• রবিবার, ১২ মে ২০২৪, ২৯ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

ভাষা আন্দোলন ও শহীদকথা

  • ডেস্ক রিপোর্ট
  • প্রকাশিত ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২১

১৯৪৭ সালে দেশভাগের অব্যবহিত পরেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু না বাংলা-এ প্রশ্নে উত্তাল হয়ে ওঠে সদ্য স্বাধীন হওয়া সমগ্র পাকিস্তান। সেসব আজ ইতিহাস। এই দুর্বার আন্দোলন শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান পরিবর্তনসাপেক্ষে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভের মধ্য দিয়ে শেষ হয়। কিন্তু এই পথ মসৃণ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তের কারণে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা নগরীর রাজপথ কাঁপিয়ে তোলে ছাত্র-জনতা, শিক্ষক, সুশীলসমাজসহ নানা পেশার মেহনতি মানুষ। ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তান সরকারের তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মুসলিম লীগ প্রাদেশিক সরকার আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালালে সেদিন হতাহত হয় অনেক মানুষ। আজ সেই ভাষাশহীদদের কথা তুলে ধরা হলো।

শহীদ আব্দুস সালাম : ১৯২৫ সালের ২৭ নভেম্বর ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। পারিবারিক অভাব-অনটনের কারণে খুব বেশি লেখাপড়া করতে পারেননি। পরে ৮৫ দিলকুশায় অবস্থিত ‘ডাইরেক্টরেট অব ইন্ডাস্ট্রিজ’-এ করণিক পদে চাকরি করতেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার আন্দোলনে তিনি অংশ নেন এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে গুলিবিদ্ধ হন। প্রায় দেড় মাস অচেতন অবস্থায় থেকে ১৯৫২ সালের ৭ এপ্রিল তিনি মারা যান।

শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ : ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর মানিকগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পরে ঢাকায় পিতার সাথে প্রেস পরিচালনায় যোগ দেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বিক্ষোভ মিছিলে তিনি যোগ দেন। কিন্তু পুলিশের লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসের কারণে তিনি অন্যদের সাথে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে আশ্রয় নেন। এ সময় পুলিশের একটি গুলি সরাসরি রফিক উদ্দিনের মাথায় লাগলে সাথে সাথেই তার মৃত্যু হয়। সম্ভবত একুশের প্রথম শহীদ হওয়ার মর্যাদা রফিক উদ্দিন আহমদই লাভ করেন।

শহীদ আবুল বরকত : ১৯২৭ সালের ২৬ জুন অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মুর্শিদাবাদ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর ১৯৪৮ সালে আবুল বরকত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির দিন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় দাঁড়িয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতাকে উৎসাহ দিচ্ছিলেন। এ সময় মিছিলে ছোড়া একটি গুলি তার গায়ে এসে লাগে এবং তিনি মাটিতে পড়ে যান। আহত আবুল বরকতকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তারদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে রাতে তিনি মারা যান।

শহীদ আব্দুল জব্বার : ১৯১৯ সালে ময়মনসিংহ জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের পর দারিদ্র্যের কারণে তিনি পিতার কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেন। পরে আব্দুল জব্বার দৈনন্দিন ব্যবহূত জিনিসপত্রের একটি দোকান দেন। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি ক্যানসারে আক্রান্ত শাশুড়ির চিকিৎসায় ঢাকা মেডিকেল কলেজে আসেন। ২১ ফেব্রুয়ারির দিন তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে ছাত্র-জনতার মিছিলে অংশ নিয়ে স্লোগান দেন। মিছিলে পুলিশের অতর্কিত গুলিবর্ষণে তিনি আহত হন। সারাদিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে রাতে আব্দুল জব্বার মারা যান।

শহীদ শফিউর রহমান : ১৯১৮ সালে ২৪ জানুয়ারি অবিভক্ত ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হুগলী জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। শফিউর রহমান কলকাতা গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে বাণিজ্য বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। পারিবারিক কারণে আর লেখাপড়া না হওয়ায় তিনি ঢাকা হাইকোর্টে করণিক পদে চাকরি নেন। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমান সাইকেলে চড়ে ৬নং রঘুনাথ দাস লেনের বাসা থেকে অফিসের উদ্দেশে রওনা হন। ঐ সময় বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে নওয়াবপুর সড়কে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভ চলছিল। পুলিশ ঐ বিক্ষোভে গুলি চালালে একটি গুলি তার পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে বের হয়ে যায় এবং তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সন্ধ্যায় শফিউর রহমান হাসপাতালে মারা যান।

শহীদ অহিউল্লাহ : ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদদের তালিকায় নয় বছরের একজন বালক রয়েছে, যার নাম অহিউল্লাহ। তার পিতা ছিলেন পেশায় একজন রাজমিস্ত্রি। ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি যখন নওয়াবপুর সড়কে ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে পুলিশ গুলি চালায়, তখন খোশমহল রেস্টুরেন্টের সামনে দাঁড়ানো অহিউল্লাহর মাথায় এসে গুলি লাগে। ফলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ কাগজে অহিউল্লাহর শহীদ হওয়ার খবর প্রকাশিত হয়। পুলিশ অহিউল্লাহর মরদেহ গুম করায় তার কবরের কোনো খোঁজ মেলেনি।

আবুল বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার—এসব তরতাজা প্রাণ সেদিন জীবন দিয়েছিলেন বলেই আজ আমরা মায়ের ভাষা বাংলায় কথা বলতে পারছি। এসব শহীদ ভাষাসৈনিক চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে আছেন আজিমপুর কবরস্থানে। ঐসব বিদেহী আত্মার প্রতি রইল সশ্রদ্ধ সালাম। 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads