• বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪২৯
কূটনৈতিক দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন

প্রতীকী ছবি

জাতীয়

বিশ্বে সুনাম বজায় রাখা বড় চ্যালেঞ্জ

কূটনৈতিক দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন

  • রবিউল হক
  • প্রকাশিত ২৪ মার্চ ২০২১

স্বাধীনতার ৫০ বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা ও প্রশংসনীয় উদ্যোগ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপ্তি জানান দেয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেওয়া ‘সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারো সাথে বৈরিতা নয়’-এই নীতি অনুসরণ করে বৈদেশিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে দেশ। একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সব সময়ই বিংশ শতাব্দীর স্নায়ুযুদ্ধে প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর পক্ষাবলম্বন থেকে বিরত থেকেছে। আর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র হওয়ার কারণে অন্যান্য মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সুদৃঢ় কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। ৫০ বছরের পথপরিক্রমায় অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাংলাদেশের অগ্রগতি ঈর্ষণীয়। বিদেশিদের দৃষ্টিতে স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশ ছিল এক তলাবিহীন ঝুড়ি। আর এখন সমৃদ্ধ, স্বনির্ভর বদলে যাওয়া এক বাংলাদেশ। সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন এক উদীয়মান অর্থনীতির দেশ।

সাবেক কূটনীতিক মুহাম্মদ জমির বাংলাদেশের খবরকে বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী বিধ্বস্ত পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মহলের কেউ ভাবেনি বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে। বাংলাদেশের তখন বড় কাজ ছিল ভারতে আশ্রয় নেওয়া লাখ লাখ বাংলাদেশিকে দেশে ফিরিয়ে এনে পুনর্বাসন করা এবং পাকিস্তানিদের প্রত্যাবর্তন। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর সহায়তা নিয়ে করণীয় ঠিক করলেন। তাতে ভারত ও রাশিয়া সার্বিক সহযোগিতায় এগিয়ে এলো। ওই সময় বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য না হয়েও বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছিল, যদিও ভোটে দিয়েছিল চীন। এ পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু ভারতে গেলেন এবং ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনা করে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি তোলেন। ভারতও সে কথা অনুযায়ী সেনা প্রত্যাহার করে নেয়। এরপর বঙ্গবন্ধু বিধ্বস্ত রাস্তাঘাট মেরামত ও খাদ্য ঘাটতি মেটাতে খাদ্য আমদানির উদ্যোগ নিলেন। সে সময় তিনি কমনওয়েলথ দেশ ও জাপান সফর করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর বাংলায় বক্তৃতা দেওয়াও ছিল আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যয়ের প্রকাশ। এভাবেই বঙ্গবন্ধুর উদ্যোগে আজ এই পর্যায়ে পৌঁছেছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে কূটনীতিতে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ সম্পর্কিত এক প্রশ্নের উত্তরে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, প্রতিবেশী দেশ ভারত ও চীনের উচিত এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করা।

গত ৫০ বছরে স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে বাংলাদেশের। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতি সংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে-কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদণ্ডেই উন্নীত হয়েছে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ, যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস। বর্তমান সরকারের রূপকল্প-২০২১ বাস্তবায়নে এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী এবং অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফল, যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের নানা পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ এবং গভীর সম্পর্ক আছে ভারতের সঙ্গে। ভারতের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ সীমানা নির্ধারণ, ছিটমহল বিনিময়, বাণিজ্য-বিনিয়োগে প্রতিবন্ধকতা নিরসন এবং সর্বপরি দুদেশের মধ্যে একটি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে গড়ে তোলা ছিল কূটনীতির অন্যতম সাফল্য। শুধু তিস্তা চুক্তি বাদে অন্য ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় ইস্যুগুলো সমাধানে ব্যাপক অগ্রগতি হয়েছে। দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে ট্রানজিট জটিলতারও সমাধান হতে চলেছে। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে দুই দেশ। সাবেক পররাষ্ট্র সচিব তৌহিদ হোসেন জানান, করোনা মহামারী-পরবর্তী নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় কূটনৈতিক দিক থেকে নানা চ্যালেঞ্জ থাকবে বাংলাদেশের জন্য। গত ৫০ বছরে সুশাসন, মানবাধিকার, বাক্স্বাধীনতা, দুর্নীতি, আইনের শাসন ইত্যাদি সূচকে হতাশাব্যঞ্জক অবস্থান কূটনীতিকদের কাজকে সহজ করেনি। ২০১৪ আর ২০১৮ সালের নির্বাচনকে ঠিক মানসম্মত বলা যায় না। সর্বোপরি, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী কর্তৃক বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে প্রবেশ এবং অবস্থান এক দীর্ঘমেয়াদি উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। আসছে বছরগুলোতে শক্ত চ্যালেঞ্জ রয়েছে বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সামনে। তিনি আরো বলেন, তিন দিক দিয়ে ঘিরে রাখা ভারত, অন্যদিকে মহাচীন বাংলাদেশকে তুলনামূলক একটি ছোট রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। এমনকি প্রতিবেশী মিয়ানমার, জনসংখ্যায় আমাদের এক-তৃতীয়াংশ হলেও আকারে পাঁচ গুণ বড়। বাংলাদেশের কূটনীতি এসব বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই পরিচালিত করতে হয়েছে। সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে শত্রুতা নয়, এই মূলনীতি দিয়েছে আমাদের সংবিধান। তবে বাস্তব দুনিয়া এত সরল পথে চলে না। নতুন বছরে মহামারী মোকাবিলা এবং ভ্যাকসিনের মতো বিষয় ছাড়াও বহু কারণে ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে বাংলাদেশের। এর মধ্যে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন তৃণমূল এবং কেন্দ্রীয় সরকারের দল বিজেপির মধ্যে লড়াই নিয়ে নানা সমীকরণ আছে। একদিকে তিস্তা চুক্তি অন্যদিকে এনআরসি ইস্যু-এমন প্রেক্ষাপটে পশ্চিমবঙ্গের ভোট বাংলাদেশের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকবে।

তোহিদ হোসেন আরো জানান, বাংলাদেশ আয়তনের দিক থেকে একটি ছোট দেশ। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের অবস্থান, তার ভূমিকা, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যে-কোনো উত্তেজনা, চীনের প্রভাব ও সেই প্রভাবকে নিয়ন্ত্রণ করার ব্যাপারে বাইডেন প্রশাসনের সম্ভাব্য ভূমিকা এবং স্ট্র্যাটেজিক অবস্থান আগামীতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলবে। তবে ৫০ বছরে বিপুল সাফল্য আছে বাংলাদেশের, আছে কিছু ব্যর্থতাও। তেমনি বাংলাদেশের কূটনীতিতেও আছে সাফল্য আর ব্যর্থতা।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে বিশ্লেষক ড. লাইলুফার ইয়াসমিন বলেন, পশ্চিমবঙ্গের সাথে আমাদের সংস্কৃতিগত ও ভাষাগত বেশ মিল রয়েছে। সে কারণেই কিন্তু আমরা এটাকে গুরুত্ব দিই। এনআরসি এবং তিস্তা ইস্যু কিন্তু আরো বেশি এই হাইপটাকে তুলে ধরেছে। কিন্তু আমি মনে করি এই হাইপটাকে একটু সংযতভাবে আমাদের দেখতে হবে। তিনি মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচনের পর কী হবে না হবে তার সঙ্গে আঞ্চলিক রাজনীতির একটা বড় সম্পর্ক রয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন জানান, বিশ্ব রাজনীতি বা বিশ্ব পরিস্থিতিতে অনেক চড়াই-উতরাই ঘটছে এবং অনেক নতুন শক্তির উত্থান ঘটছে। বিশ্বব্যাপী ঘটে যাওয়া অর্থনৈতিক মন্দা ও করোনা পরিস্থিতির মধ্যে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ একটি ভিন্নরূপে আবির্ভূত হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এসব জায়গাতে বাংলাদেশ একটা শক্ত অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে। আমরা জানি যে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একটা সোচ্চার অবস্থান রয়েছে। বিশেষ করে কতগুলো ইস্যুতে বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নের ভূমিকা পালন করে। যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি। বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলো যারা এ জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবের শিকার তাদের মুখপাত্র হিসেবে বিশ্বে বাংলাদেশ বলিষ্ঠ ভূমিকা রেখেছে। জাতিসংঘে বাংলাদেশ এ ব্যাপারে সবসময়ই তৎপরতা প্রদর্শন করে আসছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রত্যেকটি প্রতিবেশী রাষ্ট্রসহ বৃহৎ শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্কের যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। বাংলাদেশের একদিকে যেমন প্রাচ্যমুখিতা আছে তেমনি পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত শক্তিশালী।

তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার শাসনামলে চীনা প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। শেখ হাসিনাও চীন সফর করেন। ভারত ও চীনের প্রশ্নে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গেও সম্পর্ক রাখছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ জঙ্গি দমনে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে যোগ না দিলেও সৌদি আরবের নেতৃত্বাধীন ইসলামিক মিলিটারি অ্যালায়েন্স টু ফাইট টেরোরিজমে যোগ দিয়েছে। বাংলাদেশ এখন অবধি যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তাবিত সোফা ও আকসা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। এদিকে ক্রমেই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে মার্কিন প্রশাসনের কাছেও।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads