• মঙ্গলবার, ৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪২৯
আজ ভয়াল কালরাত

ফাইল ছবি

জাতীয়

আজ ভয়াল কালরাত

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ২৫ মার্চ ২০২১

ভয়াল পঁচিশে মার্চের সেই কালরাত আজ। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর মুহূর্তে ১৯৭১ সালের এই পঁচিশে মার্চের কালরাতেই পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশে পৃথিবীর ইতিহাসের ভয়াবহতম গণহত্যা সংঘটিত হয়। সে রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকাসহ এ দেশের বড় শহরগুলোতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কমপক্ষে ৫০ হাজার ঘুমন্ত বাঙালিকে হত্যা করে। এই মর্মন্তুদ গণহত্যা আজো বিশ্বের মানুষের কাছে ঘৃণ্যতম ও তমসাচ্ছন্ন এক অধ্যায়।

পঁচিশ মার্চের সেই ভয়াল রাতে গণহত্যার নীলনকশা ‘অপারেশন সার্চলাইট’ বাস্তবায়নে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মেতে উঠেছিল বাঙালি নিধনযজ্ঞে। অন্যদিকে এ নিষ্ঠুরতা ও নির্মমতার বিরুদ্ধে অসম সাহসী বাঙালি প্রতিরোধ গড়ে তুললে মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনাও ঘটে। পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।

শুরু হয় বাঙালির সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলন-প্রতিরোধের অগ্নস্ফুিলিঙ্গ। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হানাদারদের প্রতিরোধে এগিয়ে আসেন সেনা ও পুলিশ

বাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও। জাতির অস্তিত্ব রক্ষার এ লড়াইয়ের ধারাবাহিকতায় নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আর ৩০ লাখ শহীদের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর জন্ম নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চের সকাল থেকেই অজানা আশঙ্কায় দিন কেটেছে বাঙালির। দিনভর অশান্ত উদ্বেল পরিস্থিতি ছিল পুরো দেশজুড়ে। এমনি এক পরিস্থিতিতে এক সময় বেতারের প্রচার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি কোনো ঘোষণাও প্রচারিত হয়নি সেদিন। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত অবধি মিছিল-মিটিং-স্লোগানে মুখরিত প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকাবাসীর প্রায় সবাই ঘুমিয়ে পড়েন এক সময়।

নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের কেউই ঘুণাক্ষরে জানতে পারেনি, ততক্ষণে খুলে গেছে নরকের দরজা। রাত সাড়ে ১১টায় ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রথম রাস্তায় নেমে আসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। তারা প্রথমে ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনস এবং পরে একে একে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ধানমন্ডি ও পিলখানা পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর) সদর দপ্তরসহ রাজধানীর সর্বত্র আক্রমণ চালিয়ে নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। একই সময়ে তাদের নিধনযজ্ঞ চলে চট্টগ্রামসহ দেশের কয়েকটি বড় শহরেও।

রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তর পাকিস্তানি সেনাদের সাঁড়াশি আক্রমণের মুখেও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণ করেননি। রাইফেল তাক করে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন তারা। কিন্তু শত্রুর ট্যাংক আর ভারী মেশিনগানের ক্রমাগত গুলির মুখে এক সময় গুঁড়িয়ে যায় সব ব্যারিকেড প্রতিরোধ। গ্যাসোলিন ছিটিয়ে আগুনে ভস্মীভূত করা হয় পুলিশ সদর দপ্তর। সেখান থেকে ঘাতক বাহিনী এগোতে থাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দিকে। পরে রাতভর পুরো রাজধানীতেই নিরীহ নিরস্ত্র ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পৈশাচিক উন্মত্ততায় ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি সেনারা।

তখনো মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকসহ স্বাধীনতার দাবিতে বাঙালির বিক্ষোভে উত্তাল জনপদের খবর সংগ্রহ করতে ঢাকায় আসা বিদেশি সাংবাদিকরা অবস্থান করছিলেন শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। এ হোটেলের বারোতলায় দেহরক্ষীদের কড়া পাহারায় ঘুমুচ্ছিলেন পাকিস্তানি পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। রাত পৌনে ১২টায় পাকিস্তানি সেনারা হোটেলটি ঘিরে ফেলে কেউ বেরোলেই গুলির নির্দেশ দেয়। এভাবেই বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয় ঢাকাকে।

এর পরপরই রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে নগরজুড়ে ভেসে আসতে শুরু করে পাকিস্তানি সেনাদের ট্যাংক, মেশিনগান ও রিকয়েললেস রাইফেলের গুলি এবং মর্টারের শব্দ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলসহ সব হলেই নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালায় তারা। পাকিস্তানি হায়েনাদের কবল থেকে রক্ষা পাননি রোকেয়া হলের ছাত্রীরাও। একরাতে তিন শতাধিক ছাত্রছাত্রী শহীদ হন। নৃশংসভাবে শাহাদতবরণ করতে হয় ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য. ড. মনিরুজ্জামানসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের নয়জন শিক্ষককে।

মানুষের আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে আকাশ-বাতাস। মর্মন্তুদ সে আর্তনাদ ছাপিয়ে চারপাশে তখন কেবলই আগুনের লেলিহান শিখা ও ধ্বংসযজ্ঞ। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বড় হয়েছে লাশের স্তূপ। এক সময় গোটা নগরীই পরিণত হয় লাশের শহরে। পরে স্তম্ভিত বিশ্ব অবাক হয়ে দেখেছে বর্বর পাকিস্তানি সেনাদের নিষ্ঠুর সে হত্যাযজ্ঞ।

অবশ্য এ পরিস্থিতিতেও রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন বাঙালি ছাত্র-জনতা। ঢাকার ফার্মগেট থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার চারপাশেই এ প্রতিরোধ ছিল। প্রতিরোধ ছিল চট্টগ্রামেও। কিন্তু রক্তের নেশায় উন্মত্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নৃশংস বর্বরতার মুখে সেদিন কিছুই করতে পারেনি অকুতোভয় বাঙালি।

এর আগের দিন ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট হাউসে চলমান মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের অংশ হিসেবে আয়োজিত আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তান সরকারের উপদেষ্টা পর্যায়ের মধ্যকার বৈঠকও কার্যত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। বৈঠক শেষে সেদিন বিকেলেই পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ নেতাই পিআইএর একটি ফ্লাইটে ঢাকা ত্যাগ করেন। আলোচনার নামে ধূর্ত পাকিস্তানিরা যে কোনো ষড়যন্ত্রের জাল বুনছিল, তা বোঝা যাচ্ছিল কয়েকদিন ধরেই। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সে নীলনকশা স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে গোটা বাংলাদেশই হয়ে উঠেছিল বধ্যভূমি। নৃশংস ও বর্বরোচিত এ হত্যাযজ্ঞে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল তাদের এ দেশীয় দোসর ঘাতক দালাল রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা।

জাতি আজ গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে পঁচিশে মার্চের কালরাতে নির্মম হত্যাযজ্ঞের শিকার সব মানুষকে। রাজধানীতে বিভিন্ন রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও পেশাজীবী সংগঠন ‘কালরাত্রি’ স্মরণে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে।

অবশ্য বৈশ্বিক করোনাভাইরাস মহামারীর জন্য ২৫ মার্চ কালরাতে সব সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং বেসরকারি ভবন ও স্থাপনায় কোনো আলোকসজ্জা করা হবে না। তবে ২৬ মার্চ সন্ধ্যা থেকে আলোকসজ্জা করা যাবে। একই সঙ্গে ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসে রাত ৯টা থেকে ৯টা ১ মিনিট পর্যন্ত সারা দেশে প্রতীকী ‘ব্ল্যাকআউট’ (বিদ্যুৎহীন) পালন করা হবে। তবে কেপিআই (গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা) ও জরুরি স্থাপনা এ কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকবে।

একাধিক সরকারি তথ্য বিবরণীতে এমনটি জানানো হয়েছে। এতে বলা হয়, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের জাতীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান তথা সর্বসাধারণকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ হতে অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ ছাড়া ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণকালে স্মৃতিসৌধের ফুল বাগানের কোনোরূপ ক্ষতি না করার জন্য সর্বসাধারণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

অপর এক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকার গাবতলী থেকে জাতীয় স্মৃতিসৌধ পর্যন্ত সড়কে কোনো ধরনের তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টার লাগানো সীমিত রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এতে আরো বলা হয়, এই সড়কে কোনোভাবেই ত্রিমাত্রিক বা বক্স আকারে তোরণ তৈরি করা যাবে না। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্প্রতি এ সিদ্ধান্তের কথা জানায়। এ ক্ষেত্রে সীমিত পর্যায়ে পোস্টার, ব্যানার ও ফেস্টুন নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করা যেতে পারে বলে মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads