• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
নেতৃত্ব দেবে আইসিটি

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

উন্নয়ন ও অগ্রগতির ৫০ বছর

নেতৃত্ব দেবে আইসিটি

  • মোহসিন কবির
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০২১

রাজধানীর পূর্ব জুরাইনের বাসিন্দা মোহাম্মদ নুরুজ্জামান। ২০০৮ সালে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানিতে কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে যোগ দেন। চাকরির পাশাপাশি গ্রাফিকস ডিজাইনের ওপর দক্ষতা বাড়িয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ের কাজ শুরু করেন। ধীরে ধীরে অনলাইনে আয় বাড়তে থাকায় মাত্র সাড়ে তিন বছর পরে নুরুজ্জামান তিতাসের চাকরি ছেড়ে দিয়ে ফ্রিল্যান্সিংয়ে পুরোপুরি মনোযোগী হন। বর্তমানে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে তিনি প্রতি মাসে দেড় থেকে পৌনে দুই লাখ টাকা আয় করছেন। বাংলাদেশের খবরকে নুরুজ্জামান বলেন, ‘শুরুটা খুব সহজ ছিল না। আগে আমি অনলাইনে কাজ খুঁজে বেড়াতাম। কিন্তু এখন ক্লায়েন্টরা আমাকে খুঁজে কাজ দেয়।’ রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নুরুজ্জামানের মতো অসংখ্য ফ্রিল্যান্সার এখন ঘরে বসেই বৈদেশিক মুদ্রা আয় করছেন। আন্তর্জাতিক বাজারে তৈরি করছেন চাকরির নতুন ক্ষেত্র। মাত্র কবছর আগেও আইসিটি খাতে আয় ছিল মাত্র ২৬-২৭ মিলিয়ন ডলার। বর্তমানে তা ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ২০২৫ সাল নাগাদ ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে সরকার। স্বাধীনতার ৫০তম বার্ষিকীতে দেশের আইটি সেক্টর এক অনন্য উচ্চতায় উন্নীত হয়েছে বলে মনে করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। যদিও বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের আইটি খাতের যাত্রাটা অনেক পরেই শুরু হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে এই সেক্টর এশিয়ার অনেক দেশকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। পোশাকশিল্পের পর দেশের অর্থনীতিতে আইটি শিল্পের অবদান দ্রুতই বাড়ছে। বাংলাদেশের আইটি শিল্প বহির্বিশ্বে অভূতপূর্ব সুনাম অর্জন করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লব হবে প্রযুক্তির হাত ধরে। আর সেই শিল্পবিপ্লবে নেতৃত্ব দিতে চায় বাংলাদেশ। এ লক্ষ্যে সরকার দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নের ওপর জোর দিয়েছে। দেশব্যাপী ২৮টি হাইটেক পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া আরো অনেক প্রকল্প চলমান রয়েছে। কেবল বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনই না; বেকারত্ব দূর করাসহ ব্যবসা-বাণিজ্যের গতি ত্বরান্বিত করতে আইটি খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা দেওয়ার কারণে এই সেক্টর দ্রুত সম্প্রসারণ হচ্ছে। বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আইটি সেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। তেমনই একটি প্রতিষ্ঠান ধানমন্ডির ক্রিয়েটিভ আইটি ইনস্টিটিউট। গ্রাফিক্স ডিজাইনে দেশজুড়ে খ্যাতি অর্জন করা এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনির হোসেন জানান, অত্যন্ত ছোট পরিসরে ২০০৮ সালে তার প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু। অথচ মাত্র ১২ বছরের ব্যবধানে বর্তমানে তার  প্রতিষ্ঠানে শুধু কর্মচারী সংখ্যা চার শতাধিক।

মনির হোসেন বাংলাদেশের খবরকে বলেন, ‘গত ১২ বছরে আমরা ৪২ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছি। যাদের মধ্যে প্রায় ৫৫ শতাংশই এখন ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে আয় করছেন। পাশাপাশি ৪ লাখেরও বেশি মানুষের কাছে আইটি ক্যারিয়ার গাইডলাইনটা পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।’ 

করোনার মাঝেও দেশের আইটি প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে জানান মনির হোসেন। দেশের পাশাপাশি বিদেশে ইউরোপ ও আমেরিকায় ক্রিয়েটিভ আইটি প্রচুর কাজ করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সবচেয়ে বেশি কাজ করছি আমরা আমেরিকায়। আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারি যে ভারত, পাকিস্তান এবং ফিলিপাইনের চেয়েও আমরা ভালো কাজ করে দিচ্ছি। সে কারণে আমাদের বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ আইটি কোম্পানিই এখন ভালো করছে। করোনার মধ্যে অন্যান্য সেক্টর ক্ষতিগ্রস্ত হলেও আইটি সেক্টর ভালো অবস্থানে ছিল। সে ক্ষেত্রে কোম্পানিগুলো বন্ধ হয়নি বরং কাজের পরিধি বেড়েছে।’

দীর্ঘদিন ধরে আইটি সেক্টরের সাথে যুক্ত দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের অন্যতম শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিস (বেসিস)। প্রতিষ্ঠানটির প্রেসিডেন্ট সৈয়দ আলমাস কবিরের মতে, আইটি সেক্টরের যাত্রাটা শুরু হয়েছে মূলত স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই। তিনি বাংলাদেশের খবরকে বলেন ‘বঙ্গবন্ধুর লক্ষ্য ছিল আমাদের বদ্বীপের মধ্যে আবদ্ধ থাকলে হবে না। এ কারণে বিশ্বের সাথে যোগাযোগ রক্ষায় তিনি ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিও) সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন। পাশাপাশি তিনি বেতবুনিয়ার ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন; যার মাধ্যমে ওই সময়েও লাইভ টেলিভিশন অনুষ্ঠান দেখা যেত। সুতরাং যাত্রাটা শুরু হয়েছে স্বাধীনতার পর থেকেই।’

প্রযুক্তিবিদদের মতে, স্বাধীনতা পর যাত্রা শুরু হলেও দেশে আইটি সেক্টরের বিকাশ হয়েছে মূলত বর্তমান সরকারের প্রথম মেয়াদ থেকে। তাদের মতে, গত ১২ বছরে এই সেক্টরে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে। ক্রিয়েটিভ আইটির মনির হোসেন বলেন, ‘দেশব্যাপী যে পরিবর্তনটা এসেছে সেটির অন্যতম কারণ হলো, এখন গ্রাম পর্যায়েও ইন্টারনেট সেবা পৌঁছে গিয়েছে। আগে ইন্টারনেট সহজলভ্য ছিল না। ফলে তখন অনেকের পক্ষেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সাথে সংযুক্ত থাকা সম্ভব হতো না। যে কোনো কিছুর সাথে কানেক্টেড থাকাটা অনেক কষ্টসাধ্য ছিল। এখন প্রান্তিক পর্যায়ের একটা ছেলেমেয়েও বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তের সাথে সহজেই সংযুক্ত হতে পারছে। এটি বর্তমান সরকারের অবদান নিঃসন্দেহে।’

বেসিসের সৈয়দ আলমাস কবির এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর গত ১২ বছরে যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে তথ্য প্রযুক্তি খাতে। মোবাইলের প্রবেশ, ইন্টারনেট ব্যবহার, ১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি এগুলো উন্নতিরই প্রমাণ। এ ছাড়া অনেকেই বলেছিল করোনার মধ্যে জিডিপির ২-এ নেমে আসবে। সেটা ৫.২-এ ছিল। এটা এই অঞ্চলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এর কারণ ছিল জীবনযাত্রা থেমে যায়নি। অনলাইনের মাধ্যমে কেনাকাটা, চিকিৎসাসেবা প্রদান, ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালন সব হয়েছে অনলাইনে। এই অনলাইন সেবার ভিতটা রচিত হয়েছে আইটি বা সরকারের ডিজিটালাইজেশনের হাত ধরেই।’

তবে সংশ্লিষ্টদের মতে, ২০২৫ সাল নাগাদ ৫ বিলিয়ন ডলার এবং তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের নেতৃত্ব প্রদানের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে সেই লক্ষ্য পূরণে রয়েছে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতাও। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে না পারলে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন দুরূহ হবে বলে সতর্ক করেছেন তারা। এ প্রসঙ্গে বেসিস  প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা খুবই আশাবাদী টার্গেট পূরণের বিষয়ে। তবে ডিজিটাল বাংলাদেশ কোনো একটি নির্দিষ্ট গন্তব্য নয়, এটা একটি চলমান যাত্রা। যাত্রাটা অব্যহত রাখতে এখনো অনেক কাজ বাকি। নাগরিক সেবাগুলোকে অনলাইনে নিয়ে আসতে হবে। আড়াই হাজারের মতো সেবা রয়েছে, যার মধ্যে মাত্র ৭শ সেবা অনলাইনের আওতায় এসেছে। দ্রুতগতির ইন্টারনেট সেবা সুলভ মূল্যে প্রান্তিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে।’

করোনার কারণে অনলাইনে ক্লাস, বিচারকাজ পরিচালনাসহ নানা ক্ষেত্রে কাজের পরিধি বাড়ছে। এসবের জন্য নতুন নতুন সফটওয়্যার টুলসের প্রয়োজন। কিন্তু এজন্য যে ধরনের দক্ষ লোকবলের দরকার তার ঘাটতি রয়েছে উল্লেখ করে আলমাস কবির বলেন, ‘এগুলোকে গ্র্যাব করতে পারলে ৫ বিলিয়ন রপ্তানি এক্সপোর্ট কোনো ব্যাপার না। উন্নত প্রশিক্ষণ এবং দ্রুত গতির ইন্টারনেট সুলভ মূল্যে দিতে পারলে প্রান্তিক পর্যায়ের ছেলেমেয়েরাও এই রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারবে।’

দেশে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রযাত্রার অংশ হিসেবে গত এক যুগে যেসব উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়েছে, তার মধ্যে মহাকাশে বাংলাদেশের প্রথম স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ অন্যতম। এই অর্জন বিশ্ববাসীর কাছে বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে অন্য রকম উচ্চতায়। সরকারের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ ২০২১ সালের মধ্যে আইসিটি পেশাজীবীর সংখ্যা ২০ লাখে উন্নীত করা, আইসিটি খাতে ৫ বিলিয়ন ডলার আয় এবং জিডিপিতে এ খাতের অবদান ৫ শতাংশ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। লক্ষ্য অর্জনে কানেকটিভিটি ও আইসিটি অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন, ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠাসহ আরো নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে সরকার।

মানুষের জীবনমান উন্নয়নেও প্রযুক্তি ব্যাপকভাবে প্রভাব ফেলেছে। সৃষ্টি হয়েছে  ব্যাপক কর্মসংস্থান। উবার-পাঠাওয়ের মতো রাইড শেয়ারিং সেবার মাধ্যমে কর্মসংস্থান যেমন বেড়েছে, তেমনি অনেকের যাতায়াতে সুবিধাও হয়েছে। স্মার্টফোন ব্যবহারকারী বাড়ায় নতুন উদ্যোক্তাও সৃষ্টি হয়েছে। ফলে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ রূপকল্প কেবল অর্থনীতিকেই শক্তিশালী করছে না, দেশের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads