• রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

পথশিশু পুনর্বাসন প্রকল্পেও দুর্নীতি

মনিটরিংয়ের অভাব : টিআইবি

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২১

পথই যাদের ঠিকানা, পথেই কেটে যায় পুরো জীবন, তারাই পথশিশু। শিশুরা যত ধরনের ঝুঁকির মধ্যে থাকতে পারে, তার সবই আছে পথশিশুদের। অপরাধীচক্র এদের মাদকসহ নানা অবৈধ ব্যবসায় ব্যবহার করে। কিন্তু এরা অপরাধী নয়। এরা অপরাধের শিকার। রাজনৈতিক দলগুলোও অনেক সময় তাদের নানা কাজে ব্যবহার করে।

এদের জীবন মান উন্নয়নের সরকার পথশিশু পুনর্বাসন প্রকল্পে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। কিন্তু প্রকল্পে বরাদ্দ পাওয়ার অর্থ কোথায়, কিভাবে ব্যয় হচ্ছে তার সঠিক হিসাব নেই সংশ্লিষ্টদের কাছে। ফলে দিন দিন বাড়ছে পথশিশুদের সংখ্যা। 

 ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু জন্মদিন ১৭ মার্চকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেন। ১৯৯৭ সালের ১৭ মার্চ দিবসটি পালন করা শুরু হয়। মূলধারা থেকে ঝরেপড়া শিশুদের যোগ্য নাগরিক করে গড়ে তোলাই দিবসটির তাৎপর্য। ২০২১ সালের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রম এবং ২০৩০ সালের মধ্যে পথশিশুসহ সব ধরনের শিশুশ্রম বন্ধের পরিকল্পনা সরকারের রয়েছে। সেই লক্ষ্যমাত্রায় সরকার অনেকখানি কাঠামোগতভাবে এগিয়েছে। অর্থাৎ এটা করার জন্য সরকারের যে ধরনের আইন-কানুন, নীতিমালা দরকার, যেমন: একটা জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতিমালা রয়েছে। ২০১০ সালের ওই নীতিমালার আলোকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত একটি কর্মপরিকল্পনা রয়েছে। জাতীয় পরিকল্পনা ২০২১ সাল পর্যন্ত এবং সমপ্রতি সরকারি অর্থায়নে একটি অর্থনীতি প্রকল্প রয়েছে। আসলে কাঠামোগতভাবে এ ব্যাপারটি যেভাবে এগিয়েছে, বাস্তবে তদরকির অভাবে এ প্রকল্পের কাজগুলো তেমন অগ্রসর হয়নি। বরং প্রকল্পের বরাদ্দের অর্থে হচ্ছে হরিলুট।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট (বিআইডিএস) ও ইউনিসেফের গবেষণা অনুযায়ী, দেশে ৯ লাখ ৭৯ হাজার ৭২৮ জন পথশিশু রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা শহরে রয়েছে ৭ লাখ পথশিশু। চলতি বছর শেষে সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১২ লাখ। আর ২০২৪ সাল নাগাদ এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৩৩০ জনে। অন্য একটি হিসাবে, বাংলাদেশে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা এখন প্রায় ৭৯ লাখ। আর এ শিশুদের প্রায় ৪৫ লাখ ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত। এসব শিশু শ্রমিকের মধ্যে ৬৪ লাখ গ্রামাঞ্চলে এবং বাকি ১৫ লাখ শহরে বিভিন্ন পেশায় কাজ করে।

এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর পথশিশুদের সুরক্ষা ও অধিকার বিষয়ক জরিপ থেকে জানা যায়, ঢাকা শহরে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখের বেশি। যাদের ৭৫ শতাংশই বাস করে বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও ফুটপাতে। প্রায় ৪১ শতাংশ শিশুর রাতে ঘুমানোর কোনো বিছানা নেই, ৪০ শতাংশ শিশু প্রতিদিন গোসল করতে পারে না, ৮০ শতাংশ পথশিশু কোনোমতে খাবার জোগাড়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের কাজ করে, অসুস্থ হলে ৫৪ শতাংশ শিশুর দেখাশোনার কেউ নেই, অর্থের অভাবে ৭৫ শতাংশ পথশিশু ডাক্তারের কাছে যেতে পারে না, ৮৭ শতাংশ টয়লেট সুবিধা পেতে অর্থ ব্যয় করে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে পথশিশুদের ওপর অ্যাপ্রোপ্রিয়েট রিসোর্স ফর ইমপ্রোভিং স্ট্রিট চিলড্রেন্স এনভায়রনমেন্ট (অ্যারাইজ) প্রকল্পের জরিপে জানা যায়-বাংলাদেশের ৭৫ ভাগ পথশিশু রাজধানীতে, ৯ দশমিক ৯ ভাগ চট্টগ্রামে ও ২ দশমিক ৫ ভাগ সিলেটে বাস করে। পথশিশুদের মধ্যে শতকরা ৫৩ ভাগ ছেলে আর ৪৭ ভাগ মেয়ে।

সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, পথশিশুদের পুনর্বাসনের জন্য চাইল্ড সেনসেটিভ সোশাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) নামে একটি প্রকল্প রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বরিশালে ৬টি ড্রপ ইন সেন্টারের মাধ্যমে নেশায় আসক্ত শিশুদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনের চেষ্টা করা হয়।

এদিকে পথশিশু পুনর্বাসনে সরকারের দেয়া ৪ কোটি ৪০ লাখ টাকার কোনো হিসাব নেই পুনর্বাসন কেন্দ্রের কর্মকর্তাদের কাছে। সরকারের বরাদ্দ থাকলেও এসব প্রকল্পের সুবিধা ঠিকভাবে পাচ্ছে না ছিন্নমূল শিশুরা। মূলত জবাবদিহি ও তদারকির অভাবেই এ ধরনের কার্যক্রম প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিতে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে এ ধরনের উদ্যোগে অনিয়ম রোধ করা না গেলে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য অধরা থেকে যাবে। 

বাবা মারা যাওয়ার পর আট বছর বয়সী তারেকের দিন কাটে পথে পথে। চেষ্টা একটাই, বেঁচে থাকার জন্য দু’বেলা খাবার জোগাড় করা। কমলাপুরের এই প্ল্যাটফর্মে এমন অনেক শিশু খুঁজে পাওয়া যাবে, যাদের প্রতিটি দিন, প্রতিটি মুহূর্ত কাটে চরম দুর্দশায়। জানে না তাদের পিতা-মাতাকে। নিজ ধর্ম কি, তাও জানেনা এসব শিশুরা। 

এ অবস্থায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়তে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি নানা প্রকল্প। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে মাত্র কয়েক গজ দূরেই রয়েছে সরকারি আশ্রয় কেন্দ্র। পথশিশুদের অভিযোগ, সেখানে গেলে ঢুকতে দেওয়া হয় না তাদের। তার প্রমাণ মিলল মাঠ পরিদর্শন করতে আসা এক কর্মীর সঙ্গে পথশিশুদের বাকবিতণ্ডা দেখেই।

আশ্রয় কেন্দ্র দুটিতে নিত্যদিনের খরচ দেখতে চাইলে কোনো কাগজই দেখাতে পারেননি তারা। এ বিষয়ে জানতে চাইলে যোগাযোগ করতে বলা হয় কার্যক্রমের কনসালট ম্যানেজার শাহ আলমের সঙ্গে। বেশ কিছুদিন ঘুরে তার নাগাল পাওয়া গেলেও বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে রাজি হননি তিনি। 

অনুসন্ধানে গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের পুনর্বাসনে বিভিন্ন খরচে হচ্ছে অনিয়ম-দুর্নীতি। প্রতিদিন শিশুদের দুপুরের খাবার খরচ বাবদ সরকারি বরাদ্দ ১৩০ টাকা। তবে কত টাকা খরচ করা হয় সেই হিসাব জানতে চাইলে কেউ মুখ খুলতে রাজি হননি।

এ বিষয়ে পথশিশু পুনর্বাসন কার্যক্রমের পরিচালক ডা. আবুল হোসেন বলেন, এত হিসাব তার পক্ষে রাখা সম্ভব নয়। ৫ মাসের বাড়ি ভাড়া, প্রোগ্রাম বাবদ খরচ ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা। তবে এ প্রকল্প  পুনর্বাসন কেন্দ্রের গত তিন বছরের কোনো হিসাবের ফাইল বা কাগজ দেখাতে পারেননি। আর হাতে কলমে যে হিসাব তিনি তাৎক্ষণিক দিয়েছেন, তার সঙ্গেও মিল নেই বাস্তবের।

এ হিসাবের খোঁজে সরকারি হিসাব ভবনে গিয়েও মেলেনি হিসাব সংক্রান্ত কোনো তথ্য। তারা বলছেন, সব নথি প্রোগ্রাম পরিচালকের কাছে। এসব বিষয়ে বারবার যোগযোগ করা হলেও কথা বলতে রাজি নন সচিবসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা।

এদিকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় পথশিশুদের পুর্নবাসনে আরো একটি প্রকল্প টঙ্গীতে ‘শেখ রাসেল শিশু পুর্নবাসন কেন্দ্রে’ যোগাযোগ করা হলে এ বিষয়টি নিয়ে কেউ মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালমা আক্তার বলেন, সরকারের বরাদ্দ থাকলেও প্রকল্পের সঠিক বাস্তবায়ন ও দেখভালের অভাবে এসব শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে নানা অপরাধ ও শিশুশ্রমে, যা সমাজের জন্য অশনিসংকেত। পথশিশুরা পথে থাকলে আমরা তিনটা এসডিজি সরাসরি ফেল করব। সরকারের ভিশন পূরণ করা অসম্ভব হয়ে পড়বে এবং ১০ বছর পর এই শিশুরাই দেশের বোঝা হবে, তারা বিভিন্ন সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়বে। এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য হচ্ছে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করা আর সেটাই যদি আমরা না পারি তাহলে অর্থনৈতিকভাবেও আমরা ক্ষতির সম্মুখীন হব।

শশু সুরক্ষা ও শিশু অধিকার বিষয়ক সুশাসন (সেভ দ্য চিলড্রেন)-এর পরিচালক আবদুল্লা আল মামুন বলেন, পথশিশুদের যোগ্য নাগিরক হিসাবে গড়ে তুলতে কাঠামোগতভাবে যেভাবে এগোচ্ছে, সেটুকু অনেক আশা জাগায়। কিন্তু শিশুশ্রম নিরসনে একটা জায়গায় মনে হয় আমরা কম গুরুত্ব দিচ্ছি। পথশিশু পুর্নবাসনে সরকারের কঠোর তাদরিকে নেই। ফলে এসব প্রকল্পেও আমরা অনিয়াম দুর্নীতির তথ্য পাচ্ছি। এগুলো কাঠোরভাবে তদারকি না হলে পুরো প্রকল্পের উদ্যেশ্যই ভেস্তে যাবে।  

তিনি মনে করেন, সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে সারাদেশের যেখানে যত পথশিশু রয়েছে, তাদের জন্য নিরাপদ আবাসন করা দরকার। প্রথমেই থাকার ব্যবস্থা এবং তাদের বয়সোপযোগী শিক্ষা এবং তারা যেন একটা বয়সে যখন বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী কাজ করার সুযোগ আছে, সেখানে সেই বয়স হলে তাদের ভোকেশনাল ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে একটা জব, যা কোনোরকম ঝুঁকিপূর্ণ নয়, এমন একটি কাজের সঙ্গে যুক্ত করা।  

পথ শিশুদের নিয়ে কাজ করছে লোকাল এডুকেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট (লিডো) নামের একটি এনজিও। সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফরহাদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে পথশিশুদের পুনর্বাসনে গৃহীত পদক্ষেপগুলো বাস্তবে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। পুনর্বাসন সংস্থার অধীনে থাকা শিশুরা হয়তো মূলধারায় গিয়ে যুক্ত হয়। কিন্তু এর বাইরে যারা থাকে, তাদের কেউ কেউ মাদকাসক্ত হয়ে রাস্তায়ই মারা যায়। কেউ কেউ চক্রের মাধ্যমে পাচার হয়ে যায়। যারা পাচারের শিকার হয়, তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি হওয়ার তথ্যও পাওয়া যায়। নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হয় এসব শিশুরা। আর যারা মেয়ে, তারা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কোনো কোনো গ্যাং তাদের যৌনকর্মী হতে বাধ্য করে। তাই এ সব বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে পথশিশু প্রকল্পগুলোর কাজ পরিচালনা করতে হবে। নইলে নামমাত্র প্রকল্পের টাকা অবৈধভাবে চলে যাবে। যার কাজে কাজ কিছুই হবেন।

টিআইবি নির্বাহী পরিচালক ডা. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সঠিক মনিটরিংয়ের অভাবেই এসব কার্যক্রমের অর্থ পৌঁছাচ্ছে না সুবিধাবঞ্চিতদের কাছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে সরকারি দুর্নীতি প্রতিরোধের পরামর্শ তার।

তিনি বলেন, সবকিছুর মধ্যেই এখানে অনিয়ম এক ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করেছে এবং সেটির সুযোগটা যারা এর সাথে জড়িত তারা করে নিয়েছেন। যেহেতু সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পরিবীক্ষণ এবং নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি সেহেতু এটা চলছে এভাবেই। আমি মনে করি এখানে এক ধরনের যোগসাজশ চলছে। যারা করছে এসব তাদের সাথে সহায়ক অনেক শক্তি রয়েছে। তারা এর থেকে সুবিধাটা পাচ্ছে। কাজেই তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads