• সোমবার, ৬ মে ২০২৪, ২৩ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বিভিন্ন প্রকল্পের সময় ও ব্যয় বৃদ্ধি

অপচয় হচ্ছে রাষ্ট্রের অর্থ

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও সংস্থার অধীনে গৃহীত প্রকল্পগুলোর সংশোধন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের নামে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির হিড়িক পড়েছে। নির্ধারিত সময় ও প্রাক্কলিত ব্যয়সীমার মধ্যে প্রকল্পের বাস্তবায়ন সম্পন্ন হওয়ার দৃষ্টান্ত এখন নেই বললেই চলে। বিশ্লেষকরা বলছেন, হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে গৃহীত এসব প্রকল্পে কাগজে-কলমে জনস্বার্থের কথা বলা হলেও বাস্তবে বিশেষ শ্রেণির স্বার্থ রক্ষাই যেন মুখ্য। দফায় দফায় সময় ও ব্যয় বাড়ানোর ফলে জনগণ সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি তাদের কষ্টার্জিত করের টাকারও অপচয় হচ্ছে। দীর্ঘসূত্রতা এবং ব্যয় বৃদ্ধির কারণে রাষ্ট্রের অর্থ অপচয়ের প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্প’টি।

২০১২ সালের জানুয়ারিতে ২৭৫ কোটি ৪৩ লাখ টাকা ব্যয়ে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটি ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে ৩ বছরের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ৮ বছরেও শেষ হয়নি এর কাজ। কবে হবে তাও অজানা। ৮ বছরে প্রকল্পটির আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩৬ দশমিক ৩৯ শতাংশ এবং বাস্তব অগ্রগতি ৫৫ শতাংশ। ২০১৪ সালে মেয়াদ শেষে দুই দফায় মেয়াদ বৃদ্ধির পর ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ওই সময়েও শেষ হয়নি প্রকল্পের সিকিভাগ কাজ। পরবর্তীসময়ে ১ম সংশোধিত আকারে প্রকল্পটির ব্যয় দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি করে ৬১১ কোটি টাকা প্রস্তাব অনুমোদন পায়। একই সাথে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১৯-এর ডিসেম্বর পর্যন্ত।

এরপরও শেষ হয়নি কলেজ নির্মাণ প্রকল্প। এ সময় অভিযোগ ওঠে প্রকল্পের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি নিয়ে। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্প ‘বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ’-আইএমইডি’র তদন্তে উঠে আসে প্রকল্পটির সবকটি ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রেই নকশা পরিবর্তনসহ নানা অনিয়ম। ২০১৮ সালে অনিয়মের কারণে নির্বাহী প্রকৌশলী, উপ-সহকারী প্রকৌশলীসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু এরপরও থামেনি অনিয়ম। বরং নতুন করে ৬৮২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা ব্যয় বাড়ানোর পাশাপাশি ৩ বছর সময় বাড়ানোর আবেদন করা হয়, যদিও সেটি একনেকে পাস হয়নি।

গত ১ ডিসেম্বর একনেক বৈঠকে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘নরসিংদী জেলার অন্তর্ভুক্ত আড়িয়াল খাঁ নদ, হাড়িদোয়া নদী, ব্রহ্মপুত্র নদ, পাহাড়িয়া নদী, মেঘনা শাখা নদী ও পুরাতন ব্রহ্মপুত্র শাখা নদ পুনঃখনন’ ও ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের ২টি প্রকল্প যথাক্রমে ‘ডিজিটাল সংযোগের জন্য টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক আধুনিকীকরণ’ প্রকল্প দুটির কাজ নির্ধারিত সময়ে  শেষ না হওয়ায় সময় ও ব্যয় (১ম সংশোধিত) বৃদ্ধির আবেদন করা হয়। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের ‘মিউনিসিপ্যাল গভর্ন্যান্স অ্যান্ড সার্ভিসেস’ প্রকল্পটি ১ম সংশোধনীর পর প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় দ্বিতীয়বারের সংশোধিত আকারে সময় ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হলে তা একনেকে অনুমোদন পায়।

গত ৮ ডিসেম্বর একনেক সভায় প্রায় তিন হাজার ৯০৩ কোটি ৩১ লাখ টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ২টি প্রকল্পেই বেড়েছে ব্যয় ও সময়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের ‘কৃষি তথ্য সার্ভিস আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনীতে ব্যয় বেড়েছে ৪১ কোটি ২০ লাখ টাকা (মূল প্রকল্পের ব্যয় ৬৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা) এবং সময়  বাড়ানো হয়েছে আরো ২ বছর (২০২০ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা ছিল)। এছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের ‘চরখালী-তুষখালী-মঠবাড়িয়া-পাথরঘাটা সড়ক উন্নয়ন ও প্রশস্তকরণ (জেড-৮৭০১)’ প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে ৪৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা (প্রকল্পটির শুরুতে ব্যয় ছিল ১০৪ কোটি ৭৭ লাখ টাকা)।

সবশেষে গতকাল একনেকে পাস হওয়া ৮টির মধ্যে দুটি প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ে শেষ না হওয়ায় নতুন করে ব্যয় বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে প্রয়োজন বড় ধরনের সংস্কার। তারা বলেন, অতীতে প্রকল্প প্রণয়নের আগে যেভাবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হতো বর্তমানে তা হয় না। এছাড়া প্রকল্পে বাইরের লোকের হস্তক্ষেপ, যিনি ফিজিবিলিটি স্টাডি করেন তাকেই বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া, প্রকল্পের যাবতীয় তথ্য অনলাইনে প্রকাশ না করে গোপন রাখা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে বিশেষ একটি শ্রেণি গড়ে উঠেছে যারা এসব প্রকল্পকে ঘিরে কোটারি ভিত্তিতে কাজ আদায় করেন তাদের দৌরাত্ম্য এবং সর্বোপরি দুর্নীতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এবং সুশাসনের অভাবকেই বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থ অপচয়ের জন্য দায়ী করেছেন তারা।

এ প্রসঙ্গে টিআইবির সাবেক ট্রাস্টি সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘কেন এ ধরনের ব্যয় ও সময় বৃদ্ধি হয় সেটি কখনো তেমন তদন্ত করে দেখা হয় না। ফলে এসব বন্ধ হচ্ছে না।’ তার মতে, ‘সুশাসন এবং জবাবদিহিতার অভাবেই এ ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।’

বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়মের অংশ হিসেবে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার কথা থাকলেও বাস্তবে এর অস্তিত্ব শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ। খোদ পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান এ বিষয়ে গণমাধ্যমে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ের এক অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে সরাসরি কাজ করে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা হলো কোনো প্রকল্প একনেকে যাওয়ার আগে আমার কাছে ডিপিপি’র ডকুমেন্ট আসে। সেখানে  ফিজিবিলিটির বিষয়টা রয়েছে, যেটা আমি নিয়মিত পড়ি।  সেখানে ফিজিবিলিটির বিষয়টি খুবই দুর্বল মনে হয়েছে আমার কাছে। শুধু আমি না, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও এ নিয়ে কথা বলেছেন। সেখানে একটি কলাম থাকে ফিজিবিলিটি স্টাডি করা হয়েছে কি না। সেই কলামে লিখে দেওয়া হয় ‘করা হয়েছে’। কিন্তু কখন, কোথায়, কে করেছে, কীভাবে হয়েছে তার কিছুই লেখা থাকে না। এ নিয়ে অনেক সময় কাগজও খুঁজে পাওয়া যায় না। শুধু কলাম ফিলাপ করেই শেষ।’ 

সিপিডি’র জ্যেষ্ঠ গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘আগে কোনো প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে যেভাবে কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট বিবেচনায় আনা হতো এখন সেটা হয় না। এখন যে পার্টি রিভিউ করছে তাকে দিয়েই প্রজেক্ট করানো হচ্ছে। এর ফলে কনফ্লিক্ট তৈরি হচ্ছে। এখন ফিজিবিলিটি স্টাডি যিনি করেন তাকেই কাজ দেওয়া হয়।’

উদাহরণ হিসেবে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ‘কাউকে একটি ব্রিজ নির্মাণে ফিজিবিলিটি স্টাডি করার জন্য বলার পাশাপাশি বাস্তবায়নের কাজও তাকে দেওয়া হবে এমন একটা আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ের ভিত্তিতে। ফলে যিনি ফিজিবিলিটি করছেন তাকেই বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়ায় বাজেট তৈরির ক্ষেত্রে ওই ব্যক্তি ব্যয় বাড়িয়ে দেখাচ্ছেন। কিন্তু অতীতে এমন নজির ছিল না। তখন থার্ড পার্টিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দেওয়া হতো, যাতে কোনো বিতর্ক সৃষ্টি না হয়।’

বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণের ক্ষেত্রে বাইরের লোকের হস্তক্ষেপ বাড়ছে বলে উল্লেখ করে মোয়াজ্জেম বলেন, ‘বিশেষ করে কন্ট্রাক্টরসহ অনেকেই প্রজেক্ট ডিজাইনিংয়ের ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের কারণে পরবর্তীসময়ে আবারো প্রজেক্ট সংশোধন করতে হয়। প্রকিউরমেন্ট প্রক্রিয়াও স্বচ্ছ না, যদিও বলা হচ্ছিল যে এগুলো স্বচ্ছ হবে। সব তথ্য অনলাইনে দেওয়া হবে। কিন্তু সেটি আর করা হয় না।’

তিনি প্রকল্পে এ ধরনের অনিয়ম বন্ধে প্রকল্প প্রণয়ন থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন, কেনাকাটা ও প্রকল্পের কন্ট্রাক্টর সিলেকশনসহ সব তথ্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পাবলিক ডোমেইনে উন্মুক্ত করে দেওয়ার পরামর্শ দেন। তার মতে, ‘এর ফলে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি হবে এবং স্বচ্ছতা আসবে। অযাচিতভাবে অপচয় কমবে এবং দুর্নীতিও কমবে।’

একই সাথে স্থানীয় প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে নিয়মিত প্রকল্পের বিষয়ে মতামত গ্রহণের সুযোগ সৃষ্টিরও পরামর্শ দেন গোলাম মোয়াজ্জেম।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads