• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ব্যবসায়ীদের দেউলিয়া করার চক্রান্ত

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেই করোনায় ক্ষতিগ্রস্তদের ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

মহামারী করোনায় লকডাউনের কারণেই মাত্র এক মাসে (২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল ’২০) বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। ওই সময় কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রতিদিন ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। এ সময় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের আমদানি-রপ্তানি। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-১৯ অর্থবছরের এপ্রিলে ৩০৩ কোটি মার্কিন ডলার রপ্তানির বিপরীতে গত বছরের (২০১৯-২০ অর্থবছর) এপ্রিলে হয়েছে মাত্র ৫২ কোটি ডলার। প্রায় ৪০০ কোটি ডলারের রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়েছে। এর বাইরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যের ক্রয়াদেশও বাতিল হয়েছে। এতে গভীর সংকটে পড়ে দেশের বিভিন্ন সেক্টর। তবে সরকারের কিছু দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে সাময়িকভাবে অর্থনীতির সেই ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হলেও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতির সেই ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেনি। অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনো লোকবল ছাঁটাই অব্যাহত রয়েছে।

এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইসহ অন্যান্য ব্যবসায়ী সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান ব্যাংকঋণের কিস্তি পরিশোধে আরো ৬ মাস সময় বাড়ানোর দাবি তুলেছে। সংকট থেকে উত্তরণে তৈরি পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র সভাপতি ড. রুবানা হক গত মাসের ৭ জানুয়ারি পোশাক খাতে সৃষ্ট সংকট নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্টদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গণমাধ্যমে খোলা চিঠি পাঠান। চিঠিতে ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা ফেরত দিতে ব্যবসায়ীদের আরো সময় দেওয়ার দাবি জানান। রুবানা হক বলেন, ‘পোশাকশিল্প আজ মর্মান্তিক পরিস্থিতির দিকে মোড় নিয়েছে। যথাযথ পুনর্গঠনের সুযোগ ও প্রস্থাননীতি না থাকা, পশ্চিমা ক্রেতাদের দেউলিয়া হওয়া এবং নির্দয়ভাবে ক্রয়াদেশ বাতিলের কারণে এ শিল্প অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে।’

কিন্তু এসব দাবিকে আমলে নিচ্ছে না কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সবার দাবি উপেক্ষা করে ব্যবসায়ীদের ব্যাংকঋণ পরিশোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানা বাধ্যবাধকতা আরোপ ও সময়সীমা বেঁধে দেওয়া ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ বলে মনে করছেন অনেকেই। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র নির্বাহী পরিচালক সিরাজুল ইসলাম বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের এক বছরের জন্য যে ছাড় দেওয়া হয়েছে সেটিই যথেষ্ট। এরপর আর কোনো সুযোগ দেওয়া সমীচীন হবে না।’

তবে অর্থনীতিবিদদের শঙ্কা, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর মনোভাবের কারণে দেশে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বাড়বে। এতে আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং রেটিংয়ে পিছিয়ে পড়বে বাংলাদেশ। অর্থনীতিবিদ এবং বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে, এখনো করোনার প্রকোপ বিশ্বজুড়ে রয়েই গেছে। এর প্রভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে আমদানি-রপ্তানিসহ সামগ্রিক অর্থনীতি। এ অবস্থায় ব্যবসায়ীদের ওপর কোনো কিছু জোর করে চাপিয়ে দেওয়া উচিত হবে না। কোনো ব্যবসায়ী দেউলিয়া হয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিলে বিরূপ প্রভাব সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর পড়বে। ব্যবসায় ক্যাশ-ফ্লো না থাকলে শেয়ারবাজার মারাত্মক হুমকির মুখে পড়বে। ফলে কর্মসংস্থান কমে গেলে বেকারত্বও বাড়বে।

এদিকে বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসও (বিএবি) তাদের আগের অবস্থান থেকে সরে এসে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নীতিমালা সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে। কিন্তু কারো কথাই আমলে নিচ্ছে না নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। তাই অনেকে মনে করছেন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে একটি মহল ব্যবসায়ীদের দেউলিয়া করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে। যারা দেশের সার্বিক উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত চায় তাদের কারণেই ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংক মালিকসহ সব পক্ষের অব্যাহত দাবিকে উপেক্ষা করা হচ্ছে।

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য

এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মীর নাসির বলেন, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে কত বছর লাগবে তা কেউ বলতে পারে না। আমাদের ক্ষতি যে কোথায় গিয়ে থামবে, তা কেউ জানি না। তাই আমরা ঋণের কিস্তি দিতে আরো সময় চাই। সময় পেলে হয়তো ঘুরে দাঁড়াতে পারব আমরা। একই দাবি তুলে বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি ও শ্রমিক নেতা ফজলুর রহমান মন্টু বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ভালো হলেও, যেসব দেশে আমরা রপ্তানি করি সেসব দেশের অবস্থা শোচনীয়। তাই আমাদের সময় দেওয়া না হলে কীভাবে ঋণের কিস্তি দেব।’

এ ব্যাপারে গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সহসভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘আমরা টাকা শোধ দিতে চাই। খেলাপির তকমা নিতে চাই না। এ কারণেই আমরা প্রণোদনা প্যাকেজ থেকে নেওয়া ঋণ দুই বছরের পরিবর্তে পাঁচ বছর সময় চাই। এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড ও চার বছরে শোধ দেওয়ার সুযোগ দেওয়া না হলে অধিকাংশ ব্যবসায়ী খেলাপি হয়ে পড়বেন। কমপক্ষে জুনের পরে আমাদের কিস্তি নেওয়া হোক।’

অর্থনীতিবিদদের মতামত

বেশ কিছু অর্থনীতিবিদও বলছেন, আগামী জুলাইয়ের পর থেকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। কারণ করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি এখনো সেভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। ব্যবসায়ীদের সুযোগ দেওয়া না হলে হিতে বিপরীত হওয়ার শঙ্কাও তাদের। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ঋণের কিস্তি পরিশোধের বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করে দিয়েছে। প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে তা জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘প্রথমত বাংলাদেশ ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার বিষয়টি একটু সহজীকরণ করার প্রয়োজন আছে। কারণ ব্যবসায়িক পরিস্থিতি এখনো খারাপ। অর্থনৈতিক অবস্থা এখনো সেভাবে স্বাভাবিক হয়নি। ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা কঠিন। ৬ মাসের মধ্যেই ঋণ ফেরত দিতে হবে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক যে বাধ্যবাধকতা নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটি অবাস্তব। কারণ ব্যবসায়ীরা ৬ মাসের মধ্যেই ঋণ পরিশোধ করে ফেলবে এটা অসম্ভব। তাই এ ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো নমনীয় হতে হবে।’

ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে ৬ মাস সময় বৃদ্ধির দাবিকে যৌক্তিক বলে উল্লেখ করেছেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী মোহাম্মদ শামস-উল-ইসলাম। বাংলাদেশের খবরকে তিনি বলেন, ‘ব্যবসায়ীদের দাবিকে আমরা ইতিবাচক হিসেবেই দেখছি। আসলে আমরা তাদের প্রতি এতটা রূঢ় হব না। কারণ এখনো করোনার থার্ড ওয়েভ চলছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। তাই ব্যবসায়ীদের দাবি যৌক্তিক। হয়তো কেউ কেউ এটি চাচ্ছেন না।’

ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়টি সরকার বিবেচনা করবে এমন প্রত্যাশা জানিয়ে শামস-উল-ইসলাম বলেন, ‘সরকার যে সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই আমরা পালন করব। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিলে আমরা বাস্তবায়নের জন্য প্রস্তুত আছি।’

সময় বাড়ানো না হলে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা প্রকাশ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকটির এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, ‘এটাই বাস্তবতা। কারণ আমরা যদি বলি যে কালকেই ঋণ পরিশোধ করে দিতে হবে সেটা যেমন ঠিক না, তেমনিভাবে যারা ঋণ পরিশোধে অনিচ্ছুক সেটিও অনুচিত।’

শুধু অর্থনীতিতেই বিপর্যয় নয়, করোনা ও করোনাকালে প্রাণ হারিয়েছেন বড় বড় অনেক ব্যবসায়ী ও শিল্পপতি। যাদের মধ্যে অন্যতম ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমান, যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল, এস আলম গ্রুপের পরিচালক মোরশেদুল আলম, পারটেক্স গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এ হাশেম, বিশিষ্ট শিল্পপতি ও আবদুল মোনেম গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল মোনেম খান, দেশের বৃহৎ বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটির কর্ণধার সফল ব্যবসায়ী ও অভিনেতা আলী যাকের,  চা শিল্পের খ্যাতিমান ব্যবসায়ী আজমত মঈন, রাজশাহীর শীর্ষ ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব শহীদুল্লাহ সেলু এবং সর্বশেষ গত ১০ ফেব্রুয়ারি সিকদার গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ ও বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা জয়নুল হক সিকদারসহ আরো অনেকে।

এছাড়া বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন অনেক কর্মকর্তাও প্রাণ হারান কোভিড-১৯-এর ছোবলে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, এসব মানুষকে হারিয়ে এমনিতেই দেশের ব্যবসায়ী পরিবার দুঃখ ভারাক্রান্ত। অথচ এমন পরিস্থিতিতে ব্যবসায়ীদের পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক খড়্গহস্ত হওয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়ছেন তারা। তাদের দাবি, দেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হলে ব্যবসায়ীদের আগে বাঁচাতে হবে। না হলে এর বিরূপ প্রভাব পড়বে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads