• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯

জাতীয়

গোপন গর্ভপাতে বাড়ছে মৃত্যু

অপব্যবহার হচ্ছে এমআর চিকিৎসা পদ্ধতির

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ১৬ মার্চ ২০২১

আমাদের দেশে গর্ভপাতের হার আশংকাজনক হারে বাড়ছে। গর্ভপাত আইনত নিষিদ্ধ হওয়ায় গোপনেই এটা হচ্ছে। এতে নারীদের জীবন নিয়ে শংকা বাড়ছে। গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে মৃত্যু হলেও অনেক সময়ই তা গোপান রাখা হচ্ছে। ফলে কি সংখ্যাক নারী গর্ভপাত ঘটান এবং এ কারণে মারা যাচ্ছেন তার প্রকৃত চিত্র জানা যায় না।

তবে যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গুটমাকার ইনস্টিটিউটের জরিপ বলছে, ২০১০ সালে দেশে ছয় লাখ ৪৬ হাজার ৬০০টি গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে। ২০১৪ সালে সংখ্যাটি প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয় ১১ লাখ ৯৪ হাজার। বর্তমানে এ সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়েছে।  ২০১০ সালে গর্ভবতীদের মধ্যে প্রতি হাজারে গর্ভপাত করান ১৮ দশমিক ২ জন-যাদের বয়স ১৫ থেকে ৪৯ বছরের মধ্যে। বর্তমানে এই সংখ্যা পূর্বের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি। এটা শুধু খাতা-কলমের হিসাব। এর বাইরে দেশে প্রতিদিন অসংখ্য গর্ভপাতের ঘটনা ঘটে যেগুলোর কোনো হিসাব থাকে না। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে আগের চেয়ে গোপন গর্ভপাতের সংখ্যা বেড়েছে অনেক। শুধু গর্ভধারণ করা নারী নন, আইনি বিধিনিষেধের কারণে বিষয়টি গোপন রাখছেন গর্ভপাত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসাকর্মীরাও। একইসঙ্গে অনিরাপদ গোপন গর্ভপাতে জীবন সংকটে পড়ছেন অসংখ্য নারী। সামাজিক ও আইনগত জটিলতা এড়াতে অনেকেই গোপনে গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলে দেন নবজাতককে।

দেখা যায়, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণের পর হাতুড়ে চিকিৎসক, কবিরাজ, অদক্ষ স্বাস্থ্যকর্মীর কাছে গর্ভপাত করাতে গিয়ে অনেকেরই মৃত্যু হচ্ছে। কেউ কেউ আবার প্রাণে বেঁচে গেলেও ভুগছেন দীর্ঘ শারীরিক জটিলতায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, জন্মনিরোধক ব্যবহার বা পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি থাকলেও গর্ভবতী হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে। এমন পরিস্থিতিতে গর্ভপাতকে বেছে নেন অনেকে।

আমাদের দেশে এমআর চিকিৎসা পদ্ধতি ১৯৭২ সাল থেকে সরকার স্বীকৃত। তবে আইনি জটিলতা এড়াতে অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ক্লিনিকে অনুমোদিত নির্ধারিত সময়ের বাইরের গর্ভপাতকেও এমআর হিসেবে দেখানো হচ্ছে। অনেক সময় ডিঅ্যান্ডইঅ্যান্ডসি (ডাইলেটেশন অ্যান্ড ইভাকুয়েশন অ্যান্ড কিউরেটেজ) পদ্ধতি ব্যবহারের প্রয়োজন হলেও এমআরের মাধ্যমেই ঘটানো হচ্ছে গর্ভপাত। জীবন বাঁচানোর শর্ত অনুসরণের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চলছে গর্ভপাত।

পরিচ্ছন্নতাকর্মী রেহানা চলতি বছরের ১৫ ফেব্রুয়ারি বিমানবন্দর সড়কের বলাকা ভবন লাগোয়া ঝোপঝাড় পরিষ্কারে ব্যস্ত। হঠাৎ দেখে ঝোপের ভেতরে পড়ে আছে দু-তিন দিনের এক নবজাতক। খবর পেয়ে পুলিশ সদস্যরা ওই নবজাতককে উদ্ধার করে ভর্তি করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। বর্তমানে শিশুটির ঠিকানা আজিমপুরের সরকারি দিবাযত্ন কেন্দ্র ছোটমনি নিবাস।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, গত ছয় মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে উদ্ধার হয়েছে পরিত্যক্ত ৩০ নবজাতক। ফেলে দেওয়া নবজাতকদের অনেককে উদ্ধার করা হয়েছে মৃত বা অর্ধমৃত অবস্থায়। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য দায়ী করেছেন, অপরিকল্পিত অথবা অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণকে। তারা বলছেন, সামাজিক ও আইনগত জটিলতা এড়াতে অনেকেই গোপনে গর্ভপাত ঘটিয়ে ফেলে দেন নবজাতককে।

রাজধানীর গুলশানের এক নারী দেবরের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কের এক পর্যায়ে গর্ভবতী হন। বাসার পাশে এক বেসরকারি ক্লিনিকে গিয়ে তিনি গর্ভপাত করান। এর দুদিন পর জরায়ু থেকে রক্তপাত শুরু হয়। অবস্থা খারাপ হতে থাকলে সে তার বান্ধবীকে বিষয়টি জানান। ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। চিকিৎসার এক পর্যায়ে তিনি মারা যান। 

আইনে অন্তঃসত্ত্বার জীবন বাঁচানোর মতো পরিস্থিতি ছাড়া অন্য যে কোনো ক্ষেত্রে গর্ভপাতের ওপর আইনি বিধিনিষেধ থাকলেও ১৯৭২ সাল থেকে সরকারস্বীকৃত এমআর (মিন্সট্রুয়াল রেগুলেশন) পদ্ধতি চালু আছে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে কুমুদিনী উইমেন্স মেডিকেল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বিলকিস বেগম চৌধুরী বলেন, আগে এমআর করার সর্বোচ্চ সময়সীমা ছিল আট সপ্তাহ। এখন ১২ সপ্তাহ। প্রতিটি সরকারি হাসপাতালেই এমআরের আলাদা বিভাগ আছে। প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকগুলোও বৈধভাবেই এমআর করছে। বর্তমানে গর্ভপাত করাতে যারা আসছেন তাদের মধ্যে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণীর সংখ্যা বেশি  বলেও জানান তিনি। লোকলজ্জার ভয়ে এ ধরনের তরুণীরা গোপনে বিভিন্ন ক্লিনিকে গিয়ে গর্ভের ভ্রণ নষ্ট করেন। তিনি বলেন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি সঠিকভাবে ব্যবহার করলে এমআর কমে আসবে। আমরা তাই এখন এমআর নিরুৎসাহিত করি। সঠিকভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহারের পরামর্শ দেই, উৎসাহিত করি।

তবে এই এমআর আর সাধারণ গর্ভপাতের মধ্যে একটি বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে বলে জানান, দুস্থ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের (ডিএসকে) যুগ্ম -পরিচালক (স্বাস্থ্য) কল্লোল চৌধুরী। বলেন, এমআর মানে গর্ভপাত নয়। এটা এক ধরনের চিকিৎসা পদ্ধতি। কোনো নারী মিনস্ট্রেশন বন্ধ থাকলে বা গর্ভধারণের জটিলতার কারণ বের করতে আমরা ডায়াগনোস্টিক এমআর করে থাকি। এর মাধ্যমে জরায়ুতে কোনো জটিলতা বা অন্য কোনো সমস্যা আছে কিনা সেটি বের করা হয়। আর থেরাপিউটিক এমআরের মাধ্যমে মাধ্যমে এই সমস্যা দূর করে মিনস্ট্রেশন স্বাভাবিক করা হয়। তবে আরলি প্রেগনেন্সিতে অ্যাবরশন করানোর জন্যও এমআর করা হয়। মায়ের জীবন বাঁচাতে এটা আইনগতভাবেই করা যেতে পারে।

আট সপ্তাহের বেশি গর্ভধারণের ক্ষেত্রে এমআর করা ঝুঁকিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে প্রডাক্টের (ভ্রূণ) কিছু অংশ ভেতরে থেকে যেতে পারে। ফলে পরবর্তী সময়ে রক্তপাতের আশঙ্কা থাকে। এসব ক্ষেত্রে এমআরের পরিবর্তে ডিঅ্যান্ডসি (ডাইলেটেশন অ্যান্ড কিউরেটেজ) এবং ডিঅ্যান্ডইঅ্যান্ডসি (ডাইলেটেশন অ্যান্ড ইভাকুয়েশন অ্যান্ড কিউরেটেজ) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।

গুটমাকার ইন্সটিটিউটের জরিপের এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। এতে দেখা যায়, সরকারি হাসপাতালে এমআর সেবা দেওয়ার পরিমাণ কমছে। ২০১৪ সালে সারা দেশে মোট গর্ভপাতের ৫৩ শতাংশ হয়েছিল সরকারি প্রতিষ্ঠানে, যেখানে ২০১০ সালে এই পরিমাণ ছিল ৬৬ শতাংশ। এমআর কমে আসা এবং গর্ভপাত বাড়ার কারণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে গবেষকেরা বলছেন, দেশের ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোর মধ্যে বেশিরভাগে এমআর করানোর সুবিধা নেই। এ কারণে বেসরকারি পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রে গিয়ে গর্ভপাতের প্রবণতা বাড়ছে।

নিরাপদ গর্ভপাত নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন আইপাস। বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠানটির কান্ট্রি ডিরেক্টর ডা. সাইদ রুবায়েত বলেন, বর্তমানে দেশে যত সংখ্যক নারী গর্ভধারণ করছেন তার প্রায় অর্ধেকই অনিচ্ছাকৃত। এ অবস্থায় ইউনিয়ন পর্যায়ের সব স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ স্বাস্থ্যসেবাদানকারীদের মাধ্যমে মাসিক নিয়মিতকরণ কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। সব কেন্দ্রেই ওষুধ ও যন্ত্রপাতির প্রয়োজনীয় সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কুসংস্কার দূর করতেও আমাদের ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা উচিত।

দেখা যাচ্ছে, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় এমআর সেবা দেওয়ার নামে বেআইনিভাবে চলছে গর্ভপাত। বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই এ ধরনের ঘটনা বেশি ঘটছে। যারা সেবা নিচ্ছেন তারা বিষয়টি গোপন রাখতে চান। কেউ কেউ পরিবারের সদস্যদের অগোচরেই ঘটাচ্ছেন গর্ভপাত।  ক্লিনিকে তিনভাবে গর্ভপাত করানো হয়। নাম-পরিচয় গোপন করা হয় সেবাগ্রহীতার। মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার মধ্যে ব্যথামুক্ত এমআর করানো হয়। সাড়ে তিন হাজারের মধ্যে ওষুধের মাধ্যমেও গর্ভপাত করানো হয়। যদি ওষুধে কাজ না হলে কিছু বাড়তি টাকা না নিয়ে গর্ভপাত করানো হয়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় গাইনি বিভাগের মেডিকেল অফিসার নুসরার আরফিন নীলা বলেন, বিবাহিতদের মধ্যে যারা আসছেন তাদের মধ্যে নতুন দম্পতির সংখ্যা বেশি। বিয়ের প্রথম বছরের মধ্যে অসতর্কতার কারণে গর্ভবতী হওয়ায় অনেকেই গর্ভপাতের পথ বেছে নিচ্ছেন। একাধিক সন্তান থাকার পরেও অসতর্কতার কারণে যেসব নারী গর্ভবতী হয়ে পড়ছেন তারাও গর্ভপাত করাতে আসেন। এছাড়া সন্তান প্রসবের জন্য যেসব মায়ের জীবন হুমকির মুখে থাকেন ডাক্তারের পরামর্শে তাদের গর্ভপাত করানো হচ্ছে।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads