রাজধানীসহ সারা দেশে আজ শনিবার থেকে একযোগে শুরু হচ্ছে করোনা টিকা প্রদান কার্যক্রম। প্রথম দিন ১ হাজার ১৫টি কেন্দ্রে টিকা দেওয়া হবে। টিকাদানে নিয়োজিত থাকবে স্বাস্থ্যকর্মীদের ২ হাজার ৪০২টি দল। সকাল ১০টা মহাখালী স্বাস্থ্য ভবনে ভার্চুয়ালি টিকা কার্যক্রমের উদ্বোধন করবেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। এরপর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে গিয়ে তিনি টিকা নেবেন। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত টিকা দেওয়া হবে।
গতকাল শনিবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা, মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রমুখ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার লাইন ডিরেক্টর এবং মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম আলম জানান, ঢাকায় ৫৬টি স্থানে টিকাদান হবে। সেখানে কাজ করবে স্বাস্থ্যকর্মীদের ২০৬টি দল। ঢাকার বাইরে সারা দেশে বিভিন্ন হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মিলিয়ে ৯৫৯ স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে। এসব জায়গায় ২ হাজার ১৯৬টি দল টিকাদান কার্যক্রম পরিচালনা করবে। দুজন স্বাস্থ্যকর্মী এবং দুজন স্বেচ্ছাসেবক মিলিয়ে প্রতিটি দলে চারজন সদস্য থাকবেন। প্রত্যেকটি দলের স্বাস্থ্যকর্মীরা সর্বোচ্চ ১৫০ জনকে টিকা প্রয়োগ করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে সব মিলিয়ে প্রথম দিনে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৪০০ জন মানুষকে টিকা দেওয়ার সক্ষমতা রয়েছে। এই সংখ্যা কমবেশি হতে পারে। এসব দল প্রয়োজন অনুযায়ী কাজ করবে। প্রথম দিন সবাই কাজ করবে- ব্যাপারটি এমন নয়। টার্নআউট কম হলে লোকজন কম কাজ করবে। পুরোপুরি কাজ থাকলে প্রত্যেকেই জয়েন করবে। প্রথম দিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের টিকা নেওয়ার জন্য কয়েকটি স্থান নির্ধারণ হয়েছে।
সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্যরা মহাখালীর শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে টিকা নেবেন। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সচিবালয় ক্লিনিক এবং সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল, আইনজীবীরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে টিকা নিতে পারবেন। এর বাইরেও সবাই নিজের পছন্দমতো জায়গা থেকে টিকা নিতে পারবেন। ডা. নাজমুল আরো বলেন, আমরা জানতে পেরেছি- এমপি মহোদয়রা উনাদের নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকায় টিকা নেবেন। এছাড়া যার বাসা যেখানে, তিনি সেখানে স্লট পেলে সেখানেই টিকা দেওয়া হবে। শেখ রাসেল জাতীয় গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক টিকা নেবেন বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক জানিয়েছেন, নিবন্ধন না করলেও কেন্দ্রে এসে যাতে টিকা নিতে পারেন সে ব্যবস্থাও রাখা হচ্ছে। এক্ষেত্রে টিকা নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে জাতীয় পরিচয়পত্র সঙ্গে আনতে হবে। কারণ, টিকাগ্রহীতার সব তথ্য রেখে দেওয়া হবে স্বাস্থ্যকর্মীরা পরে তা ডেটাবেইজে তুলে দেবেন। কেন্দ্রে আসা কোনো ব্যক্তিকে ফেরত দেওয়া যাবে না।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী আরো বলেন, আমরা চেষ্টা করব কেন্দ্রে আসা ব্যক্তিদের নিবন্ধন করিয়ে টিকা দেওয়ার। যদি নিবন্ধন করতে দেরি হয়, তাহলে টিকা দেওয়ার পরে ডেটা এন্ট্রি করা হবে। আমরা কাউকে ফেরত দেব না। অনেকের কাছে স্মার্টফোন নেই। অনেকে নিবন্ধন করতে পারবেন না। এ কারণে চেয়ারম্যান থেকে শুরু মেয়র-এমপিরা টিকা কেন্দ্রে থাকবেন। তারা মানুষকে কেন্দ্রে নিয়ে আসবেন, টিকা দেবেন এবং নিবন্ধন করাবেন। টিকা দেওয়ার সব ধরনের প্রস্তুতি প্রায় চূড়ান্ত।
এখন পর্যন্ত যাদের টিকা দেওয়া হয়েছে তারা সবাই সুস্থ আছে। আমরা সবাইকে আহ্বান জানাই কেন্দ্রে এসে টিকা নেওয়ার। সরকার দেশের মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ অর্থাৎ ১৩ কোটি ৮২ লাখ ৪৭ হাজার ৫০৮ জন মানুষকে করোনার টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। প্রতিজনকে দেওয়া হবে দুই ডোজ টিকা। জাতীয়ভাবে কোভিড-১৯ টিকা বিতরণ ও প্রস্তুতি পরিকল্পনা অনুযায়ী, তিন ভাগে (ফেজ) মোট পাঁচ ধাপে এসব টিকা দেওয়া হবে। মহামারী প্রতিরোধে সামনের কাতারে থাকা মানুষ প্রাধান্য পাবে।
এর আগে প্রথম মাসে ৬০ লাখ ডোজ টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা থাকলেও পরে তা পরিবর্তন করা হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. এ বি এম খুরশীদ আলম বলেন, আগের পরিকল্পনায় পরিবর্তন এনে প্রথম মাসে ৩৫ লাখ ডোজ টিকা দেওয়া হবে। সেরাম ইনস্টিটিউট থেকে ৩ কোটি ডোজ টিকা কেনার চুক্তি করেছে সরকার। প্রথম চালানে ৫০ লাখ ডোজ ইতোমধ্যে দেশে পৌঁছেছে। এছাড়া ভারত সরকার উপহার হিসেবে আরো ২০ লাখ ডোজ টিকা দিয়েছে। তা দিয়ে শুরু হয়েছে টিকাদান। কেনা টিকার বাইরে জুনের মধ্যে কোভ্যাক্স থেকে সোয়া এক কোটি ডোজ টিকা পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
উচ্চপর্যায়ের অনেকেই আজ টিকা নেবেন। প্রধান বিচারপতি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেবেন। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সচিব টিকা নেবেন নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে, কেবিনেট সচিব টিকা নেবেন শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বিভিন্ন মন্ত্রী, যেমন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে টিকা নেবেন বলে আমরা জানতে পেরেছি। দুযোর্গ প্রতিমন্ত্রী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার হাসপাতালে টিকা নেবেন। এ রকম বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্নভাবে সংসদ সদস্যরা, রাজনৈতিক জনপ্রতিনিধি, গণ্যমান্য ব্যক্তিরা যেসব কেন্দ্রের সাথে সম্পৃক্ত থাকবেন তারা নিজেরাও টিকা নেবেন এবং অন্যদেরও টিকা নিতে উদ্বুদ্ধ করবেন। আমাদের শিক্ষামন্ত্রী ঢাকা থেকে জুমে চাঁদপুরে যুক্ত হবেন বলে আমরা জানতে পেরেছি।
প্রস্তুতি সম্পর্কে মূল্যায়ন জানতে চাইলে মহাপরিচালক সন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, আমি তো ‘এ’ বলব। প্রথম দিন যাদের টিকা নেওয়ার কথা তারা এখনো এসএমএস পাননি কেন-এমন প্রশ্নের উত্তরে বলেন, এসএমএস পেয়ে যাবেন। রাতে মেসেজ পেয়ে কি সবার পক্ষে টিকা নেওয়া সম্ভব-জানতে চাইলে বলেন, এই কার্যক্রম তো চলমান প্রক্রিয়া। এটা চলতে থাকবে। এক দিন না নিলে যে পরে নেওয়া যাবে না- এ রকম না। গতকাল শনিবার পর্যন্ত নিবন্ধন হয়েছে ৩ লাখ ২৮ হাজার। তবে ১৮ বছরের নিচে, গর্ভবতী নারী, শিশুকে দুগ্ধদানকারী মা, যাদের অনেক জ্বর আছে তাদের টিকা দেওয়া যাবে না বলে জানান মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। যাদের কোভিড আছে, তারা ৪ সপ্তাহ পর্যন্ত টিকা নিতে পারবেন না। অন্য কোনো রোগের ক্ষেত্রে কোভিড টিকা দেওয়া যাবে না- এমন কোনো নিষেধ নেই। কিন্তু সতর্কতার অংশ হিসেবে যারা এই মুহূর্তে গুরুতর অসুস্থ, হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, তাদেরকে আমরা বলছি তারা যেন টিকা নিতে না আসেন। এছাড়া কিছু প্রশ্ন থাকবে, টিকাদান কর্মী সেসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেই টিকা দেবেন। ওষুধে যাদের অ্যালার্জি হয়, তাদের টিকা দেওয়া হবে না। প্রাথমিক অবস্থায় এই কথাগুলো বলছি। টিকা কার্যক্রম কিছুদিন চলার পর আমাদের অবজারভেশনের ভিত্তিতে আপডেট করা হবে। এছাড়া প্লাজমা থেরাপি দেওয়া এবং কোভিড থেকে সুস্থ হওয়ারাও এক মাসের মাথায় গিয়ে টিকা নিতে পারবেন।
উল্লেখ্য, গত ২৭ জানুয়ারি দেশে প্রথম করোনা টিকা প্রদান শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন। এর এক দিন পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুয়েত মৈত্রী হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতাল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) প্রাথমিকভাবে ৫৪১ জনকে টিকা প্রদান করা হয়। তাদের মধ্যে ২৯৬ জন চিকিৎসক, ৩২ জন নার্স এবং অন্যান্য পেশার ২০৮ জন রয়েছেন। এ পর্যন্ত টিকা গ্রহণকারীদের মধ্যে ৪৩১ জন পুরুষ ও ১১০ জন নারী। এদের মধ্যে বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. কনক কান্তি বড়ুয়া, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব আবদুল মান্নান, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব খাজা মিয়া এবং আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক টিকা গ্রহণ করেছেন।