• শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জৈষ্ঠ ১৪২৯

জাতীয়

মৎস্য চাষ বৃদ্ধি প্রকল্পে লুটপাট!

ঘুষ লেনদেন ১৫ থেকে ৩০ ভাগ

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০২ মার্চ ২০২১

জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য চাষ বৃদ্ধি প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। খোদ মৎস্য অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কয়েক কর্মকর্তা প্রকল্পের অর্থ লুটপাটে জড়িত। প্রকল্প পাস ও বরাদ্দসহ প্রকল্পভুক্তির ক্ষেত্রে ১৫ থেকে ৩০ শতাংশ ঘুষ লেনদেন হয়েছে। প্রকল্প পরিচালকের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ঘুষের টাকা গ্রহণের সত্যতা খুঁজে পেয়েছে দুর্নীতি দমন কশিন (দুদক)। এরই মধ্যে প্রকল্পটিতে বরাদ্দকৃত ৪০৯ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ২১৮ কোটি টাকা।  কিন্তু কাজের আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। জানা যায়, সরকার ২০১৫ সালে দেশে জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প চালু করে। সফলতার আশায় কাল বিলম্ব না করেই ২০১৫-১৬ অর্থবছরেই প্রকল্পটির জন্য বরাদ্দ দেয় সরকার। কিন্তু ওই অর্থবছরে প্রকল্পের কাজের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়ায় কয়েক দফায় প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধি হয়েছে। সর্বশেষ চলমান অর্থবছরে প্রকল্পটি আগামী ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি এবং প্রকল্পের আওতা ও বরাদ্দও বাড়ানো হয়েছে। প্রকল্পের লক্ষ্যমাত্রা প্রায় দুই হাজার ৬০০ হেক্টর জলাশয় সংস্কার করে কর্মসংস্থানের পাশাপাশি ১০ লাখ টন মাছ উৎপাদন। পার্বত্য তিন জেলা ছাড়া দেশের সব জেলাতেই প্রকল্পটি চলমান। কিন্তু এ পর্যন্ত প্রকল্পের প্রায় অর্ধেক কাজ সম্পন্ন হয়েছে। অর্থাৎ ইতিমধ্যে প্রকল্পের এক হাজার ৩০০ হেক্টর জলাশয় সংস্কার হয়েছে। সমপরিমাণ কাজ এখনো বাকি রয়েছে। এ অবস্থায় আগামী বছরের জুন মাসের মধ্যে বাকি কাজ সম্পন্ন হওয়া নিয়ে সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।  

সূত্র জানায়, উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের একটি কমিটির জলাশয় সংস্কারে মৎস্য চাষ বৃদ্ধি প্রকল্পে প্রকল্পভুক্তির জন্য সরকারি খাস এবং প্রাতিষ্ঠানিক জমি প্রকল্পে হস্তান্তর ও গ্রহণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। আর জেলা মৎস্য কর্মকর্তার মাধ্যমে চাহিদা অনুযায়ী বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রকল্পটি ঘিরে নানা অভিযোগ ওঠে। তার মধ্যে রয়েছে কোনো প্রকল্প প্রকল্পভুক্তির ক্ষেত্রেই মোটা টাকা গুনতে হয়। তা ছাড়া অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক জেলা মৎস্য কর্মকর্তাকে এড়িয়ে আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে সরাসরি ঠিকাদারের হাতে প্রকল্পের বরাদ্দপত্র তুলে দিয়েছেন বলে জানা যায়। তার পর প্রকল্প পাস ও বরাদ্দর জন্য ১৫ শতাংশ নগদ ও বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রকল্পের আওতাধীনে কালভার্টের বরাদ্দর ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ, পানি সেচের বরাদ্দে ২০ শতাংশ, গাছ লাগানোর বরাদ্দে ৩০ শতাংশ, মাছ চাষের প্রদর্শনীর জন্য ৩০ শতাংশ হারে টাকা আদায় করা হয়। পাশাপাশি প্রকল্প চলমান অবস্থায় প্রতিটি জেলার প্রকৌশলীদের মাধ্যমে আরো ১৫ শতাংশ টাকা হাতিয়ে নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। আর প্রকল্পের সর্বশেষ চেক প্রদানের সময় প্রকৌশলী অডিট বাবদ ১ দশমিক ৫ শতাংশ, সাংবাদিক ও দুদক ম্যানেজের নামে দশমিক ৫ শতাংশ, কর্মকর্তার নিজের খরচ বাবদ দশমিক ২৫ শতাংশ করে টাকা আদায়েরও অভিযোগ পাওয়া যায়।

সংশ্লিষ্ট সূত্র আরো জানায়, প্রকল্পের আওতায়ভুক্ত জলাশয় সংস্কারে ক্ষেত্রে কতগুলোভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়। তার মধ্যে জলাশয় সংস্কারে ১০ লাখ বর্গমিটার পর্যন্ত মাটি কাটার ক্ষেত্রে কোটেশন হবে এবং সে ক্ষেত্রে প্রতি বর্গমিটার মাটি টাকার খরচ ধরা হয়েছে ১২৪ টাকা। ২০ লাখ বর্গমিটার পর্যন্ত মাটি কাটতে মাস্টার রোলে লেবার এবং তার বেশি হলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হবে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাস্টার রোলে মাটি না কাটিয়ে যন্ত্রের সাহায্যে কম খরচে মাটি কেটে মাস্টার রোলের নামে বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়া হয়। এমনকি কোনো কোনো প্রকল্পে নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে কম কাজ করেও অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ছিল ওপেন সিক্রেট।

মৎস্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বাড়াতে সরকার গৃহীত প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বিপুল টাকা। প্রকল্পে তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রেই অর্থ গুনতে হয়েছে। দুদক ও সাংবাদিক ম্যানেজের নামেও আদায় করা হয় টাকা। প্রকল্পের লুটপাটে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও প্রকল্প পরিচালকসহ উচ্চপদস্থ একাধিক কর্মকর্তার জড়িত। বিধান অনুযায়ী এমন একটি প্রকল্পের পরিচালক চতুর্থ গ্রেডের বিভাগীয় পর্যায়ের একজন কর্মকর্তার হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন নন-ক্যাডার ৫ম গ্রেডের একজন প্রকৌশলী। তা ছাড়া ইতিপূর্বে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগে মামলাও হয়েছে এবং তিনি ৭ বছর সাসপেন্ড ছিলেন। জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য চাষ বৃদ্ধি প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনেও  একাধিক অভিযোগ পড়েছে।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে তদন্ত হয়েছে। তবে অধিদপ্তরের তদন্তে নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ অধিদপ্তরের তদন্তে প্রকল্প পরিচালকের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ঘুষের টাকা গ্রহণের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ওই তদন্তে শুধু এক পক্ষের বক্তব্যের ভিত্তিতেই প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। অন্য পক্ষের কোনো বক্তব্যই নেওয়া হয়নি। অবশ্য দুদকের অনুসন্ধান এখনো অব্যাহত রয়েছে। তবে শিগগিরই দুদক তাদের অনুসন্ধান প্রতিবেদন দাখিল করবে বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে দুদকের একজন পরিচালক জানান, প্রকল্পে আরো নতুন নতুন পদ্ধতিতে অর্থ লুটপাটের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। এর সঙ্গে সরাসরি প্রকল্পের পরিচালকের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এ ছাড়া মৎস্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের এ কাজে সংশ্লিষ্টতা থাকতে পারে বলেই বিষয়টি অধিকতর অনুসন্ধান চলমান। ব্যাপক অনুসন্ধান শেষে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হবে। 

এ প্রসঙ্গে জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. আলীমুজ্জামান চৌধুরী প্রকল্পের দুর্নীতির কথা অস্বীকার করে বলেন, কিছু অনিয়ম হয়তো হয়েছে তবে কোনো দুর্নীতি বা অর্থ লুটপাট হয়নি। তা ছাড়া আমার একার পক্ষে তো সারা দেশের প্রকল্পগুলোর দিকে নজর রাখা সম্ভব নয়। আর মাটি কাটার শ্রমিক সংকটে কোনো কোনো ক্ষেত্রে হয়তো যন্ত্রের মাধ্যমে মাটি কাটা হয়েছে। কিন্তু কীভাবে মাটি কাটা হলো তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাটি কাটা হয়েছে কি না। নিয়ম মেনেই প্রকল্পভুক্তির কাজ হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads