• বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

বেপরোয়া ভুয়া চিকিৎসকরা

  • সালাহ উদ্দিন চৌধুরী
  • প্রকাশিত ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১

কোনোভাবেই থামছে না ভুয়া চিকিৎসকদের তৎপরতা। শুধু ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধই বিক্রি নয়, তারাও দেদার করছেন ল্যাবরেটরি টেস্ট বাণিজ্য। অভিযোগ রয়েছে, ন্যাশনাল অল্টারনেটিভ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রতিষ্ঠিত করছে এ ধরনের ভুয়া চিকিৎসকদের।  

বিভিন্ন সময় আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে বিভিন্ন এলাকায় ভুয়া চিকিৎসক (ডাক্তার) আটক হলেও এখনো চলছে তাদের বাণিজ্য। স্বঘোষিত এক কিডনি-ডায়াবেটিক বিশেষজ্ঞ সালাহ্্উদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমার বাবা একজন ডাক্তার ছিলেন। ওনার কাছ থেকে শিখেছি চিকিৎসাশাস্ত্রের ৫০ ভাগ, যেহেতু আমি কেমেস্ট্রির ছাত্র তাই সেখান থেকে শিখেছি ২৫ ভাগ, আর বাকি ২৫ ভাগ আমি গবেষণা করে বের করেছি। ব্যাস হয়ে গেলো শতভাগ।’

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানাধীন কেএমদাস লেনে দীর্ঘদিন ধরে রোগী দেখছেন স্বঘোষিত এই ‘চিকিৎসক’। ঢাকার বাইরেও রয়েছে তার চেম্বার। নিজ উদ্ভাবিত পদ্ধতিতে তিনি কিডনি রোগীর চিকিৎসা করেন। সেই সাথে দাবি করেন তিনি একজন ডায়াবেটিক রোগ বিশেষজ্ঞও। ভিজিটিং কার্ডে ডা. শব্দটি ব্যবহার না করলেও এই চিকিৎসকের চেম্বারের বাইরে সাইনবোর্ডে লিখে রেখেছেন ডা. সালাহ উদ্দিন মাহমুদ।

রাজধানীসহ সারা দেশেই রয়েছে এরকম অসংখ্য ভুয়া চিকিৎসক। প্রশাসনের তৎপরতায় প্রায়ই ধরা পড়ে ভুয়া ডাক্তার। র্যাব সদর দপ্তরের মিডিয়া উইং সূত্রে জানা যায়, ভুয়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে র্যাব সবসময়ই তৎপর। র্যাবের অভিযানে প্রায়ই রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ভুয়া ডাক্তার আটক করে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হচ্ছে। জানা যায়, বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল (বিএমডিসি)’র ২০১০ সালের আইন অনুযায়ী শুধুমাত্র বিএমডিসি’র  সনদ প্রাপ্তরাই নামের পূর্বে ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করতে পারবেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ভুয়া ডাক্তার তৈরির কারখানা হচ্ছে বিসিএমডিসি (কম্বাইন্ড মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ)। যা বর্তমানে এনএএমডিসি (ন্যাশনাল অল্টারনেটিভ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল, বাংলাদেশ) নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠানটি জয়েন্ট স্টকে রেজিস্ট্রেশন করে চালিয়ে যাচ্ছে ডাক্তার সার্টিফিকেট বাণিজ্য। ঢাকায় এদের প্রতিষ্ঠানটি উত্তরায় তাদেরই পরিচালিত ‘পিস ব্লেন্ড বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ থেকে ডাক্তার বানিয়ে বিএমডিসি’র মতো নিজেরাই সনদ দিত। এখানে যে কোনো শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি প্রশিক্ষণ নিয়ে হতে পারত ‘ডাক্তার’। তারা শুধু দেশিই নয় ভারত, রাশিয়া, চীনের বিভিন্ন মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিও দিত।

যদিও এই বিশ্ববিদ্যালয়টি সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এর আগেই এই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘শিক্ষা’ নিয়ে হাজার হাজার ভুয়া ডাক্তার ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। যারা নিজেদের নামের পূর্বে ডাক্তার শব্দটি ব্যবহার করে বছরের পর বছর ধরে চেম্বার সাজিয়ে রোগী দেখছেন।

এ প্রসঙ্গে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সভাপতি ডা. এম ইকবাল আর্সনাল বলেন, বিসিএমডিসি প্রতিষ্ঠানটির উপাচার্য ডা. এম এন হকসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে মামলা হয়। আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ও মালামাল ক্রোকের নির্দেশ দেয়। কিন্তুু তারপরও তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না। তিনি বলেন, সরকারের আদেশ যারা বাস্তবায়ন করবে তারা যদি কোনো উদ্যোগ না নেয় তাহলে তো জাতি অসহায় হয়ে পড়ে।

বিএমডিসি’র ভারপ্রাপ্ত রেজিস্টার ডা. মো. আরমান হোসাইন বলেন, অল্টারনেট মেডিসিনের উপর পড়াশোনা করে কেউ নামের পূর্বে ডাক্তার লিখতে পারেন না। শুধুমাত্র বিএমডিসির রেজিস্ট্রেশনধারীরাই নামের পূর্বে ডাক্তার লিখতে পারবেন। তিনি আরো বলেন, বিএএমডিসি’র সার্টিফিকেট হুবুহু বিএমডিসি’র মতো। প্রতারণার উদ্দেশ্যেই তারা এমনটা করছে।

গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর নাটোরে বাগাতিপাড়া দয়ারামপুর বাজার থেকে আশরাফুল ইসলাম নামে এক ভুয়া চোখের ডাক্তারকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেয় র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। এর আগে ১৫ নভেম্বরে পটুয়াখালির বাউফলে ১৪৪ জন ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে সমন জারি করেন পটুয়াখালি দ্বিতীয় আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ শিহাব উদ্দিন।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে র্যাব-১১ এর একটি দল কুমিল্লা জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বেশ কিছু ভুয়া ডাক্তার গ্রেপ্তার করে যাদের প্রায় সবাই পিস ব্লেন্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক্তারি সার্টিফিকেটধারী। কুমিল্লা শহরের ‘কুমিল্লা ডায়াগনস্টিক কমপ্লেক্স’ থেকে র্যাবের অভিযানে আটক করা হয় ভুয়া ডাক্তার জহিরুল ইসলামকে। তিনি ১০ বছর ধরে রোগী দেখে আসছিলেন। জহিরুল ইসলাম বিএএমডিসি থেকে সার্টিফিকেট নিয়ে চিকিৎসা সেবা দিচ্ছিলেন বলে স্বীকার করেন।

এ প্রসঙ্গে র্যাব-১১ এর তৎকালীন উপ পরিচালক মেজর তালুকদার নাজমুস সাকিব বলেন, বিএএমডিসি একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান। তারা জয়েন্ট থেকে রেজিস্ট্রেশন করেছে। কিন্তু জয়েন্ট স্টক থেকে রেজিস্ট্রেশন করে ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেওয়ার কোনো নিয়ম নেই। তিনি আরো বলেন, বিএএমডিসি ডাক্তারি সার্টিফিকেট দেওয়ার এই থিমটি পায় কোলকাতা থেকে। সেখানে এরকম ১০/১২ টি প্রতিষ্ঠান আছে। তবে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, কোলকাতায় ওইসব প্রতিষ্ঠানের কোনোটির অস্তিত্ব নেই, কোনোটি তালা মারা, কোনোটি শুধুই নামসর্বস্ব। বিএএমডিসি কোলাকাতার ওইসব প্রতিষ্ঠান থেকে সার্টিফিকেট কিনে সনদ দিয়ে নামিয়ে দিচ্ছে চিকিৎসা পেশায়।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads