• বুধবার, ৮ মে ২০২৪, ২৫ বৈশাখ ১৪২৯
দুর্ঘটনার হটস্পট এক্সপ্রেসওয়ে

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ৭৯ দুর্ঘটনায় মৃত্যু ৬৫, বেপরোয়া গতিই অন্যতম কারণ

দুর্ঘটনার হটস্পট এক্সপ্রেসওয়ে

  • ইমরান আলী
  • প্রকাশিত ২৩ মার্চ ২০২১

মাওয়া-ঢাকা মহাসড়কের হাসামদিয়া মোড়। রাতে বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে তিন বন্ধু দুই মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। মধ্যরাতে দ্রুতগতির প্রাইভেট কার শাকিল ও অপুর মোটরসাইকেলটিকে সামনে থেকে ধাক্কা দেয়। এতে মোটরসাইকেল থেকে ছিটকে পড়ে ঘটনাস্থলেই তারা মারা যায়। গত বছরের ২৩ মার্চ মর্মান্তিক এ দুর্ঘটনা ঘটে।

অপর বন্ধু রনির পরিবার জানায়, কাউলিবেড়া বন্ধুর বাড়িতে দাওয়াত খেয়ে তিন বন্ধু একসঙ্গে মোটরসাইকেলে বাড়ি ফিরছিলেন। রাত আড়াইটার দিকে একটি প্রাইভেট কারের সঙ্গে মোটরসাইকেলটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। ঘটনাস্থলে অপু ও শাকিল নিহত এবং তাদের আরেক বন্ধু রনি গুরুতর আহত হয়। ভাঙ্গা হাইওয়ে থানার ওসি মো. ওমর ফারুক জানান, বরিশাল থেকে মাওয়াগামী একটি প্রাইভেটকারের (ঢাকা মেট্রো-গ-৪২-৪৮১০) সঙ্গে ওই মোটরসাইকেলটির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। তবে প্রাইভেটকারসহ চালককে আটক করা হয়েছে। এর আগে দ্রুতগতির দুটি যাত্রীবাহী বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনাস্থলেই মারা যান হেনা বেগম নামে এক বাসযাত্রী এবং বসুমতি পরিবহনের ড্রাইভার বাদশা। একই দিনে এক্সপ্রেসওয়ের মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় রাকিব (২৫) নামে এক যুবক নিহত হন। 

যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন মাত্রা যুক্ত করলেও দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা ক্রমেই দুর্ঘটনাপ্রবণ হয়ে উঠছে। মাত্র এক বছর আগে উদ্বোধন হওয়া বিশ্বমানের এই সড়কে একের পর এক দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়ছে বহু প্রাণ।

পুলিশের মতে, ট্রাফিক আইন না মানার কারণেই দুর্ঘটনা হচ্ছে। আর বুয়েটের বিশেষজ্ঞদের মতে, সড়কের ওপরে বাসস্টপেজ করা ঠিক হয়নি। দ্রুতগতির এক্সপ্রেসওয়েতে ডিভাইডার টপকে পার হচ্ছেন পথচারীরা। সেইসঙ্গে বেপরোয়া চলছে মোটরসাইকেল।

এই এক্সপ্রেসওয়ে যোগাযোগে নতুন দিগন্তের সূচনা করলেও ঘন ঘন দুর্ঘটনায় সহজ ও নিরাপদ যাতায়াতে চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। একমুখী প্রশস্ত সড়ক, ফ্লাইওভার, আন্ডারপাস, ইন্টারচেঞ্জ, ধীরগতির গাড়ির জন্য আলাদা সড়ক থাকার পরও দুর্ঘটনার হটস্পট এখন এক্সপ্রেসওয়ে। বিশেষ করে ফাঁকা রাস্তায় চালকরা গাড়ির গতিবেগ বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আর এতেই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনার কবলে পড়ছে যানবাহন।

মুন্সীগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য অধ্যাপক সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি বলেন, মোটরসাইকেল চলছে বেপরোয়াভাবে, দরকার সবার সচেতনতার। সচেতনতার পাশাপাশি আইনের প্রয়োগও কঠিনভাবে করতে হবে। তবেই এ সড়কে দুর্ঘটনা কমে আসবে।

হাঁসাড়া থানার তথ্যমতে, ২০২০ সালের এক জানুয়ারি থেকে চলতি মার্চ পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটারের ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ৭৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ৬৫ জনের। 

মুন্সীগঞ্জ হাঁসাড়া হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহরাব আহমেদ মজুমদার বলেন, ট্রাফিক আইন না মানার কারণেই দুর্ঘটনা হচ্ছে।

তার মতে, গতির নিয়ন্ত্রণ আনতে হবে। আর মোটরাসাইকেলগুলো যে গতিতে চলে তাদেরও সচেতন হতে হবে। গতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার কারনেই দুর্ঘটনা বেশি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে পুলিশের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। যেমন রাস্তায় চেকপোস্ট দেওয়া। পূর্বে থেকে গতি নিয়ন্ত্রণের সাইনবোর্ড বসানো। তিনি জানান, অতিরিক্ত গতিতে যানবাহন দেখলেই চেকপোস্টে বলে জরিমানার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

সড়কের ওপরে বাস বে করা ঠিক হয়নি। পর্যাপ্ত ফুটওভার ব্রিজও নেই বলে মনে করেন বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান।

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, এই সড়কে এখনো কোনো শৃঙ্খলা নেই। যেখানে-সেখানে যাত্রী উঠানো-নামানো ও বেপরোয়া গতি দুর্ঘটনা বয়ে আনছে। প্রায়ই বিভিন্ন বাস চলে প্রতিযোগিতা করে। এতে অনেক সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে চালকরা। স্থানীয় ইয়াকুব মোল্লা বলেন, রাস্তায় যানবাহনগুলো একে অপরের সাথে পাল্লা দেয়। পাল্লার কারণে যাত্রীদের প্রাণহানি হচ্ছে। তিনি বলেন, সম্প্রতি এক মহিলা ও বাসচালক মারা গেছে শুধু পাল্লা দিয়ে চলার কারণে। ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ এগুলো নিয়ন্ত্রণ করলে দেশের প্রথম এক্সপ্রেসওয়েটি নিরাপদ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। 

সড়ক ও জনপথ বিভাগ জানিয়েছে, এক্সপ্রেসওয়েতে নতুন করে আরো ১৬টি ফুট ওভারব্রিজ নির্মাণ করা হবে। সব বাসস্টপেজেই ফুটওভার ব্রিজ দেওয়া হবে।

প্রসঙ্গত, প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা সুপার এক্সপ্রেসওয়ে। দেশের প্রথম এই সুপার এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মাত্র এক ঘণ্টায় ঢাকা থেকে মাদারীপুর পৌঁছানো যায়। গত বছরের ১২ মার্চ চালু হয় এই এক্সপ্রেসওয়ে।

জানা গেছে, এই এক্সপ্রেসওয়েতে পাঁচটি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস এবং প্রায় ১০০টি সেতু ও কালভার্ট রয়েছে। আন্তর্জাতিক মানের এক্সপ্রেসওয়েটির ফলে বরিশাল বিভাগের ছয় জেলা, খুলনা বিভাগের ১০ জেলা এবং ঢাকা বিভাগের ছয় জেলার মানুষ সরাসরি উপকৃত হচ্ছেন। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের ৫৫ কিলোমিটারের মধ্যে ঢাকা থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পর্যন্ত ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়ক জেলার সিরাজদিখান, শ্রীনগর ও লৌহজং উপজেলার মধ্য দিয়ে গেছে।

এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ফলে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগ অনেক সহজ হয়েছে। এক্সপ্রেসওয়েটিতে স্থানীয় ও ধীর গতিসম্পন্ন যানবাহনের জন্য দুটি পরিষেবা লেন রাখা হয়েছে, যাতে দ্রুতগতির যানবাহনগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে চলাচল করতে পারে। এক্সপ্রেসওয়েতে যানজট না থাকায় বাস ও ট্রাক দ্রুতগতিতে চলাচল করতে পারে।

এক্সপ্রেসওয়েতে পাঁচটি ফ্লাইওভার, চারটি রেলওয়ে ওভারব্রিজ ও চারটি বড় ব্রিজ রয়েছে। এখানে উল্টোপথে চলাচলের সুযোগ নেই এবং ইচ্ছেমতো ফ্লাইওভারে ওঠা-নামার পথ রাখা হয়নি।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads