• বৃহস্পতিবার, ২ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ভালোবাসার রথে এলো বসন্ত

  • এস এম মুকুল
  • প্রকাশিত ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা/কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে-শ্রুতিমধুর এই গানের কথা আর সুরের মূর্ছনায় সত্যিই এসে গেছে ঋতুরাজ বসন্ত। প্রাণে দোলা লেগেছে প্রেমের মন্থনে। যদিও আজ ‘পহেলা ফাল্গুন’ ও ভালোবাসা দিবস একই সাথে। তাই আকাশে-বাতাসে আনন্দও যেন দ্বিগুণ।

তবে করোনাকালে পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস যে খুব বেশি জমবে না তা সহজেই অনুমান করা যায়। বরং মানবসভ্যতার এই কঠিনতম সময়ে আজ শপথ নেওয়ার সময় এসেছে সৃষ্টির প্রতি ভালোবাসার বন্ধন ঋদ্ধতার। করোনা মনে করিয়ে দিচ্ছে-মানবতা জাগরণের কথা। এ জীবন একাকী ভোগের নয়, বরং ত্যাগের শিক্ষাটিই বড় হয়ে উঠেছে করোনার প্রেক্ষাপটে। সৃষ্টির কল্যাণে নিবেদিত প্রেমের কথাটিই মনে করিয়ে দিয়েছে। করোনা আমাদের শিক্ষা দিয়েছে-‘হে মানুষ, এই পৃথিবী কেবল তোমার একার নয়। পশুপাখি, বৃক্ষ-লতা, জীব-জন্তু সবারই আছে এখানে বসবাসের সমান অধিকার।’ তাই আমাদের ভালোবাসা হোক সৃষ্টি কল্যাণে নিবেদিত। প্রেম কেবল প্রেমিক-প্রেমিকার নয়, নারী আর পুরুষের নয়, প্রেম হোক সৃষ্টির সৌন্দর্য রক্ষায় সকলের তরে।

তবু আজ শুরু হলো পলাশ ফোটার দিন, শিমুল ফোটার দিন। ফাগুন শুরুর দিন আজ। তারুণ্যে মননে বসন্তের বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। আজি প্রাণে প্রাণে মিলবে প্রাণ-হূদয়ে উঠিবে প্রেমের তুফান। ফুলের  সৌরভে  মেতে উঠবে চারপাশ, প্রেমহীন হূদয়ে জেগে উঠবে ব্যাকুলতার হাঁসফাঁস। সৃষ্টির চিরায়ত নিয়ম মেনে ফাল্গুন যখন আসে, চারদিকের রঙিন সাজে প্রকৃতি যেন হাসে। ফাল্গুনের উদাস হাওয়া, পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়াসহ রঙিন ফুল আর গাছে গাছে বাসন্তী রঙের কচি পাতার অপরূপ শোভায় চারদিকে রঙিন আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। এর সাথে যোগ হয় কোকিলের মন পাগল করা কুহুতান। এইসব মিলিয়ে ঋতুর রাজা বসন্তের খেতাবটি যেন প্রকৃতির রং-রূপ-রসে টইটম্বুর।

বাংলা সাহিত্যে ঋতু বসন্তের রূপ-রং-রস খুবই প্রাধান্য পেয়েছে। কবিতায়, গল্পে, গানে মনে প্রাণে দোলা দিয়েছে অমর সৃষ্টি কথা ও সুর। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন-‘ফাগুনের নবীন আনন্দে গানখানি গাঁথিলাম ছন্দে; দিল তারে বনবীথি কোকিলের কলগীতি, ভরি দিল বকুলের গন্ধে।’ তিনি আরো বলেছেন-‘ফাল্গুনে বিকশিত কাঞ্চন ফুল, ডালে ডালে পুঞ্জিত আম্রমুকুল। চঞ্চল মৌমাছি গুঞ্জরি গায়, বেণুবনে মর্মরে দক্ষিণবায়।’ আবার অন্যত্র লিখেছেন-‘মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে। মধুর মলয়-সমীরে মধুর মিলন রটাতে। কুহক লেখনী ছুটায়ে কুসুম তুলিছে ফুটায়ে, লিখিছে প্রণয়-কাহিনী বিবিধ বরন-ছটাতে।’ কবি কাজী নজরুল ইসলাম বসন্তকে চিত্রায়িত করেছেন দারুণভাবে লিখে-‘বসন্ত এলো এলো এলোরে পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহুরে মুহু মুহু কুহু কুহু তানে মাধবী নিকুঞ্জে পুঞ্জে পুঞ্জে ভ্রমর গুঞ্জে গুঞ্জে গুনগুন গানে।’ বসন্ত নিয়ে অনেক কবি লিখেছেন প্রেমময় রূপের কথা। তবে সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন—‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।’

স্বাগতম ঋতুরাজ : ঐতিহ্যগতভাবে বসন্ত উৎসবমুখর ঋতু। গানে আছে, ‘আহা আজই এ বসন্তে, কত ফুল ফোটে কত বাঁশি বাজে...’ অথবা ‘পলাশ ফুটেছে শিমুল ফুটেছে এসেছে দারুণ মাস আমি জেনে গেছি তুমি আসিবে না ফিরে মিটবে না পিয়াস’-এমন হূদয় আকুল করা গানে বেরসিক হূদয়েও যেন আবেগের সঞ্চার ঘটে। সত্যি প্রেমহীন জীবনে পিয়াস কী করে মিটবে। বসন্তকাল তারুণ্যের হূদয়কে আলোড়িত করে। এ কারণেই তরুণ-তরুণীদের কাছে প্রেম, ভালোবাসায় মায়ার বন্ধনে মিলিত হওয়ার দিন হিসেবে বসন্তের প্রথম দিনটির গুরুত্ব অনেক। ফাল্গুনের প্রথম দিনে তরুণীরা খোঁপায় গাঁদা ফুল দিয়ে বাসন্তী রঙের পোশাকে সেজেগুজে ঘুরে বেড়াবে। এই দিনে রঙে, রূপে, গানে, হইহুল্লোড়ে আজ সারাদিন কেবলই তারুণ্যের! শুধু তরুণ বা তরুণীরাই নয়, সব বয়সি নারী-পুরুষের মনে ফাল্গুন বয়ে আনে প্রেমময় আনন্দের বার্তা। এই দিনে বাসায়, অফিসে কর্মব্যস্তর নারী পুরুষেরা বসন্তের রঙের সাথে মিল রেখে পোশাক পরেন। তবে পোশাক যেমনই হোক না কেন মনের বসন্তকে ঢেকে রাখা দায় এমন দিনে। সামগ্রিকভাবে  পহেলা ফাল্গুনে বসন্ত বরণ এখন বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে। এদিনকে উপলক্ষ করে প্রচুর বাণিজ্য হয়-পোশাক, গয়না, চুড়ি, ফুলসহ নানান প্রধাসধনীর। বসন্তের আহ্বানে প্রকৃতিকে রাঙাতে ব্যস্ত পলাশ, শিমুল আর কৃষ্ণচূড়া। আজ জীবনে আর একটি বসন্তের আগমন নতুন বার্তা বয়ে আনুক এমন প্রত্যাশা প্রতিটি তরুণ প্রাণে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, বাংলা ১৪০১ সালে  প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। তরুণ-তরুণীরা বসন্তবরণের উচ্ছ্বাসে বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশের বইমেলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, শাহবাগ, চারুকলা চত্বর,  বেইলি রোড, পাবলিক লাইব্রেরি,  সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, ধানমন্ডি লেক, বলধা গার্ডেন মাতিয়ে রাখবে সারাটা দিন। চারুকলার বকুলতলায় বসন্ত বরণের উৎসবে জড়ো হবে নগরবাসী। এসব উৎসব বাংলা সংস্কৃতির আভিজাত্যকে আরো সমৃদ্ধিশালী করছে।

বদলে গেছে বাংলা বর্ষপঞ্জি : নতুন সংশোধিত বর্ষপঞ্জিতে পহেলা ফাল্গুনে হচ্ছে ভালোবাসা দিবসও। ইংরেজি বর্ষপঞ্জির ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ভালোবাসা দিবস হিসেবে পালন করা হয় সারা বিশ্বে, আর বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী বসন্তের প্রথম দিন অর্থাৎ পহেলা ফাল্গুন ছিল ১৩ ফেব্রুয়ারি। কিন্তু বাংলা বর্ষপঞ্জি সংশোধনের পর একই দিনে পড়ছে বসন্ত উৎসব আর ভালোবাসা দিবস। শুধু এই দিন নয়, ১৯৭১ সালের কয়েকটি ঐতিহাসিক দিনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তৈরি করা হয়েছে নতুন বাংলা বর্ষপঞ্জি। যার ফলে ইংরেজি দিন ঠিক থাকলেও কিছুটা এদিক-সেদিক হয়েছে বাংলা মাসের তারিখ। নতুন এই বর্ষপঞ্জিতে জাতীয় দিবসের বাংলা তারিখ এখন থেকে একই থাকবে প্রতি বছর। গত বছরের ২৮ অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদের সভায় ২০২০ সালের সরকারি ছুটির তালিকার অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর ৩০ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ছুটির তালিকা প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। এতে দেখা যায়, শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসসহ কয়েকটি জাতীয় দিবসের বাংলা তারিখে পরিবর্তন এসেছে। বাংলা একাডেমি সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশের ঐতিহাসিক দিনগুলো, যেমন ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চ, ১৬ ডিসেম্বরসহ নজরুল জন্মজয়ন্তী ও রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর বাংলা তারিখ সংশোধন করা হয়েছে। পঞ্জিকার এই সংশোধনের ফলে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতিসঙ্গী বাংলা তারিখ হবে ৮ ফাল্গুন, যা ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতেও ছিল ৮ ফাল্গুন।

তবুও আজ ভালোবাসার দিন : ভালোবাসবার জন্য পৃথক কোনো দিনক্ষণের প্রয়োজন নেই। কেননা হূদয়ঘটিত দুর্নিবার আকর্ষণে মনের মিলন ঘটে চলেছে সৃষ্টির অমোঘ নিয়মে। তবু আজ ভালোবাসার দিন-ভালোবাসা দিবস। দ্বিমত বা ভিন্নমত থাকতেই পারে, তবে সত্যটি হলো ভালোবাসার এই দিবসটি উদযাপনের পেছনে রয়েছে হূদয়ঘটিত ঘটনাচক্র বা প্রেমকাহানি। কারণ যাই হোক, ভালোবাসা প্রকাশের জন্য এ দিনটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সম্ভবত ১৪০০ শতক থেকে ভ্যালেন্টাইনস ডে উদযাপন শুরু হয় মহাসমারোহে। আবার বিপরীতে পৃথিবীর অনেক দেশে ভ্যালেন্টাইনস ডে’র বিরুদ্ধে মতবাদ গড়ে উঠছে। মুসলিম দেশগুলোতে এই দিনকে ‘ইসলাম বিরোধী আখ্যা দিয়ে তা পালন করা থেকে বিরত থাকার জন্য আহ্বান জানানো হয়’। এসব কিছুর পরও ভ্যালেন্টাইনস ডে’র জনপ্রিয়তা বাড়ছে লক্ষণীয়ভাবে।

এই দুটি দিনকে ঘিরেই সারা দেশের ফুলের দোকানগুলোতে বিক্রির ধুম পড়ে। ঋতু ফাল্গুনের সাথে ফুলের যেন অনেক মিল। রক্তলাল ফুলে ভরা শিমুল গাছ গ্র্রামীণ পরিবেশে ফাগুনের আগুন ছড়িয়ে দেয়।  লাল টকটকে  এসব উজ্জ্বল থোকা থোকা ফুলের ডালে বুলবুলি, শালিক বসে এর সৌন্দর্যকে আরো উপভোগ্য করে তোলে। ফাল্গুনে ফোটা ফুলের তালিকার আরো যেসব নাম উল্লেখযোগ্য-কাঞ্চন, কনকলতা, পলাশ, শিমুল, কৃষ্ণচূড়া, মাধবীলতা, জুঁই, বকুল, কাঠচাঁপা, করবী, মুচুকুন্দ, কনকচাঁপা, স্বর্ণচাঁপা, নাগকেশর,  দেবকাঞ্চন, পারিজাত, পানিয়া মাদার, টগর, ভাঁটিফুল প্রভৃতি। আমাদের দেশে শীত শেষে যেমন  শিমুল, পলাশ আর দেবকাঞ্চন ফুলের অপরূপ শোভা দেখে হূদয়ের আকুলতা বেড়ে যায়, ঠিক তেমনি ইউরোপের দেশগুলোতে শীত শেষে চেরি ফুলের স্ফুরণ  যেন অপার্থিব আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads