• সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪২৯
 করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড

সংগৃহীত ছবি

জাতীয়

শিশু সংক্রমণ বাড়াচ্ছে উদ্বেগ

করোনায় শনাক্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড

  • নিজস্ব প্রতিবেদক
  • প্রকাশিত ০৭ এপ্রিল ২০২১

দেশে করোনা মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউ শুরুর পর থেকেই প্রতিদিনই মৃত ও শনাক্তের সংখ্যা বেড়ে চলেছে।  দেশে করোনা সংক্রমণ দেখা দেওয়ার পর গতকাল মঙ্গলবার এক দিনে রেকর্ড মৃত্যু ও শনাক্ত হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় ৬৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৯ হাজার ৩৮৪ জন। এ সময়ে আক্রান্ত হয়েছে ৭ হাজার ২১৩ জন। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ৬ লাখ ৫১ হাজার ৬৫২ জন। এ তালিকায় রয়েছে শিশুরাও।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মঙ্গলবার জানিয়েছে, এর আগে গত বছর ৩০ জুন এক দিনে ৬৪ জনের মৃত্যু হয়- যা এত দিন ছিল এক দিনের সর্বোচ্চ মৃত্যু। করোনার প্রথম ঢেউয়ে বয়স্করাই বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তবে দ্বিতীয় ঢেউয়ে শিশুরাও আক্রান্ত হচ্ছে। গত সোমবার মারা যাওয়া ৫২ জনের মধ্যে একজনের বয়স ১০ বছরের কম। আরেকজনের বয়স ১১-২০ বছরের মধ্যে। দেশে এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে ১০ বছরের কম বয়সি শিশু মারা গেছে ৩৯ জন। ১১ থেকে ২০ বছর বয়সির মধ্যে মারা গেছে ৬৯ জন। চিকিৎসকরা বলছেন করোনার নতুন স্ট্রেইনের সংক্রমণের ক্ষমতা আগের চেয়ে ৭০ শতাংশ বেশি। জটিলতা বেশি ৩০ শতাংশ। কয়েক দিন আগেও শিশুদের আক্রান্তের হার ছিল শূন্যের ঘরে। এখন শিশু-রোগী বাড়ছে। চিকিৎসকরা বলছেন, গত বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে শিশুদের আক্রান্ত হতে দেখা যায়নি বললেই চলে। এবার মধ্য-মার্চ থেকে আশঙ্কাজনক হারে তাদের সংখ্যা বাড়ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত শিশুদের জন্য পৃথক ইউনিট চালু হয় গত বছরের ১০ মে। এ পর্যন্ত এই ইউনিটে প্রায় দুই হাজারের মতো শিশুর চিকিৎসা হয়েছে। ৪২ বেডের ইউনিটটিতে এখন ভর্তি আছে ১৮ জন।

এর মধ্যে ১৪টি বেড নিয়ে বানানো এইচডিইউ (হাই ডিপেনডেন্সি ইউনিট) ইউনিটও রোগীতে ভর্তি বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. সাঈদা আনোয়ার। বলেন, এখন আসলে খুব খারাপ অবস্থার রোগীরা আসছে। যেটা কয়েক দিন আগেও ছিল না। সবচেয়ে কম বয়সী রোগীর বয়স কত ছিল জানতে চাইলে বলেন, এক মাসের রোগীও পেয়েছি। এমনকি চার দিন বয়সের রোগীও ছিল। চার দিনের শিশু কীভাবে আক্রান্ত হলো জানতে চাইলে বলেন, করোনা পজিটিভ মায়ের কাছ থেকে সে সংক্রমিত হয়েছে। ঢাকা মেডিকেলে নন-কোভিড এরিয়াতে সব সময়ই অনেক রোগী থাকে। তাদের বেশির ভাগেরই করোনা টেস্ট করানোর পর পজিটিভ এসেছে। তখন তাদের আবার করোনা ইউনিটে নিয়ে আসা হয়। এতেও অনেকের মাঝে ছড়িয়েছে।

এবার জ্বর, কাশির সঙ্গে ডায়রিয়া হচ্ছে শিশুদের। অনেকেই আসছে এমআইএস-সি (মাল্টিসিস্টেম ইনফ্ল্যামেটরি সিনড্রোম) নিয়ে। মাঝে রোগীর সংখ্যা অনেক কম ছিল। কিন্তু কমিউনিটি ট্রান্সমিশন বেড়ে যাওয়ার কারণে শিশু-রোগীও বেড়েছে।  তবে শিশু সুস্থতার হার বেশি। কিন্তু যেসব শিশু আগে থেকে হূদরোগ, কিডনি জটিলতা বা দীর্ঘমেয়াদি অসুখে আক্রান্ত তাদের অবস্থা জটিল হয়ে যাচ্ছে।

মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. আবু সাঈদ শিমুল বলেন, এবার শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার এখন অনেক বেশি।  শিশুরা কিন্তু সিভিয়ারিটি নিয়েও আসছে। ডায়রিয়া, বমি, শ্বাসকষ্ট শুরু হচ্ছে অনেকের। কাশি নেই, কিন্তু প্রচণ্ড জ্বরের সঙ্গে ডায়রিয়া-এমন রোগী বেশি পাচ্ছি। এক্স-রে করার পর তাদের অনেকের ফুসফুস মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত পাওয়া গেছে।

বেসরকারি এভারকেয়ার হাসপাতালের শিশু হূদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. তাহেরা নাজরিন বলেন, হার্ট, কিডনি, ফুসফুস ও যকৃতের মতো একাধিক অঙ্গকে ক্ষতিগগ্রস্ত করে এমআইএস-সি। রক্তনালিতে দ্রুত প্রদাহ তৈরি করে। এর বৈশিষ্ট্যগুলো অনেকটা কাওয়াসাকি ডিজিজ ও টক্সিক শক সিনড্রোমের মতো।

ঢাকা শিশু হাসপাতালে এখন পর্যন্ত ১৭০ জনের মতো করোনা আক্রান্ত শিশু চিকিৎসা নিয়েছে বলে জানান হাসপাতালটির উপপরিচালক ডা. প্রবীর কুমার সরকার। তবে এদের বেশির ভাগই অন্য রোগে আক্রান্ত ছিল এবং অস্ত্রোপচারের আগে করোনা পরীক্ষা করাতে গিয়েও অনেক শিশুর পজিটিভ ধরা পড়ে।

কোভিড-১৯ ও এমআইএস-সি সম্পর্কিত রোগ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দ্য সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) জানায়, রোগীর গায়ে ছোপছোপ দাগ হয়, হাত-পা ফুলে যায়। কোভিড-১৯ আক্রান্ত বা আক্রান্ত অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা বা আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে এসেছিল, এমন শিশু-কিশোরদের মধ্যে এমআইএস-সি বেশি দেখা যাচ্ছে। গত বছরের ১৫ মে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এমআইএস-সি সম্পর্কে জানায়। ২২ মে জনস হপকিনসের এক নিবন্ধে এটাকে বিরল রোগ বলা হয়েছে। 

বিশ্বের পরিসংখ্যান বলছে, চার বছরের কম শিশুদের আরটি-পিসিআরে (করোনার নমুনা পরীক্ষা) পজিটিভ কম আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, উপসর্গ থাকার পর আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় নেগেটিভ এলেও যদি শিশুটির পরিবারের কেউ পজিটিভ হয়, তবে ওই শিশুর জন্য আইসোলেশনসহ প্রতিরোধী সব ব্যবস্থা নিতে হবে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক আবু সাঈদ বলেন, প্রায় ৯০ ভাগ শিশু আক্রান্ত হচ্ছে বাবা-মায়ের কাছ থেকে। তাই ব্যবস্থা নিতে হবে বাবা-মাকেই। স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি তারা যেন ঘরে ঢুকেই সন্তানের কাছে চলে না যান। শিশুদের পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানোর পাশাপাশি রোদেও সময় কাটাতে হবে। শিশুদের মানসিকভাবেও ‘বুস্ট আপ’ তথা চাঙ্গা রাখতে হবে।

ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে দেশে করেনা সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নেমে আসে। কিন্তু মার্চের মাঝামাঝি সময় থেকে করোনায় মৃত্যু ও শনাক্ত- দুটোই বাড়তে থাকে। গত ২৯ মার্চ আগের সব রেকর্ড ভেঙে করোনা শনাক্ত হয় পাঁচ হাজার ১৮১ জন। সেই রেকর্ড ভেঙে ফের ৩১ মার্চ শনাক্ত হয় পাঁচ হাজার ৩৮৫ জন। ১ এপ্রিল শনাক্তের রেকর্ড ভেঙে দাঁড়ায় ছয় হাজার ৪৬৯ জন। ২ এপ্রিল ফের রেকর্ড ভেঙে শনাক্ত দাঁড়ায় ছয় হাজার ৮৩০ জন। এর পর ৪ এপ্রিল সাত হাজার ছাড়িয়ে এক দিনে শনাক্ত দাঁড়ায় ৭ হাজার ৮৭ জন। এরপর গতকাল দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ শনাক্ত এবং মৃত্যুর ঘটনা ঘটল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৩৬০টি, অ্যান্টিজেন টেস্টসহ নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৩৪ হাজার ৩১১টি। এখন পর্যন্ত ৪৮ লাখ ৪৭ হাজার ৯৩৫টি নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হয়েছেন দুই হাজার ৯৬৯ জন। এখন পর্যন্ত সুস্থ ৫ লাখ ৫৮ হাজার ৩৮৩ জন। শনাক্ত বিবেচনায় গত ২৪ ঘণ্টায় প্রতি ১০০ নমুনায় ২১ দশমিক ০২ শতাংশ এবং এখন পর্যন্ত ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে। শনাক্ত বিবেচনায় প্রতি ১০০ জনে সুস্থ হয়েছে ৮৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ এবং মারা গেছে ১ দশমিক ৪৪ শতাংশ।

গত ২৪ ঘণ্টায় মারা যাওয়াদের মধ্যে ৩৯ জন পুরুষ এবং নারী ২৭ জন। এখন পর্যন্ত পুরুষ সাত হাজার ৪৩ জন এবং নারী মৃত্যুবরণ করেছেন দুই হাজার ৩৪১ জন। বয়স বিশ্লেষণে দেখা যায় যায়, ৬০ ঊর্ধ্ব ৪১ জন, ৫১ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে ১৭ জন, ৪১ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে পাঁচ জন, ৩১ থেকে ৪০ বছরের মধ্যে দুজন এবং ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে এক জন মারা গেছেন। বিভাগ বিশ্লেষণে দেখা যায়, ঢাকায় মারা গেছেন ৫৪ জন, চট্টগ্রামে চারজন, রাজশাহীতে তিনজন, খুলনায় দুজন, বরিশালে দুজন এবং সিলেটে একজনের মৃত্যু হয়েছে। ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে মারা গেছেন ৬৪ জন এবং বাড়িতে মারা গেছেন দুজন।

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads