• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ভ্যাকসিনে সম্ভাবনার বাংলাদেশ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ৩০ জানুয়ারি ২০২১

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতেও বিশ্বজুড়ে অজানা মহামারীর আশঙ্কা করছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা। সেক্ষেত্রে মানবজাতির জন্য প্রয়োজন পড়বে নতুন নতুন ভ্যাকসিন (টিকা)। সেই সম্ভাবনার ওপর আলো ফেলেছে বাংলাদেশে উৎপাদিত গ্লোব বায়োটেকের ভ্যাকসিন ‘বঙ্গভ্যাক্স’। এছাড়া একটি ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা বেশিদিন থাকে না। সেক্ষেত্রে দেশের বিশাল জনসংখ্যাকে অ্যান্টিবডির আওতায় আনতে ভ্যাকসিনের ধরন ও উৎপাদন সক্ষমতা বাড়াতে হবে কয়েকগুণ। তাই ভবিষ্যতের কথা বিবেচনা করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত র্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের সম্ভাবনরা প্রতিও গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

যেকোনো ভাইরাস থেকে বাঁচতে মানবদেহের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থা বা ইমিউনিটির জন্য অ্যান্টিবডি খুবই জরুরি উপাদান। একই সাথে করোনাভাইরাস যেন দেহকোষে ঢুকে পড়তে না পারে তা ঠেকায় এই অ্যান্টিবডি। আর এ অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য বিশ্বব্যাপী সারা ফেলেছে করোনা ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও উৎপাদনকারী মার্কিন কোম্পানি মডার্না, ব্রিটিশ অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও অক্সফোর্ড এবং সর্বশেষ রাশিয়ার গামালেয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব এপিডেমিওলোজি অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজির স্পটুনিক ভি ভ্যাকসিন। প্রশ্ন হলো, অ্যান্টিবডি যদি শরীর থেকে অল্পদিন পরেই অদৃশ্য হয়ে যায়, তাহলে টিকা দিয়ে কি আদৌ করোনাভাইরাস ঠেকানো যাবে! আর বিদেশ থেকে আমদানি করে বাংলাদেশের বিপুল জনসংখ্যার কত শতাংশ ভ্যাকসিনের আওতায় আনা যাবে।   

অন্যদিকে কোন ভ্যাকসিনটি সেরা, এটি এখনো বলার সময় হয়নি। গত বছরের শেষদিকে উল্লিখিত চারটি ওষুধ কোম্পানি ঘোষণা করে, তাদের ভ্যাকসিন কাজ করছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ ভ্যাকসিনই ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।

সবগুলো টিকা উৎপাদকের দাবি, তাদের ভ্যাকসিন চূড়ান্ত তথা তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে বিভিন্ন বয়সি স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে সফল ও কার্যকর ফল দেখিয়েছে। ফাইজার-বায়োএনটেক ১৭০ সংক্রমিত ব্যক্তিকে টেস্ট করে ৯৫ শতাংশ সফলতার দাবি করেছে। মডার্নার ৯৫টি পরীক্ষায় ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ সফলতা পাওয়া গেছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকা-অক্সফোর্ডের ১৩১টি পরীক্ষায় ভিন্ন দুই ডোজ ব্যবহার করা হয়েছে এবং সফলতা পাওয়া গেছে ৭০ শতাংশ। রাশিয়ার স্পুটনিক ভি ভ্যাকসিনের ৩৯টি পরীক্ষায় ৯১ দশমিক ৪ শতাংশ কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। তৃতীয় পর্যায়ের ট্রায়ালে রয়েছে আরো ৭টি ভ্যাকসিন। প্রি-ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে আছে ১৬৪টি।

মডার্নার ভ্যাকসিন থেকে শরীরে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডির স্থায়িত্ব আট মাস। মডার্না গবেষণা করে এই তথ্য পেয়েছে। ফাইজারের ভ্যাকসিনের ফল এমনই হওয়ার কথা। কারণ দুটি ভ্যাকসিন একই গোত্রের। অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিনের প্রয়োগ মাত্র শুরু হয়েছে। তবে ব্রিটেনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের টিকা তৈরির প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাদের তৈরি ভ্যাকসিনটি বয়স্ক মানুষদের দেহে শক্তিশালী ভাইরাস-প্রতিরোধী সাড়া সৃষ্টি করেছে।

এদিকে বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের উৎপাদিত করোনা ভ্যাকসিন এক বড় ধরনের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির ‘বঙ্গভ্যাক্স’ নামে এ ভ্যাকসিন উৎপাদনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন পেয়েছে। অন্যদিকে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের অনুমোদন দেয়নি। তবে এটি বাংলাদেশের জন্য বড় সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এ দুটি ভ্যাকসিনে সক্ষমতা অর্জনের জন্য বাংলাদেশের সামনে এখন বিশাল সুযোগ। এর ফলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে ভ্যাকসিন রপ্তানি করা যাবে মিয়ানমার, ভুটানসহ অনেক দেশে।   

বিশ্বের মানুষ এখন করোনা ভ্যাকসিন পেতে মরিয়া। কিছু দেশ ভ্যাকসিন পেলেও পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এখনো জোগাড়ই করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকার ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার তিন কোটি ডোজ ভ্যাকসিনের জন্য চুক্তি করেছে। অনেক টানাপড়েনের পর চুক্তির প্রথম চালান ৫০ লাখ ডোজ ইতোমধ্যে বাংলাদেশ বুঝে পেয়েছে। এর আগে ভারত সরকারের উপহার হিসেবে পেয়েছে ২০ লাখ ডোজ ভ্যাকসিন। বাকি আড়াই কোটি পর্যায়ক্রমে আসবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুপাতে এই ভ্যাকসিন খুবই সামান্য। সব মানুষকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনার মতো পর্যাপ্ত ডোজ জোগাড় এখনো ধোঁয়াশা। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণভাবে ভ্যাকসিন উৎপাদনে জোর দিয়েছেন তারা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ১৮ জানুয়ারি করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির এক বৈঠকে করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনে নিজেদের সক্ষমতা অর্জনের সুপারিশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, কোভিড ১৯ টিকার প্রয়োজনীয়তা পরবর্তী বছরগুলোতেও থাকবে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ ধরনের নতুন মহামারী সৃষ্টি হতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন। অন্যান্য প্রচলিত রোগের জন্য শিশু ও বয়স্কদের টিকাদান কর্মসূচি চলমান রয়েছে। এ প্রেক্ষাপটে দেশেই ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, টিকা তৈরি কোনো অলীক কল্পনা নয়। বাংলাদেশে তো বিভিন্ন রোগের টিকা হচ্ছে। দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও তৈরি করছে। তবে ভারতে করোনা টিকা উৎপাদন করছে সেরাম ইনস্টিটিউট ও ভারত বায়োটেক। ওরা এখন সক্ষমতার শেষ ধাপে চলে গেছে। ওরা আর পারবে না। করোনা টিকা উৎপাদন করতে হচ্ছে অন্যান্য টিকাও করতে হচ্ছে।

ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ আরো বলেন, ভ্যাকসিন সক্ষমতা অর্জনে বাংলাদেশের সামনে এখন বিশাল সুযোগ। টিকা যদি নিজেরা করতে পারি শুধু আমরা না, মিয়ানমার, ভুটানেও দিতে পারব। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রীকেও জানিয়েছি। অন্য দেশের আবিষ্কৃত টিকা ফর্মুলা এনেও তৈরি করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে শিশুদের টিকা, করোনা টিকা বা অন্য মহামারীর টিকা তৈরির সক্ষমতা যেন তৈরি হয়। সরকার যেন গ্রহণযোগ্য ন্যাশনাল রেগুলেটরি অথরিটি (এনআরএ) গঠন করে। ভ্যাকসিন তৈরির উদ্যোগ নিলে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাপোর্ট দিতে হবে। উদ্যোগ সরকারি বা বেসরকারিভাবেও হতে পারে। ভ্যাকসিন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে পারে সরকার। অদূর ভবিষ্যতে আমরা নিজেরা যেন সহজে টিকা তৈরি করতে পারি।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, আমাদের অর্থমন্ত্রী বলেছেন ৪৩ বিলিয়ন ডলার আমাদের বর্তমানে উদ্বৃত্ত রয়েছে। আমি সরকারের কাছে আহ্বান জানাচ্ছি, বিলিয়ন ডলার থেকে মাত্র আধা বিলিয়ন ডলার গবেষণা এবং ভ্যাকসিন উৎপাদনের জন্য যেন বরাদ্দ দেওয়া হয়। এটা করলে আমরা নিজেরাই উৎপাদন করে সবাই করোনার ভ্যাকসিন নিতে পারব এবং পাশাপাশি অন্য দেশকেও সহযোগিতা করতে পারব।

এ বিষয়ে সিনেসিস হেলথের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. নিজাম উদ্দীন আহম্মেদ বলেন, এমনটা হলে খুবই আশাব্যঞ্জক বিষয় হবে। বেসরকারি উদ্যোগে গ্লোব বায়োটেক শুরু করেছে। প্রতিষ্ঠানটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তালিকাভুক্ত হয়েছে, করোনা ভ্যাকসিন উৎপাদনে যাচ্ছে, ট্রায়ালে যাচ্ছে। এখন সরকারকে এগিয়ে আসা দরকার সাপোর্ট দেওয়ার জন্য। একই সঙ্গে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র উদ্ভাবিত র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের সাফল্যের জন্য সরকারকে সব ধরনের সহযোগিতা করার আহ্বান করেন তিনি।

ভ্যাকসিন সক্ষমতার আগে জনস্বাস্থ্য কাঠামো ঠিক করার তাগিদ দিয়ে আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ভ্যাকসিন যারা তৈরি করছে, তাদের ভ্যাকসিন তৈরির ক্যাপাসিটিতে সীমাবদ্ধতা আছে। দেশে জনসংখ্যা অনুপাতে ভ্যাকসিন সক্ষমতা আমাদের দরকার। তবে ভ্যাকসিন সক্ষমতার আগে জনস্বাস্থ্য কাঠামো ঠিক করতে হবে। আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাহলে মহামারী মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে। 

গ্লোব বায়োটেক লিমিটেডের হেড অব কোয়ালিটি অপারেশন ড. মোহাম্মদ মহিউদ্দিন বলেন, গ্লোব বায়োটেক লিমিটেড তাদের উৎপাদিত করোনা ভ্যাকসিন ‘বঙ্গভ্যাক্স’ ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জন্য অনুমোদন দিয়েছে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই এ ভ্যাকসিনের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালানোর প্রস্তুতি চলছে।

গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রধান বিজ্ঞানী এবং করোনা শনাক্ত র‍্যাপিড অ্যান্টিবডি টেস্ট কিটের আবিষ্কারক ড. বিজন কুমার শীল বলেন, বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করা অপরিহার্য। কারণ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হওয়া ব্যক্তির শরীরে মেমরি সেল ছয় মাস থাকে, ইম্পেরিয়াল কলেজের  এ গবেষণা সঠিক। ছয় মাস পরে থাকবে কি না, তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, করোনাভাইরাসের বয়স তো বেশি না। মেমরি সেল শরীরে অনেক বছর থাকে, আমি পূর্বে এ কথা বলেছি, এখনো বলছি সার্স ভাইরাসের অভিজ্ঞতা থেকে। সার্স ভাইরাস এবং করোনাভাইরাস একই গোত্রের এবং দুটির মধ্যে মিল ৮৩ শতাংশ। তিনি বলেন, আমরা যে কিট উদ্ভাবন করেছি, তা দিয়ে খুব সহজেই বাংলাদেশ অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করতে পারত। আসলে ভ্যাকসিনের বিশাল বাণিজ্যের কারণেই হয়তো অ্যান্টিবডি টেস্টের দিকে না গিয়ে ভ্যাকসিনের দিকে যাওয়া হচ্ছে। যার প্রয়োজন নেই, তার জন্যও ভ্যাকসিনের কথা ভাবা হচ্ছে। যার শরীরে অ্যান্টিবডি আছে, তাকে ভ্যাকসিন দেওয়া গরিব দেশের জন্য সময় ও অর্থের অপচয়।

গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মহিবুল্লাহ খন্দকার বলেনন, এখন আমরা চাই দ্রুতগতিতে আইসিডিডিআরবিতে আমাদের অ্যান্টিবডি কিটের পরীক্ষা করা হোক। কিন্তু কবে হবে জানি না। এখন ফাইল বিএমআরসিতে আছে।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মাহবুবুর রহমান সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেন, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন যারা তৈরি করছে, তাদের কাছ থেকে প্রযুক্তি এনে দেশেই তৈরি করা যাবে বলে তারা আশাবাদী। আমাদের দেশের বেশ কয়েকটি বেসরকারি ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানির ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা আছে। টেকনোলজি ট্রান্সফার করা হলেই দেশে উৎপাদনের কাজ শুরু হবে বলে তিনি জানান।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, দেশের বেসরকারি কয়েকটি ফার্মসিউটিক্যাল কোম্পানির করোনা ভ্যাকসিন তৈরির সক্ষমতা এবং প্রস্তুতি আছে। সেসব কোম্পানি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে এ ব্যাপারে যোগাযোগও করেছে। টিকা উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও সরকার এ বিষয়ে আলোচনা করছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads