• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

মহাপরিকল্পনার বাস্তবায়ন নেই কর্ণফুলি বাঁচাতে 

  • চট্টগ্রাম ব্যুরো
  • প্রকাশিত ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১

কর্ণফুলি নদী দখল-দূষণের কবলে। কর্ণফুলিতে এখন শুধু বর্জ্যই মিলবে। আবর্জনার ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে এই নদী। এর দুই পাড়ে গড়ে ওঠা কলকারখানা এবং চট্টগ্রাম নগরীর ময়লা-আবর্জনা দূষণের মাত্রা বাড়িয়েছে বহুগুণ।

সরেজমিন দেখা গেছে, নদীতে সরাসরি ফেলা হয় বর্জ্য। পানি শুকিয়ে পড়ে গেছে চর, দূষণে নিজের সৌন্দর্য হারিয়েছে চিরযৌবনা কর্ণফুলি।

বাংলাদেশ-ভারতের এই আন্তসীমান্ত নদীর গড় প্রস্থ ৪৫৩ মিটার এবং এর প্রকৃতি সর্পিলাকার। পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃক কর্ণফুলি নদীর প্রদত্ত পরিচিতি পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের নদী নম্বর-৩।

ভারতের মিজোরামের মমিত জেলার শৈতা গ্রাম (লুসাই পাহাড়) থেকে শুরু হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে চট্টগ্রামের পতেঙ্গার কাছে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে কর্ণফুলি নদী। এর মোহনায় দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম বন্দর অবস্থিত। এই নদীর দৈর্ঘ্য ৩২০ কিলোমিটার। কথিত আছে, আরাকানের এক রাজকন্যা চট্টগ্রামের আদিবাসী রাজপুত্রের প্রেমে পড়েন। এক জ্যোৎস্নাস্নাত রাতে তারা এই নদীতে নৌ-ভ্রমণ উপভোগ করছিলেন।  মিথ আছে, নদীর পানিতে চাঁদের প্রতিফলন দেখার সময় রাজকন্যার কানে গোঁজা একটি ফুল পানিতে পড়ে যায়। ফুলটি হারিয়ে কাতর রাজকন্যা সেটি উদ্ধারের জন্য পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। কিন্তু প্রবল স্রোতে রাজকন্যা ভেসে যান, তার আর খোঁজ পাওয়া যায়নি। রাজপুত্র রাজকন্যাকে বাঁচাতে পানিতে লাফ দেন, কিন্তু সফল হননি। রাজকন্যার শোকে রাজপুত্র পানিতে ডুবে আত্মাহুতি দেন। এই করুণ কাহিনী থেকেই নদীটির নাম হয় কর্ণফুলি।

মধ্যযুগীয় পুথিতে নদীটিকে কাঁইচা খাল নামে অভিহিত করা হয়েছে। মারমা আদিবাসীদের কাছে নদীটির নাম কান্সা খিওং এবং মিজোরামে কর্ণফুলির নাম খাওৎলাং তুইপুই। ১৮৮৩ সালে কর্ণফুলির মোহনায় সৃষ্টি হয় লুকিয়া চর। ১৮৭৭ সালে সৃষ্টি হয় জুলদিয়া চ্যানেল। এই চ্যানেলটি আড়াই মাইল দীর্ঘ এবং দেড় মাইল প্রশস্ত। ১৯০১ সাল থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে পতেঙ্গা চ্যানেলটি জুলদিয়া চ্যানেল থেকে প্রায় দেড় হাজার ফুট পশ্চিমে সরে যায়। হালদা নদীর সঙ্গে কর্ণফুলির সংযোগস্থলে আছে বিশাল চর, যা হালদা চর হিসেবে পরিচিত। নদীর প্রবাহের কিছু অংশ নাজিরচর ঘেঁষে, কিছু অংশ বালু চ্যানেলের মধ্য দিয়ে এবং কিছু মূল স্রোত হিসেবে প্রবাহিত হচ্ছে। ১৯৩০ সালে কালুরঘাট রেলওয়ে সেতু নির্মাণের আগে নদীর মূল প্রবাহ প্রধানত কুলাগাঁও অভিমুখে বাঁ তীর ঘেঁষেই প্রবাহিত হতো। কালুরঘাট সেতু হওয়ার পর সেতুর ডান দিকে আরো একটি প্রবাহের মুখ তৈরি হয়। ফলে নদীর মাঝপথে সৃষ্টি হয় বিশাল একটি চর- যা কুলাগাঁও চর নামে পরিচিত।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্সেস অ্যান্ড ফিশারিজ ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক অহিদুল আলম এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, কর্ণফুলি নদীতে পড়া বর্জ্য, জাহাজ থেকে নিঃসরিত তেল ও শিল্পকারখানার বর্জ্য নিঃসরণের কারণে কর্ণফুলির পানিতে সালমোনেলা, বিব্রিও, ইকোলাই, স্ট্রেপটোকক্ষাই, স্টেফাইলোকক্ষাইয়ের মতো মারাত্মক ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া বেড়ে গেছে।

কর্ণফুলি নদীর পানিতে ক্ষতিকারক বিব্রিও নামে ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ৬৭ দশমিক ২৩ শতাংশ। আর সালমোনেল ব্যাকটেরিয়ার পরিমাণ ৩২ দশমিক ৭৭ শতাংশ। এসব ব্যাকটেরিয়ার কারণে নদীর পানি ব্যবহারকারী পরিবারগুলো পানিবাহিত ডায়রিয়া, টাইফয়েড, জন্ডিসসহ নানা ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিন্তু বছরের পর বছর দূষণ হলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের এ ব্যাপারে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেই। যদিও তারা দাবি করছে, নদীদূষণ রোধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, নদীদূষণকারী প্রতিষ্ঠানকে জরিমানাও করা হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, ট্রাকে করে নদীর আশপাশে খোলা জায়গায় ময়লা ফেলা হচ্ছে। এ ছাড়া কর্ণফুলি নদীর দক্ষিণ পাড়ে গড়ে ওঠা শিল্পকারখানার বর্জ্যও নদীতে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। কর্ণফুলি উপজেলার একাধিক খালের পানির ওপরের অংশে তেলের স্তরও দেখা যায়।

পরিবেশবাদীদের মতে, কর্ণফুলিকে রক্ষায় দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ না নিলে অচিরেই এ নদী তার অস্তিত্ব হারাবে।

কর্ণফুলি নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কাপ্তাই বাঁধ তৈরি করা হয় ১৯৬৪ সালে। এই বাঁধে সঞ্চিত পানি ব্যবহার করে কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হচ্ছে।

কবি ওহীদুল আলম ১৯৪৬ সালে ‘কর্ণফুলীর মাঝি’ নামে একটি কাহিনী-কাব্য রচনা করেন। ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬২ সালে রচনা করেন তার উপন্যাস ‘কর্ণফুলী’। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম  কবিতায় লিখেছেন, ‘ওগো ও কর্ণফুলী, তোমার সলিলে পড়েছিল কবে কার কানফুল খুলি/ তোমার স্রোতের উজান ঠেলিয়া কোন তরুণী, কে জানে/ সাম্পান নায়ে ফিরেছিল তার দয়িতের সন্ধানে।’

এ ছাড়া চট্টগ্রামের ভাষার গানে এবং লোকসংস্কৃতিতে এই নদীর প্রভাব অনেক। ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি পানিত ছোড ছোড ঢেউ তুলি/লুসাই ফা-রত্তুন লামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী’। কিংবা ‘ওরে সাম্পানওয়ালা, তুই আমারে করলি দিওয়ানা’।

কর্ণফুলি নদী বাঁচাতে চূড়ান্ত করা ১০ বছরের মহাপরিকল্পনারও বাস্তবায়ন নেই। নগরের বর্জ্য এবং কলকারখানার দূষিত পানি যাতে নদীতে মিশতে না পারে, সে বিষয়েও আছে নির্দেশনা।

এছাড়া অবৈধ দখলে থাকা ভূমি কীভাবে উদ্ধার করা হবে, উদ্ধারকৃত ভূমি কীভাবে সংরক্ষণ করা হবে, এটিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে পর্যটন সুবিধা বাড়ানো যাবে, নগরের বর্জ্য কোথায় কীভাবে বিকল্প স্থানে সংরক্ষণ করা হবে-এসব বিষয়েরও দিকনির্দেশনা আছে এ মহাপরিকল্পনায়।

চট্টগ্রামের সরকারি হাজি মুহম্মদ মুহসীন কলেজের অধ্যাপক ইদ্রিস আলী দীর্ঘদিন ধরে কর্ণফুলি নদীর স্বাস্থ্য নিয়ে গবেষণা করছেন। কর্ণফুলির ওপর তার গবেষণা প্রতিবেদনটি নর্থ আমেরিকান রিসার্চ জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়, অতীতে কালুরঘাট থেকে মোহনা পর্যন্ত নদীর গড় প্রস্থ ছিল ৬০০ থেকে ৯০০ মিটার। শাহ আমানত সেতু করার সময় এবং খননের সময় প্রস্থ কমে আসে। এখন শাহ আমানত সেতু এলাকায় এর প্রস্থ ৫২০ মিটার। ২০১০ এর আগে ছিল ৯০০ মিটার।

অধ্যাপক ইদ্রিস আলী বলেন, দখলের কারণে নদীটির ভৌগোলিক অবস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর প্রস্থ কমে গেছে ৫০ থেকে ২৫০ মিটার পর্যন্ত। দখল ও দূষণের কারণে এর নাব্য এবং দৈহিক ক্ষতি হয়েছে।

২০১৯ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার কর্ণফুলি নদীর দখলকৃত স্থাপনা এবং ইজারা দেওয়া স্থানগুলো ঘুরে দেখেন। তিনি এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করে ইজারা বাতিলের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি বলেন, নদীর জায়গা ইজারা দেওয়ার এখতিয়ার কখনোই কারো ছিল না। সুপ্রিম কোর্ট সুনির্দিষ্ট করে বলেছেন, নদীর জায়গা কেউ লিজ বা হস্তান্তর করতে পারবে না। কিন্তু বন্দর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে নদীর জায়গা ইজারা দিয়েছে অবৈধভাবে। জেলা প্রশাসনও দিয়েছে। এতে সংকুচিত হচ্ছে কর্ণফুলির গতিপথ।

চট্টগ্রাম নদী ও খাল রক্ষা আন্দোলনের সভাপতি, সাদার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য ও নগর পরিকল্পনাবিদ আলী আশরাফ বলেন, বন্দর ও জেলা প্রশাসন দায়সারাভাবে দায়িত্ব সারছে। এত দিন উচ্ছেদ বন্ধ থাকবে কেন? দখলদার যতই ক্ষমতাবান বা দলীয় হোক না কেন, নদী ও বন্দর বাঁচাতে উচ্ছেদ করতে হবে। কিন্তু প্রশাসন তা করছে না, বরং জেগে ওঠা চর অবৈধভাবে ইজারা দিচ্ছে। তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। এটা মেনে নেওয়া যায় না।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads