• রবিবার, ৫ মে ২০২৪, ২২ বৈশাখ ১৪২৯
প্রতিরোধে প্রয়োজন গণসচেতনতা

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

প্রতিরোধে প্রয়োজন গণসচেতনতা

  • এম এ বাবর
  • প্রকাশিত ০১ এপ্রিল ২০২১

দেশে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ নিয়ে তৈরি হয়েছে আশঙ্কা। প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। সারা দেশে করোনার শনাক্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ৬ লাখ। শুধু তাই নয়, গত এক সপ্তাহে করোনা রোগীদের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ৩০ হাজার। ভ্যাকসিন নেওয়ার পরও অনেকে আক্রান্ত হয়েছেন করোনায়।  

স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসাধারণের অসচেতনতায় দ্রুত করোনাভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এতে সমাজে এক ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করছে, যা জনজীবনে আতঙ্ক ও অস্বস্তি বলে প্রতীয়মান হয়েছে, যা আমাদের জন্য হুমকিস্বরূপ। তাই গণসচেতনতাই করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি মিলতে পারে। এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, এর আগে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যাওয়ায় জনমনে আত্মতুষ্টি দেখা দিয়েছিল। মানা হয়নি স্বাস্থ্যবিধি। এ কারণেই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি। স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ করোনা মোকাবিলায় সবাইকে আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ অধিদপ্তরের। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, টানা তিন দিন ধরে দেশে করোনায় সংক্রমিত ৫ হাজারের বেশি রোগী শনাক্ত হচ্ছে। গতকাল বুধবার করোনায় সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হয়েছে ৫ হাজার ৩৫৮ জন। আর গত ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত) করোনাভাইরাসে সংক্রমিত আরো ৫২ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত সাত মাসের মধ্যে করোনায় একদিনে এটিই সবচেয়ে বেশি মৃত্যু। এর আগে গত বছরের ২৬ আগস্ট করোনায় ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছিল। দেশে গত ২৩ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত এক সপ্তাহে মোট ২৮ হাজার ৬৯৬ জনের মধ্যে করোনার সংক্রমণ ধরা পড়েছে। গত মঙ্গলবারও দেশে করোনায় সংক্রমিত ৫ হাজার ৪২ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিল। তার আগের দিন সোমবার ৫ হাজার ১৮১ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছিল। এ পর্যন্ত দেশে মোট ৬ লাখ ১১ হাজার ২৯৫ জনের করোনার সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে মারা গেছেন ৯ হাজার ৪৬ জন। মোট সুস্থ হয়েছেন ৫ লাখ ৪২ হাজার ৩৯৯ জন। গতকাল ২৪ ঘণ্টায় (মঙ্গলবার সকাল আটটা থেকে বুধবার সকাল আটটা পর্যন্ত) ২৬ হাজার ৯৩১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। নমুনা পরীক্ষা বিবেচনায় রোগী শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ চূড়ায় (পিক) উঠেছিল গত বছরের জুন-জুলাই মাসে। ওই সময়ে, বিশেষ করে জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জুলাই মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে চার হাজার রোগী শনাক্ত হতো। বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি অনেকটা নিয়ন্ত্রণে থাকার পর এক মাসের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী। এর মধ্যে ছয় দিন ধরে সাড়ে তিন হাজারের বেশি রোগী (প্রতিদিন) শনাক্ত হচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আরেকটি চূড়ার (পিক) দিকে যাচ্ছে দেশের সংক্রমণ পরিস্থিতি।

২০১৯ সালের ডিসেম্বরে চীনের উহানে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। গত বছরের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের ঘোষণা আসে। দেশে প্রথম করোনায় সংক্রমিত ব্যক্তির মৃত্যুর ঘোষণা আসে ১৮ মার্চ। দেশে সংক্রমণ শুরুর দিকে রোগী শনাক্তের হার কম ছিল। গত মে মাসের মাঝামাঝি থেকে সংক্রমণ বাড়তে শুরু করে। মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রোগী শনাক্তের হার ২০ শতাংশের ওপরে ছিল। এরপর থেকে নতুন রোগীর পাশাপাশি শনাক্তের হারও কমতে শুরু করেছিল। মাস দুয়েক সংক্রমণ নিম্নমুখী থাকার পর গত নভেম্বরের শুরুর দিক থেকে নতুন রোগী ও শনাক্তের হারে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা শুরু হয়। ডিসেম্বর থেকে সংক্রমণ আবার কমতে শুরু করে। তবে গত পাঁচ সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক ডা. সাইফ উল্লাহ মুনশি বলেন, করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি, এর প্রভাব এবং করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে আমাদের সকলকে স্বাস্থ্য সচেতন হতে হবে। মানতে হবে স্বাস্থ্যবিধি। তিনি বলেন, অনেক প্রজাতির করোনাভাইরাসের মধ্যে ৭টি প্রজাতি মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হতে পারে। কোভিড-১৯ ভাইরাসটি মানুষ থেকে মানুষে ছড়াতে পারে। সার্স বা মার্স ভাইরাসের মতোই এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরের লক্ষণ দেখা দেয়। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির প্রাথমিক লক্ষণগুলো হচ্ছে-হাঁচি, কাশি, জ্বর, মাথাব্যথা। পরে নিউমোনিয়া এবং শ্বাসকষ্ট। এর কোনো একটি লক্ষণ কারো মধ্যে দেখা দিলে সাথে সাথে তাকে সতর্ক হতে হবে। দ্রুত চিকিৎসকের পরামশ্য নেওয়া জরুরি। আক্রান্ত ব্যক্তির স্পর্শ বা হাঁচি-কাশির মাধ্যমে এই রোগ ছড়াতে পারে। রোগাক্রান্ত কেউ কোনো জায়গা স্পর্শ করার পর যেমন পানির কল, দরজা, চেয়ার-টেবিল, বেসিন, দরজার হাতল, কমোডের সিট, সিট কভার, সুইচ ইত্যাদি সুস্থ কেউ স্পর্শ করলে তিনিও আক্রান্ত হতে পারেন। শরীরে রোগ লক্ষণ প্রকাশ পেতে ২-১৪ দিন সময় লাগতে পারে।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউটের রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল বলেন, করোনাভাইরাস কোনো সিঙ্গেল স্পেসিজের ভাইরাসের নাম নয়। এটি একটি ফ্যামিলি। বিভিন্ন প্রাণীর দেহে এই ফ্যামিলির দুইশর বেশি ভাইরাস আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে মানবদেহে পাওয়া গেছে করোনা পরিবারের ছয়টি প্রজাতির ভাইরাস। চীনের উহান থেকে যে আউটব্রেকটা হয়েছে, এটা সপ্তম বলে ধরে নেওয়া হচ্ছে।

প্রাথমিক পর্যায়ে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির অনেকেরই কোনো উপসর্গ দেখা দেয় না। কেবল সংক্রমণ তীব্র পর্যায়ে পৌঁছালেই অনেকের নানা উপসর্গ দেখা দেয়। তাই সমাজ ও পরিবারে আমাদের প্রত্যেকেরই সবসময় স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে, সতর্ক থাকতে হবে।   

তিনি বলেন, যে-কোনো বয়সি মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হতে পারে এবং কিছুদিনের মধ্যে সুস্থও হয়ে উঠতে পারে। আক্রান্তদের মৃত্যুহার কম। তবে বয়স্ক এবং অন্য কোনো রোগে আগে থেকেই (ডায়াবেটিস, হূদরোগ, অ্যাজমা ইত্যাদি) ভুগছিলেন এমন রোগী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। মানুষের শ্বাসনালিতে মূলত এই ভাইরাস আক্রমণ করে এবং শ্বাসনালিকে সংক্রমিত করে ফ্লু ও নিউমোনিয়ার মতো লক্ষণ প্রকাশ করে। অর্থাৎ জ্বর, গলাব্যথা, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্ট এই হলো এ রোগের লক্ষণ। রোগী মারা যায়, তীব্র শ্বাসকষ্ট থেকে রেসপিরেটরি ফেইলিউর হয়ে।

তিনি জানান, এ ভাইরাস ছড়ায় রেসপিরেটরি ড্রপলেটের মাধ্যমে। মানে হাঁচি, কাশি থেকে বাতাসে ছড়ায়, সেখানে থেকে শ্বাসের মাধ্যমে মানুষের দেহে ঢোকে। এখন পর্যন্ত শতভাগ কার্যকর ভ্যাকসিনও নেই। তাই প্রতিরোধের উপায় হলো, আক্রান্ত রোগীকে আলাদা করে রাখা। সবাইকেই মাস্ক ব্যবহার করা, নিয়মিত হাতধোয়া। আক্রান্ত রোগীর স্পর্শ যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা। এমনকি হ্যান্ডশেক না করারও পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হওয়া প্রয়োজন। করোনাভাইরাস বর্তমানে মানুষ থেকে মানুষে ছড়িয়ে পড়ছে। এর বিস্তার রোধে ভয়াবহ ঊর্ধ্বমুখী রেখাটিকে সমান্তরালে আনা সম্ভব হবে যদি আমরা প্রয়োজন ছাড়া বাইরে না যাই এবং ঘরে অবস্থান করি।

তিনি বলেন, করোনাভাইরাস নিয়ন্ত্রণে রাখতে না পারলে এটি আরো অনেকের ক্ষতিসাধন করবে। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে যেখানে হাসপাতালের বিছানা সীমাবদ্ধ, অপ্রতুল আইসিইউ ও কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাসের যন্ত্র অপ্রতুল, সেখানে করোনা প্রতিরোধ আমাদের কাছে অত্যন্ত জরুরি বিষয়। মনে রাখতে হবে, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তির শতকরা ৯০ শতাংশ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। তাই আতঙ্ক নয়, প্রয়োজন সচেতনতা। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, গত এক বছর ধরে আমরা যে চর্চাগুলো করেছি, স্বাস্থ্য সুরক্ষায় যে শিষ্টাচারগুলো শিখেছি, গত দুই-তিন মাসে আমরা চরম আত্মতুষ্টিতে ভুগেছি। কেউ মানছে না স্বাস্থ্যবিধি, উদাসীনতা পাবলিক পরিবহন, বাজারসহ জনসগম স্থানে। এ কারণেই সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি। করোনা থেকে মুক্তি পেতে সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মানাসহ আরো সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads