• বুধবার, ১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪২৯
পঞ্চাশ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭২২ গুণ

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

পঞ্চাশ বছরে বাজেটের আকার বেড়েছে ৭২২ গুণ

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২২ মার্চ ২০২১

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের জাতীয় বাজেটের আকার বেড়েছে ৭২২ গুণেরও বেশি। অথচ ১৯৭২ সালে সদ্য জন্ম নেওয়া যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল মাত্র ৪ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। ৫০ বছরে সেই বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা পেয়েছে। অভাব-অনটনে জর্জরিত সাড়ে ৭ কোটি মানুষের বাংলাদেশের এখন অর্থনীতির আকার ১১ লাখ ৩০ হাজার ৬০০ কোটি টাকা।

১৯৭২ সালে ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিল বাংলাদেশ। এ বছর ঘোষণা করা হবে ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট। ১৯৭২ সালের বাজেটে জনপ্রতি বরাদ্দ ছিল মাত্র ১১২ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজার টাকা। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে গত এক দশকে প্রবৃদ্ধির গড় হার ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। সূত্র জানিয়েছে, শূন্যের ঘরে থাকা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। ১২৯ মার্কিন ডলার আয় করা বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৬৪ ডলার।

বিশ্বের দুই বাঘা অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফাল্যান্ড ও জেআর পারকিনসন বাংলাদেশকে নিয়ে মন্তব্য করেছিলেন, যদি বাংলাদেশ কখনো উন্নতি করতে পারে, তবে পৃথিবীর কোনো দেশই উন্নয়নে বাদ যাবে না। সেই বাংলাদেশ এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। রপ্তানিও করছে। ধান, গম ও ভুট্টা উৎপাদনে পেছনে ফেলে চলেছে অনেক দেশকে। মোট জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৩ দশমিক ৬০ শতাংশ। কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেল এ তথ্য। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ১৯৭২ সালে ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারের অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ৭৮৬ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণা করেছিলেন। সেই বাংলাদেশ ৫০ বছরে এসে প্রায় ছয় লাখ কোটি টাকার বাজেট ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সব ঠিক থাকলে আগামী জুনে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকার বাজেট পেশ করবে জাতীয় সংসদে।

অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে অগণিত শিল্পকারখানা হয়েছে। কর্মসংস্থান বেড়েছে। তিল তিল করে গড়ে ওঠা অর্থনীতির জোরেই নিজের অর্থে পদ্মা সেতুর মতো সুবিশাল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ এখন শেষের দিকে।  পাশাপাশি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট, কর্ণফুলির তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ, গভীর সমুদ্রবন্দরের মতো ব্যয়বহুল প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে সরকার। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা থাকলে এ অর্থনীতি আরো এগোবে বলেই বিশ্বাস রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের।

জানা গেছে, ২০৩২ সালে বিশ্বের বড় ২৫টি অর্থনীতির দেশের একটি হবে বাংলাদেশ। এখন অবস্থান ৪১তম। ২০৩৩ সালে অর্থনীতিতে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকেও ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। আগামী ১৫ বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি গড়ে ৭ শতাংশ থাকবে। ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন সম্ভাবনার কথা বলা হয়েছে।

এদিকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের যোগ্যতা অর্জন করায় বাংলাদেশকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক গত বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) তার ফেসবুক পেজে অভিনন্দন জানানো ভিডিও বার্তাটি পোস্ট করেন।

বার্তায় জাতিসংঘের মহাসচিব বলেন, এই উত্তরণ স্পষ্ট ইঙ্গিত দেয়, দেশটি লাখো-কোটি মানুষের দারিদ্র্য ও ক্ষুধামুক্তির অঙ্গীকারসহ অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ক্রমবর্ধনশীল অর্থনীতি প্রতিষ্ঠায় কাজ করছে। বাংলাদেশের উত্তরণের এই জায়গায় জাতিসংঘের সহায়তা বজায় থাকবে।

বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পাদিত সমীক্ষায় জানা গেছে, স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রথম তিন বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ২ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এখন তা (করোনাকাল বাদ দিয়ে) বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ শতাংশের বেশি। ওই সময় দারিদ্র্যের হার ছিল মোট জনসংখ্যার ৮৮ শতাংশ। অর্থাৎ সাড়ে ৭ কোটি মানুষের সিংহভাগই ছিল দরিদ্র। এখন দারিদ্র্যের হার ২১ শতাংশের নিচে। অতিদারিদ্র্যের সংখ্যাও কমেছে।

অর্থনীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, স্বাধীনতা-পরবর্তী তিন বছরে পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি এবং মানুষের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়ায় মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৪৭ শতাংশ। এখন তা নেমে সাড়ে ৬ শতাংশের ঘরে আছে। ১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৭৯-৮০ অর্থবছর পর্যন্ত মাথাপিছু জাতীয় সঞ্চয় ছিল জিডিপির ২ শতাংশ। এখন তা বেড়ে ৩১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ১৯৭২ সালে প্রায় শূন্য হাতে শুরু করা বাংলাদেশের খাদ্যশস্য (ধান ও গম) উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি টন। পাঁচ দশকে কৃষিজমি আশঙ্কাজনক হারে কমলেও শস্য উৎপাদন বেড়েছে চারগুণ। বছরে প্রায় ৫ কোটি টনের কাছাকাছি পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়। জাতিসংঘের ‘দ্য স্টেট অব ফিশ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রাকৃতিক উৎস থেকে মাছ ও সবজি উৎপাদনে বিশ্বে এখন তৃতীয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯-২০ সালে এসে বাংলাদেশে দুধের উৎপাদন দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টনে। মাংসের উৎপাদন ৭ দশমিক ৬৭ টন। মাছের উৎপাদন ৪৪ দশমিক ৮৮ লাখ টন। এর মধ্যে ইলিশের উৎপাদন ৫ লাখ ৩৩ হাজার টন।

অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরের বাজেটে কৃষি খাতে বরাদ্দ করা হয়েছিল ১০১ কোটি টাকা। খাতওয়ারি যা ছিল সর্বোচ্চ বরাদ্দ। এ বরাদ্দের উদ্দেশ্য ছিল ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ১৫ লাখ একর থেকে ৩৬ লাখ একর জমি উচ্চ উৎপাদনশীল খাদ্য উৎপাদনের আওতায় আনা। ৪ লাখ ২৫ হাজার পাম্প স্থাপন করা হয়। ২ হাজার ৪০০ গভীর নলকূপ ও ৪ হাজার অগভীর নলকূপ খনন করা হয়। কৃষকের কাছে সহজে সার সরবরাহের লক্ষ্যে মণপ্রতি সারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল মাত্র ২০ টাকা। যা ছিল ক্রয়মূল্যের অর্ধেক।

কৃষি খাতে বর্তমান সাফল্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৩ সাল নাগাদ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়তে শুরু করে। ১৯৭৪-৭৫ সালের বাজেটে এ প্রবৃদ্ধি আরো আশান্বিত করে। বড় আকারের বন্যা হওয়ার পরও কৃষি উৎপাদন বেড়েছে। ১৯৭৫ সালের এপ্রিল থেকে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে থাকে। চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে সাড়ে ৫ টাকা হয়। আলু ২ টাকা থেকে দেড় টাকায় নেমে আসে। কাপড়, সার, কাগজ উৎপাদনও লক্ষণীয় পরিমাণে বাড়ে।’৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর যা পুরোটাই থেমে যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) দেওয়া তথ্যমতে, বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় টেকসই সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রেখে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারা অব্যাহতভাবে ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছে।

২০২০ সালে কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে চলমান ধারা কিছুটা বাধাগ্রস্ত হলেও গত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির গড় হার হয় ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। 

সরকারের ২০১৯-২০ অর্থবছরের বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত বিবিএসের সূত্রমতে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবছর ৬ দশমিক ৭ শতাংশ, ২০১০-১১ অর্থবছর ৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ, ২০১১-১২ অর্থবছর ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ, ২০১২-১৩ অর্থবছর ৬ দশমিক ০১ শতাংশ, ২০১৩-১৪ অর্থবছর ৬ দশমিক ০৬ শতাংশ, ২০১৪-১৫ অর্থবছর ৬ দশমিক ৫৫ শতাংশ, ২০১৫-১৬ অর্থবছর ৭ দশমিক ১১ শতাংশ, ২০১৬-১৭ অর্থবছর ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ, ২০১৭-১৮ অর্থবছর ৭ দশমিক ৮৬ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছর ৮ দশমিক ১৫ শতাংশ এবং কোভিড-১৯ এর প্রাদুর্ভাবজনিত কারণে বাধাগ্রস্ত হয়ে ২০১৯-২০ বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ দশমিক ২৪ শতাংশ অর্জিত হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জানান, দেশের অর্থনীতি ঠিক জায়গায় রয়েছে। ২০২৫ সালের আগেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অতিক্রম করবে। অর্থনীতির সব সূচকেই এগোবে বাংলাদেশ। এখন উন্নত দেশের তালিকায় নাম লেখানোর দিকে যাচ্ছি আমরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads