• শনিবার, ১৮ মে ২০২৪, ৪ জৈষ্ঠ ১৪২৯
সংক্রমণ ২৪ সাল পর্যন্ত থাকার আশঙ্কা

ছবি: বাংলাদেশের খবর

জাতীয়

কঠোর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের

সংক্রমণ ২৪ সাল পর্যন্ত থাকার আশঙ্কা

  • মোমেনা আক্তার পপি
  • প্রকাশিত ১০ এপ্রিল ২০২১

বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনা মহামারী বছর পার করলেও এটি প্রতিকারের কার্যকর কোনো পন্থা এখনো বের করত পারেনি কোনো দেশ। বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমে কিছু টিকা আবিষ্কার ও সেগুলো প্রয়োগ শুরু হলেও তা কতটা কার্যকর সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা দিতে পারছে না কেউ। ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাস বিশ্ব থেকে একযোগে নির্মূল করতে হবে, তা না হলে এটা ছড়াতেই থাকবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ থাকবে। এ থেকে রক্ষা পেতে ওই সময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে।

চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনার প্রথম ঢেউয়ে নাকাল হয়ে গেছে বিশ্ব। সেই ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার আগেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ। কোনো কোনো দেশে তৃতীয়, এমনকি চতুর্থ ঢেউও চলছে। আমাদের দেশে শীতের সময় দ্বিতীয় ঢেউ আঘাত হানতে পারে, এমন আশঙ্কায় সবাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে। কিন্তু শীত শেষে মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রে উদাসীনতা শুরু হয়। ফলে মার্চের মাঝামাঝি থেকে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যু বাড়তে থাকে। বর্তমানে প্রতিদিনই সংক্রমণ ও মৃত্যু পূর্ববতী দিনকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তাই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ফের দেশে কঠোর বিধি-নিষেধ আরোপ করে। কিন্তু মানুষ তা মানছে না বললেই চলে।

সত্যিকার অর্থে সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে হলে কী করা প্রয়োজন জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের ফার্মাকোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান খসরু বলেন, সরকারিভাবে কারফিউ ও  লকডাউন ঘোষণা করা উচিত। বিশেষ করে যেসব স্থানে করোনা সংক্রমণ বেশি, যেমন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাজশাহী-এসব অঞ্চলে কারফিউ ও লকডাউন দেওয়া জরুরি। তা না হলে করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুঝুঁকি আরো বৃদ্ধি পাবে।

সরকারিভাবে গত সোমবার থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। এর প্রকৃত অর্থ মানুষকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে ঘরবন্দি করা, এ ব্যাপারটাই কেউ অনুধাবন করতে চাইছেন না। ফলে লকডাউনও কার্যকর হচ্ছে না। সরকার লকডাউন ঘোষণা করে তাৎক্ষণিকভাবে সকলের চলাচল বন্ধ না করে ৪৮ ঘণ্টা সবকিছু খোলা রাখার ফলে দেশের যেসব বিভাগ ও জেলায় করোনার সংক্রমণ বেশি, সেসব এলাকায় আরো বেশি লোকজন ছড়িয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। ফলে লকডাউনের যে সুবিধা পাওয়ার কথা, তা আমরা পাব না। তবুও লকডাউনের ফলে মানুষের চলাচল কিছুটা কমায় সংক্রমণ কিছুটা হয়তো কমতে পারে।

মানুষ জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে লকডাউন মানতে চাইছে না-এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, জীবনের জন্য জীবিকা, জীবিকার জন্য জীবন নয়। টানা দুই সপ্তাহ লকডাউন থাকলে ঢাকা শহরের দুই কোটি মানুষের মধ্যে দিন আনে দিন খায় এমন ৩০ লাখ মানুষের খেয়ে বাঁচতে সমস্যা হবে। সরকারিভাবে অর্থায়নের পাশাপাশি সামাজিকভাবে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে বিত্তশালীসহ যাদের সামর্থ্য আছে, সবাই মিলে ফান্ড তৈরি করে ১৪ দিন ৩০ লাখ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখা অসম্ভব কোনো ব্যাপার নয়। বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে সামাজিকভাবে অসহায়-দরিদ্রদের সাহায্যে বিত্তশালীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এগিয়ে এসেছে। করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর হার অব্যাহত থাকলে আর্থিক বিবেচনায় ১৪ দিনের লকডাউনের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতি হবে।

বিএসএমএমইউর উপাচার্য অধ্যাপক ডা. শারফুদ্দিন আহমেদ বিশ্বের বিভিন্ন গবেষকদের তথ্য তুলে ধরে বলেন, আগামী ২০২৪ সাল পর্যন্ত করোনার সংক্রমণ থাকবে। এ থেকে রক্ষা পেতে ওই সময় পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। বিশেষজ্ঞরা যখন এমন কথা বলছেন তখন সরকার ঘোষিত নানান বিধিনিষেধের চতুর্থ দিনে গতকাল (শুক্রবার) থেকে শপিংমল ও মার্কেটগুলো খুলে দেওয়া হয়েছে। এর আগে গত বুধবার থেকে সব সিটি করপোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চলাচলের অনুমতি দেওয়া হয়। লকডাউনে মানুষ রাস্তায় অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে। হাসপাতালগুলোতে করোনা আক্রান্ত রোগীর ভিড়ও বাড়ছে। এতদিন করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেডের সংকট থাকলেও এখন সাধারণ বেডই সোনার হরিণ হয়ে গেছে। ডেডবডি নামলেই পাওয়া যাচ্ছে বেড।

বর্তমানে ব্রিটেন, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ব্রাজিল-এই তিন দেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের তিনটি ধরন (ভ্যারিয়েন্ট) সবচেয়ে বেশি সংক্রামক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা। এগুলোর মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটিই হঠাৎ করে বাংলাদেশে বেশি ছড়াচ্ছে। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি), সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের যৌথ গবেষণায় এ চিত্র উঠে এসেছে।

এতে বলা হয়েছে, ঢাকায় সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার করোনা ধরনের প্রভাব বেশি পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে ঢাকায় প্রাধান্য বিস্তার করছে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরনটি। গত ১৮ থেকে ২৪ মার্চ ৫৭ জন কোভিড-১৯ রোগীর নমুনা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণ করেন গবেষকরা। তাদের মধ্যে ৪৬ জনের শরীরে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন শনাক্ত হয়েছে, যা গবেষণায় মোট শনাক্তের ৮১ শতাংশ। সাতজনের শরীরে শনাক্ত হয়েছে ব্রিটেন থেকে ছড়ানো করোনার ধরন। বাকি চারজনের শরীরে করোনার অন্য ধরনের উপস্থিতি শনাক্ত হয়েছে।

এর আগের সপ্তাহে ১২ থেকে ১৭ মার্চ ৯৯ জন কোভিড-১৯ রোগীর নমুনা বিশ্লেষণ করে ৬৪ জনের শরীরে দক্ষিণ আফ্রিকার ধরন শনাক্ত হয়েছিল। ওই সময় ব্রিটেনের ধরন শনাক্ত হয়েছিল ১২ জনের শরীরে। বাকিদের করোনার অন্য ধরন শনাক্ত হয়। ২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি দেশে প্রথম ব্রিটেনের  করোনা ধরন শনাক্ত হয়। যদিও গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটার (জিআইএসএইড) তথ্য অনুযায়ী, আমাদের দেশে ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকেই এই ধরন ছড়িয়েছে।

বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবরেটরি জানায়, দক্ষিণ আফ্রিকার এই ধরন ‘এন ৫০১ ওয়াই’ নামের একটি মিউটেশন (রূপান্তর) বহন করে, যা এটিকে আরো সংক্রমণ বা ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করে। এই ভাইরাসের আরেকটি মিউটেশন ‘ই৪৮৪কে’ আরো ভয়াবহ। এটি মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ধোঁকা দিয়ে টিকার কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে করোনার এই ধরন যত ছড়িয়ে পড়বে, ততই সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়বে। তাই এ থেকে পরিত্রাণে সবাইকে বেশি বেশি স্বাস্থ্যবিধি পালন করতে হবে। নতুন যে ধরনই আসুক, তার বিরুদ্ধে বাঁচার উপায় একটাই-মাস্ক পরতে হবে। এ ছাড়া হাত ধোয়ার অভ্যাস চালু রাখা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা এবং শারীরিক দূরত্ব মেনে চলতে হবে।

 

 

আরও পড়ুন



বাংলাদেশের খবর
  • ads
  • ads