• বুধবার, ১৫ মে ২০২৪, ১ জৈষ্ঠ ১৪২৯
বাংলাদেশকে অনিরাপদ প্রমাণের ষড়যন্ত্র!

বৌদ্ধ নেতা উসিট মং রাখাইন

জাতীয়

বাংলাদেশকে অনিরাপদ প্রমাণের ষড়যন্ত্র!

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৮ জানুয়ারি ২০২১

বহির্বিশ্বে বাংলাদেশকে অনিরাপদ প্রমাণ করতে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর বিশ থেকে ত্রিশজন নাগরিক দেশত্যাগ করে মিয়ানমারে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ষড়যন্ত্র করছিল। তাদের নেতৃত্বে ছিল বৌদ্ধ নেতা উসিট মং রাখাইন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে ঢাকার বিমানবন্দর থানায় সন্ত্রাস দমনবিরোধী আইনের একটি মামলার তদন্ত শেষে আদালতে দায়ের করা এক অভিযোগপত্রে এমনই তথ্য রয়েছে।

গত বছরের ১৬ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ নেতা উসিট মং রাখাইনসহ (৬৭) তিনজনের বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে এই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। মামলাটি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন। অভিযোগপত্রে বলা হয়, বৌদ্ধ নেতা উসিট মং রাখাইনের নেতৃত্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীর একদল লোক দেশত্যাগ করে মিয়ানমারে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার ষড়যন্ত্র করছিল। মূলত বহির্বিশ্বকে তারা বোঝাতে চেয়েছিল, বাংলাদেশে বাংলাদেশিরাই নিরাপদ নয়, সেখানে রোহিঙ্গারা নিরাপদে থাকবে কী করে।

মিয়ানমারের একটি বিদ্রোহী দলকে মদদ দেওয়া, দেশের অখণ্ডতা বিনষ্টের ষড়যন্ত্র ও আরো কিছু অভিযোগে ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা থেকে উসিট মং রাখাইনকে আটক করে র্যাব-১। পরে তাকে বিমানবন্দর থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। তার বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে একটি মামলা হয়। পরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে মামলাটি র্যাব-১ তদন্ত করে।

প্রায় আড়াই বছর পাঁচ তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটি তদন্ত করেন। সর্বশেষ র্যাব ১-এর সহকারী পুলিশ সুপার মো. কামরুজ্জামান মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ২০২০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর আদালতে উসিট মং রাখাইন (৬৭), গাজীপুর কালিয়াকৈরের স্থানীয় সাংবাদিক আইয়ুব রানা (৩৩), উসিট মংয়ের স্ত্রী এবং মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান লিবারেশন পার্টির (এএলপি) নেতা সুম্রারাজ লিন প্রকাশ ম্যাম্যাও (পলাতক)- এই তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

চার্জশিটে বলা হয়, অভিযুক্তরা দেশের সংহতি বিনষ্টের চেষ্টায় লিপ্ত ছিলেন। সুম্রারাজ লিন প্রকাশ ম্যাম্যাও (৫৮) মিয়ানমারের নাগরিক। তিনি ওই দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এএলপিরনের সশস্ত্র যোদ্ধা। উসিট মংয়ের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া ল্যাপটপে তার স্ত্রীর যোদ্ধার বেশে কিছু ছবি পাওয়া গেছে। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি চট্টগ্রামকে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের অংশ বলেও দাবি করে। অভিযুক্তরা বাংলাদেশে বসবাসরত রাখাইন সম্প্রদায়কে সংগঠিত করে তাদের মাধ্যমে দেশে বিশৃঙ্খলা ‍সৃষ্টিসহ সন্ত্রাসী কার্যক্রম গ্রহণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল।

সাংবাদিক আইয়ুব রানার বিষয়ে চার্জশিটে বলা হয়েছে, ২০০৬-২০০৭ সালের দিকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী মুক্তিযোদ্ধাদের কথা পত্রিকায় লিখতে গিয়ে উসিট মং রাখাইনের সঙ্গে তার পরিচয়। উসিট মং ও তার স্ত্রীকে নিয়ে আইয়ুব লেখালেখি (ফিচার) করেছেন। একপর্যায়ে উসিট মংকে দিয়ে রানা মিয়ানমার থেকে ফেসবুক, ইউটিউব ও অনলাইন টিভি খোলার প্রস্তাব দেন যাতে তারা বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গা ও বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী প্রতিবেদন প্রচার করতে পারে।

এ ছাড়া তারাসহ আরো ২০-৩০ জন বাংলাদেশি মিয়ানমারে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার পরিকল্পনা করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশে নিরাপদ নয় প্রমাণ করা। চার্জশিটে আরো উল্লেখ করা হয়, উসিট মং রাখাইন, তার স্ত্রী সুম্রারাজ লিন ও আইয়ুব রানা পরস্পরের যোগসাজশে বাংলাদেশের অখণ্ডতা, সংহতি ও সার্বভৌমত্ব বিপন্ন করতে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বিনষ্টের ষড়যন্ত্র এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনায় যুক্ত। যা প্রাথমিক তদন্ত ও সাক্ষ্যপ্রমাণে সত্য প্রতীয়মান হয়।’

চার্জশিটের দুই নম্বর আসামি সাংবাদিক আইয়ুব রানা ৯ মাস কারাভোগ করে উচ্চ আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হন। তিনি গাজীপুরের কালিয়াকৈর প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও সাপ্তাহিক সুবাণী পত্রিকার সম্পাদক। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, প্রয়াত বেবী মওদুদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রা পত্রিকার জন্য ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে যারা মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন, তাদের নিয়ে কাজ করেছি। তখন উসিট মং রাখাইনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাকে নিয়ে বিচিত্রা ছাড়াও একাধিক পত্রিকায় ফিচার, প্রতিবেদন হয়েছে। তাকে অনেকদিন ধরেই জানি।

উসিট মং ২০১৭ সালের ১৯ সালের অক্টোবরে বিমানবন্দর থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার এক মাস পর তার স্ত্রী মিয়ানমার থেকে একদিন আমাকে ফোন করে তার স্বামীর বিষয়ে খোঁজখবর নেয়। এর তিন দিন পর র্যাব আমাকে গ্রেপ্তার করে। আমাদের বিষয়ে যেসব অভিযোগ তোলা হয়েছে, সেগুলো সত্য নয়। উসিট মং তার এনজিওর একটি ওয়েবসাইট করতে চেয়েছিলেন। সে বিষয়ে আমার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন। আমরা মিয়ানমার থেকে কোনো ইউটিউব চ্যানেল বা অনলাইন টিভি চালাতে চাইনি।

নিজেকে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা দাবি করে আইয়ুব রানা বলেন, আমি ২০০৩ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত কালিয়াকৈর সদর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলাম। আমি কোনো ষড়যন্ত্রে জড়িত নই। জামিন পেয়েছেন উসিট মং রাখাইন। নিয়মিত আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। অভিযোগ অস্বীকার করেছেন তিনিও। উসিট মং বলেন, আমি মুক্তিযোদ্ধা। দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করব কেন? মানুষের সেবায় দেশের বিভিন্ন জেলায় কাজ করি। আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, র্যাবের তদন্তে সন্ত্রাসবাদে অভিযুক্ত উসিট মং একজন তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা। তার বাড়ি বরগুনা জেলার তালতলীর ঠাকুরপাড়ায়। ১৯৭১ সালে ছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ঠাকুরপাড়া থেকে। চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় উসিট মং। তার দুই ভাইও মুক্তিযোদ্ধা। উসিট মং বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে দুই সন্তান নিয়ে থাকেন। তার স্ত্রী মিয়ানমারে আছেন।

রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামে উসিট মংয়ের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশের বরগুনা, পটুয়াখালী এবং কক্সবাজার এলাকায় সেবামূলক কাজ করে বলে জানায় উসিট মং। তার বোন এথিন রাখাইন কক্সবাজার আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে জড়িত। ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনের পর চট্টগ্রাম থেকে আওয়ামী লীগের সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্যও ছিলেন তিনি।

এথিন বলেন, আমার ভাই একজন বয়োবৃদ্ধ সমাজসেবক। রাখাইন ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন নামে একটি এনজিও চালান। বৌদ্ধ ও মুসলিমসহ সব ধর্মের লোককেই সাহায্য করার চেষ্টা করেন তিনি। উসিট মং তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধা হলেও বরগুনার তালতলী উপজেলার ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোসলেম আলী হাওলাদার তা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, উসিট মুক্তিযোদ্ধা নন। তার ভাই অংসিট মং রাখাইন মুক্তিযোদ্ধা। উসিট মং টাকাপয়সা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা সেজেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকায় উসিট মংয়ের বিষয়ে সুপারিশ করবেন না বলেও তিনি জানান।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সহকারী পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান বলেন, আদালতে উসিট মং রাখাইন ও সাংবাদিক আইয়ুব আলী দুজনই স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। চার্জশিটে বাংলাদেশের অখণ্ডতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার স্থান, সময়সহ বিস্তারিত উল্লেখ নেই কেন জানতে চাইলে বলেন, আসামিদের স্বীকারোক্তি, সাক্ষীদের সাক্ষ্যসহ তদন্তে যা পাওয়া গেছে তা চার্জশিটে উল্লেখ করা হয়েছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads