনগণের মধ্যে মানসিক দূরত্ব কমিয়ে আনা হবে এবং পুলিশি সেবাকে আরো সহজসাধ্য করা হবে। তিনি বলেন, আগামীতে পুলিশ আরো আধুনিক হবে। পুলিশ তার নিজস্ব স্বকিয়তায় এগিয়ে যাবে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads